এখন বিজয়ের মাস। চারদিকে যেদিকে চোখ যায় জাতীয় পতাকা চোখে পড়ছে। তবে যততত্র জাতীয় পতাকার ব্যবহার, বিভিন্নভাবে জাতীয় পতাকার প্রতি অসম্মান, এর মর্মার্থকে অসম্মান, অবমাননা করা হচ্ছে। শুধু বিজয়ের মাস নয় অন্য সময়গুলোতেও এসব লক্ষ্য করা যায়।
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার যে যথেচ্ছ ব্যবহার আমাদের দৃষ্টিতে পরিলক্ষিত হয় তাতে করে এটি জাতীয় পতাকার প্রতি অবমাননা ভিন্ন অন্য কিছুই মনে হয় না। হ্যাঁ, সেই উপলব্ধি থেকেই সকলের জ্ঞাতার্থে বাংলাদেশী আইন অনুযায়ী জাতীয় পতাকার ব্যবহার সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করলাম।
♣জাতীয় পতাকার আকার, মর্যাদা, ব্যবহারবিধি সহ নানা বিষয় “পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ফ্ল্যাগ রুলস, ১৯৭২” (সংশোধিত-২০১০) -এ বর্ণিত আছে। এ সম্পর্কিত বিস্তারিত জানার জন্য আগ্রহীগণ মূল বিধিটি দেখে নিবেন বলে আশা করছি।
♦♦জাতীয় পতাকার আয়তন কি হবে?
♣জাতীয় পতাকার আয়তনঃ
গাড় সবুজ রঙের আয়তাকার ক্ষেত্রের মধ্যে লাল রঙের ভরাট বৃত্ত সম্বলিত আমাদের জাতীয় পতাকার স্বাভাবিক দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত হবে- ১০:৬ ।
ভবনে ব্যবহারের জন্য পতাকার আয়তন হবে ১০’*৬’ বা ৫’*৩’ বা ২’*১’।
ভবন ব্যতীত গাড়ীতে ব্যবহারের জন্য পতাকার আয়তন হবে ১৫’’*৯’’(বড় গাড়ীর জন্য) বা ১০’’*৬’’(মাঝারি বা ছোট গাড়ীর জন্য)। এছাড়া আর্ন্তজাতিক কনফারেন্স বা দ্বি-পক্ষীয় আলোচনার জন্য টেবিল পতাকার আয়তন হবে ১০’’*৬’’।
♦♦কোন কোন ভবনসমূহে এবং কোন কোন দিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হবে?
♣সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ সরকারী ভবন ও অফিসসমূহ যেমন- রাষ্ট্রপতির বাসভবন, সংসদ ভবন, হাইকোর্ট ও জেলা ও দায়রা জজ আদালত সমূহ, সচিবালয়, কেন্দ্রীয় ও জেলা কারাগার সমূহ, পুলিশ স্টেশন সমূহ প্রভৃতি স্থানে প্রত্যেক কার্যদিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হবে।
এছাড়া, বিশেষ দিবস সমূহ যেমন- মহানবী (সাঃ) এর জন্ম দিবস, ২৬-শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬-ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস সহ সরকারী প্রজ্ঞাপনে উল্লেখিত অন্যান্য দিবস সমূহে বাংলাদেশের সর্বত্র সরকারী- বেসরকারি ভবন সমূহ ও বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন সমূহের অফিসগুলোতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলিত থাকবে।
♦♦কোন কোন ব্যক্তিবর্গ তাঁদের মোটরগাড়ী ও জলযানে ‘বাংলাদেশের পতাকা’ উত্তোলনের অধিকারী হবেন?
♣বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রীবর্গ ও সম স্ট্যাটাসের ব্যক্তিবর্গ, সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা প্রমূখ ব্যক্তিবর্গ উক্ত মোটরগাড়ী ও জলযানে শুধুমাত্র তাঁদের ভ্রমণকালীন সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অধিকারী হবেন। উল্লেখ্য, ৭২ সালের ফ্ল্যাগ রূলসের মাধ্যমে কোন সংসদ সদস্য বা সিটি মেয়রদের তাদের গাড়ীতে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অধিকার প্রদান করেনি।
♣♣জাতীয় পতাকার সম্মান রক্ষার্থে পতাকা বিধি প্রদত্ত নির্দেশাবলীঃ
♦সর্বদা জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন করতে হবে;
♦পতাকা দ্বারা মোটর গাড়ি, রেলগাড়ী, নৌকা বা অন্য কোন যানবাহনের সামনের ভাগ, পিছনের ভাগ বা পার্শ্বভাগ আচ্ছাদিত করা যাবে না;
♦যেক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের পতাকার সাথে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পতাকার জন্য স্থান (place of honour) সংরক্ষিত থাকবে;
♦যেক্ষেত্রে দুটি পতাকা অথবা রঙিন পতাকা উত্তোলিত হয় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পতাকা ভবনের ডান দিকে উত্তোলিত হবে;
♦বাংলাদেশের পতাকার উপরে অন্য কোন দেশের পতাকা বা অন্য কোন রঙিন পতাকা উত্তোলন করা যাবে না;
♦বাংলাদেশের পতাকা শোভাযাত্রার মধ্যভাগে বহন করতে হবে অথবা সৈন্যদলের অগ্রগমন পথে (Line of March) শোভাযাত্রার ডান দিকে বহন করতে হবে;
♦যেক্ষেত্রে অন্য দেশের পতাকার সাথে বাংলাদেশের পতাকা একত্রে উত্তোলন করা হয় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পতাকা প্রথমে উত্তোলিত হবে এবং নামাবার সময় সর্বশেষে নামাতে হবে;
♦যেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পতাকা অর্ধনমিত থাকে, সেক্ষেত্রে প্রথমে পতাকাটি সম্পূর্ণরুপে উত্তোলন করে অর্ধনমিত রাখা হবে এবং পতাকা নামানোর সময় পুনরায় পতাকাটি চূড়া পর্যন্ত উঠিয়ে তারপর নামাতে হবে;
♦কবরস্থানে জাতীয় পতাকা নিচু করা যাবে না বা ভূমি স্পর্শ করানো যাবে না; পতাকা কখনোই মেঝেতে, ভূমিতে, পানিতে বা সমতলে স্পর্শ করানো যাবে না;
♦জাতীয় পতাকা কোন কিছুর আচ্ছাদন হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না। তবে কোন ব্যক্তিকে যদি পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় সমাহিত করা হয় তাহলে তার কফিনে জাতীয় পতাকা দ্বারা আচ্ছাদন করা যেতে পারে;
♦পতাকা এমনভাবে ব্যবহার করা যাবে না যাতে পতাকা ছিড়ে যায় বা অন্য কোন ভাবে ময়লা বা নষ্ট হয়;
♦এছাড়া সরকারী অনুমোদন ছাড়া ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে পতাকা কোন ট্রেড মার্ক, ডিজাইন, শিরোনাম বা অন্য কোন প্যাটেন্ট হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না;
♦পতাকা দ্রুততার সাথে উত্তোলন করতে হবে এবং অত্যন্ত সম্মানের সাথে নামাতে হবে।
♦এছাড়া জাতীয় পতাকা ব্যবহারের সাধারণ নিয়মের মধ্যে রয়েছে যে, গাড়ী, জলযান বা ঊড়োজাহাজ ব্যতীত অন্যস্থানে পতাকা শুধুমাত্র সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উত্তোলিত থাকবে। তবে বিশেষ কারণে যেমন সংসদের অধিবেশন চলাকালীন বা শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান চলাকালীন রাতের বেলায় ও জাতীয় পতাকা উত্তোলিত থাকতে পারে। এছাড়া, পতাকার উপর কোন কিছু লেখা, লিপিবদ্ধ করা বা ছাপানো যাবে না। এবং গাড়ীতে পতাকা ব্যবহারের ক্ষেত্রে গাড়ির চেসিস বা রেডিয়েটর ক্যাপের ক্লাম্পের সাথে পতাকা দন্ড দৃঢ়ভাবে আটকাতে হবে।
♦♦কোন বেসরকারি ব্যক্তি কি আইন নির্দেশিত দিবস ভিন্ন অন্য দিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে পারেন বা উত্তোলনের নির্দেশ দিতে পারেন?
♣ফ্ল্যাগ রুলস’এর ৪ ও ৭ বিধি লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, কিছু নিয়ম ও সুনির্দিষ্ট ছাড়া বেসরকারি জনসাধারণ কর্তৃক জাতীয় পতাকার যত্রতত্র ব্যাবহার নিষিদ্ধ। বিশ্বের অন্যান্য বিভিন্ন দেশেও জাতীয় পতাকার অবাধ ব্যবহারের উপর সীমাবদ্ধতা আরোপিত আছে; এই সীমাবদ্ধতা আরোপিত শুধুমাত্র জাতীয় পতাকার মর্যাদা রক্ষার জন্য।
বেসরকারি ব্যক্তি কর্তৃক তাদের বেসরকারি ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হতে পারবে কিনা এ প্রসঙ্গে ভারতে মামলা হয়েছে; আদালতের সিদ্ধান্তও আছে।
ভারতে এক ব্যাক্তি তার নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলে মধ্যপ্রদেশ সরকার সেখানে বাঁধা প্রদান করে, ফলে সংক্ষুব্ধ হয়ে লোকটি দিল্লি হাইকোর্টে এই মর্মে রিট আবেদন করে যে, আইনসিদ্ধ উপায়ে জাতীয় পতাকার ব্যবহারে মধ্যপ্রদেশ সরকার কর্তৃক বাঁধা প্রদানের মাধ্যমে তার সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার (freedom of expression) খর্ব হয়েছে।
দিল্লি হাইকোর্ট তার সিদ্ধান্তে বলেন যে, ভারতীয় ফ্ল্যাগ কোডের মাধ্যমে জাতীয় পতাকা উত্তোলনে প্রদত্ত সীমাবদ্ধতা আইনসঙ্গত নয়; কেননা নির্বাহী আদেশের (ফ্লাগ কোড) মাধ্যমে সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের (অনুঃ১৯) চর্চাকে রহিত করা যায় না। সুতরাং, সুনির্দিষ্ট আইন প্রনয়নের মাধ্যমে প্রদত্ত বাঁধা ছাড়া দেশের নাগরিকদের অধিকার থাকবে যথাযথ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক জাতীয় পতাকা উত্তোলনের। আদালত বলেন, “it could not be disputed that right to fly the national flag at the premises of a person, whether at his residence factory or office, is a part of his fundamental right of freedom of expression and that right can be restricted only by parliament in the circumstances mentioned in Art. 19(2) of the Constitution……….(আমাদের দেশে অনুঃ৩৯)
The restrictions imposed by the flag code on flying of the National Flat have not been by any law……” তবে, দিল্লি হাইকোর্টের এই সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে সরকার কর্তৃক আপিলের ফলে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক স্থগিত আছে।
যাইহোক, আমার মতে জনসাধারণ কর্তৃক জাতীয় পতাকার অবাধ প্রদর্শন ও উত্তোলন সীমিত হওয়া উচিত, কেননা এতে করে আমরা হয়তো আমাদের অজ্ঞতা বশতঃ জাতীয় পতাকার অবমাননা করে ফেলতে পারি যা মোটেও কাম্য নয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতীয় পতাকার ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ওই দেশগুলোতে আমাদের দেশের মতো জাতীয় পতাকা দিবস ভেবে ও শর্ত সাপেক্ষে প্রদর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যদিও কানাডাতে ভিন্ন আইন দেখা যায় অর্থাৎ সেখানে ‘’…allows unrestricted display of National Flag subject to the stipulation that, at all times, the flag should be treated with dignity and respect and flown and displayed properly”।
কিন্তু আমাদের দেশের এটি অনুমিত হলে সাধারণ মানুষ এর মর্মার্থ ধারণ করে জাতীয় পতাকার সম্মান কতটুকু নিশ্চিত করতে পারবে সে বিষয়ে বেশ সংশয় থেকে যায়!!!!
(ছবিঃ ইন্টারনেট)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ২:১১