পর্ব - ১
দুই
চেয়ারম্যান করিম সরকার পরপর তিনবার ইউপি ইলেকশনে জয়লাভ করেন। শুধু জয়লাভ করেন বললে ভুল হবে, বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দীর জামানত বাতিল হয় হয় অবস্থা। এলাকার মানুষ তাঁকে খুবই পছন্দ করে। মজার বিষয় হলো, পরোপকারী, সহজ সরল ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত হলেও আড়ালে অনেকেই তাঁকে বোকা চেয়ারম্যান নামে ডাকে। বিষয়টাতে যে তিনি জানেন না তা নয়, বরং জেনেও কিছু না বলাটা হয়তো উনার ভালো গুণগুলোর মধ্যে একটা।
মতিন মিয়াদের ভ্যান চেয়ারম্যান বাড়ির প্রধান ফটকের সামনে থামলো, তখন তিনি বৈঠকখানার আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে পত্রিকা পড়ছিলেন। প্রধান ফটক পেরোলেই বৈঠকখানা, এর পরে আরেকটা ছোট ফটক মূল বাড়িকে আলাদা করেছে। সাধারণত এ সময়টা তিনি বাসায় থাকেন না। গঞ্জে কোনো কাজ না থাকলে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে বসেন। গত রাত থেকে শরীরটা একটু গরম থাকায় তিনি আজ বাড়ির বাইরে বের হননি। বৈঠক খানায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। বাইরে ভ্যান গাড়ির থামার শব্দ হলো। মতিন মিয়া বৈঠক খানায় ঢুকে চেয়ারম্যান সাহেবকে সালাম দিল। তিনি পত্রিকা থেকে মাথা তুলে খানিকটা উপর-নীচ করলেন কিংবা নিঃশব্দে সালাম নিলেন। বললেন, কী খবর মতিন?
- চাচা, খবর ভালো। শহর থাইকা মেহমান আইছে।
চেয়ারম্যান সাহেব কিছু বলার আগেই শহুরে মেহমান ভেতরে ঢুকলো। তাকে অনুসরণ করে দেলোয়ার হোসেনও ঢুকলো, হয়তো আশেপাশেই কোথাও ছিল। আগুন্তককে দেখে চেয়ারম্যান সাহেব সোজা হয়ে বসলেন। আগুন্তক বললো, স্লামালেকুম, আমি ঢাকা থেকে এসেছি। আমার চাচার নাম ইলিয়াস আহমেদ।
- ওয়ালাইকুম আসসালাম। হ্যাঁ হ্যাঁ। আপনের চাচার লগে আমার কথা হয়েছে। বসেন।
আগুন্তক চেয়ারম্যান সাহেবের সামনে রাখা একটা চেয়ারে বসলো। চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, তা বাবাজি, রওয়ানা দিছেন কখন?
- জ্বী রওয়ানা দিয়েছি রাত দশটার দিকে। তবে চাচা, আপনি কিন্তু আমাকে তুমি করে বলবেন। আমি বয়সে আপনার অনেক ছোট।
তিনি আগুন্তকের কথায় খুশি হলেন। বললেন, তা বেশ। তুমি কইরাই বলবো। তোমার নামটা জানি কী কইলা?
- মারুফ।
- মারুফ, বেশ। পথে বেশি কষ্ট হয় নাই তো?
- না চাচা। তবে বাসের টায়ার পাংচার হবার কারণে একটু দেরি হয়েছে। কোচটা সম্ভবত একটু পুরোনো।
- অনেক দূরের পথ তো এইসব ঝামেলা লাইগাই থাকে। রেগুলার প্যাসেঞ্জারও পায় না, নয়া গাড়িও নামায় না। যাক গিয়া, ইলিয়াস কেমন আছে? বন্ধু মানুষ, অনেকদিন সাক্ষাৎ হয় না।
- উনি ভালো আছেন। আপনার জন্য একটা চিঠি দিয়েছেন।
পকেট থেকে একটা খাম বের করে এগিয়ে দেয় মারুফ। উনি সামনে ঝুঁকে খামটা হাতে নিলেন এবং টেবিলে রাখলেন। ইলিয়াস আহমেদের চিঠি লেখার বাতিক আছে। কারণে অকারণে বড়ো বড়ো চিঠি লেখে। কাজেই চিঠি পাবার সাথে সাথে না-পড়াটাকে তিনি অন্যায় মনে করলেন না। বললেন, গত সপ্তাহে কথা হয়েছে। দেখি, তোমার পৌঁছানোর সংবাদটা দেই।
তিনি মোবাইল ফোনের দিকে হাত বাড়াচেছন দেখে মারুফ বললো, চাচাকে ফোনে পাবেন না। উনি পরশু রাতে অফিসের কাজে মালয়েশিয়া গিয়েছেন।
চেয়ারম্যান সাহেব ফোনটা নিলেন না। প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, তুমি কি কোনো কাজে আইছো না এমনেই গ্রাম ঘুরতে?
- আমি পিএইচডি গবেষণার কাজ করছি। একটা জরিপ করতে হবে। শহর ও গ্রামের জন্য ভিন্ন ভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। চাচা আপনার কথা বললেন, তাই এসে পড়লাম।
- ভালো কাম করছো। কয়দিন থাকবা? ব্যাগ ট্যাগ লও নাই সাথে?
- জ্বী জ্বী, ব্যাগ আছে বাইরে ভ্যানে। সপ্তাহখানেক তো থাকতে হবেই।
মতিন মিয়া বলে ওঠে, আমি ব্যাগ নামাইতাছি। সে বৈঠকখানা থেকে বের হয়ে যায় এবং প্রায় সাথে সাথেই ব্যাগ নিয়ে ভেতরে আসে। চেয়ারম্যান সাহেব দেলোয়ার হোসেনের দিকে তাকিয়ে বলে, উনারে গেস্ট রুমে লইয়া যাও। আর খাদেমরে ডাকো।
খাদেমকে ডাকতে হয় না, সে সম্ভবত দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। চেয়ারম্যান সাহেব তাকে স্মরণ করা মাত্রই পঞ্চাশোর্ধ্ব সুস্বাস্থ্যের অধিকারী খাদেম ঘরে প্রবেশ করে দরজার পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। তিনি বললেন, খাদেম, শহর থাইকা মেহমান আসছে। তুমি জাল লইয়া যাও, পুস্করুনিতে বড়ো মাছ থাকার কথা।
স্বল্পভাষী খাদেম বললো, জ্বে আইচ্ছা।
- মেহমানরে ভেতরে লইয়া যাও। উনার থাকার ব্যবস্থা কর।
‘জ্বে আইচ্ছা’ বলে খাদেম মারুফের ব্যাগটা তুলে নিয়ে অপেক্ষা করে। চেয়ারম্যান সাহেব অতিথির দিকে তাকিয়ে বলেন, তাইলে বাবা, তুমি রেস্ট করো।
খাদেমকে অনুসরণ করে মারুফ বের হয়ে যায়। চেয়ারম্যান সাহেব আবার পত্রিকায় চোখ রাখেন। মতিন মিয়া দাঁড়িয়ে থাকে। বললো, চাচা একখান কথা কইতাম।
- কী কথা?
- গাছ কাটনের টেকা তো পাইলাম না। কাঠুরে তিনজনরে তো টেকা দেওন লাগে।
চেয়ারম্যান সাহেব দেলোয়ার হোসেনের দিকে তাকায়। দেলোয়ার বলে, হেরা তো গাছ কাটবার পারে নাই। লোকগুলান কামের না, ঠিক মতন দড়ি বাঁধন দিলে গাছে কি নড়বার পারতো?
- কাটবার পারি নাই কথা সত্য কিন্তু দিনমজুরের তো টেকা দেওন লাগে।
দেলোয়ার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, চেয়ারম্যান সাহেব ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, দেলোয়ার, কামটা তুমি ঠিক করো নাই। ওরা গরীব মানুষ, ওগো দাবী মিটায় দিও। আর মতিন মিয়া, তুমিও একখান কথা শুইনা রাখো। পুস্করুনির পানি নিয়া কোনো আচানক গল্প বানাইবা না।
মতিন মিয়া আমতা আমতা করে, জ্বে আমি তো কিছু কই নাই।
- তুমি কও নাই ভালো কথা। কাউরে কইতেও দিও না।
- জ্বে আইচ্ছা।
- পুস্করুনিতে মাছ চাষ করা হয়, বিষ দেওয়া হয়। পানি তো পরিস্কার না। হেই পানি খাইয়া মানুষ না মরলেও পেটের অসুখ হইবো। বুচছো?
- জ্বে চাচা, আর কইতে হইবো না।
- এইবার যাও।
চেয়ারম্যান সাহেব চলে যাবার কথা বললেও মতিন মিয়া গেল না। বললো, আরেকখান কথা ছিল।
- কও।
- গতরাতে জহের চোরারে দেখছি মনে লয়।
জহের চোরের নাম শুনে দেলোয়ার হোসেনের চোখ ছোট ছোট হয়ে যায়। সে উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, ঠিক দেখছোস? কই দেখছোস?
- রাইত নয়টা দশটা হইবো। বাজারের খলিল কাকার দোকানে যাইতেছিলাম তহন হেরে বাজার থাইকা পশ্চিমের ক্ষেতের দিকে যাইতে দেকছি।
- সঠিক দেখছোস?
- সঠিক কইতে পারি না, আন্ধার আছিল। তয় হাঁটাচলা হের মতনই।
- শুনছিলাম জেলে আছে।
চেয়ারম্যান সাহেব ওদের কথোপকথন শুনছিলেন, বললেন, ছাড়া পাইতে পারে না? চুরি দায়ে জেলে গেছে, কয়দিন আর রাখবো হেরে?
দেলোয়ার চেয়ারম্যান সাহেবের স্থিরতাকে মেনে নিতে পারে না। সে বলে, কিন্তু হেয় তো খুনের মামলার আসামী।
- খুন তো প্রমাণ হয় নাই। হয়েছে?
- না, হয় নাই।
- খুন প্রমাণ হইলে তো ফাঁসিই হইতো।
- না কাকা, মানবার পারলাম না। সবাই জানে, সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে খুনের মামলা থাইকা ছাড়া পাইছে। হের আচরণও সনদোজনক।
- তোমাগোরে বুঝাইলে বুঝো না, খালি মাইষের মন্দ দিকটা আগে দেখো। মতিন মিয়া, আরেকবার যদি জহেরের দেহা পাও আমার নিকট আইতে বলবা। বলবা, আমি হেরে সালাম দিছি।
মতিন মিয়া মাথা নাড়ে এবং দেলোয়ারের দিকে তাকায়। দেলোয়ার মতিনকে চলে যেতে ইশারা করে। মতিন বের হলে দেলোয়ারও বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে যায়।
বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে ছোট ফটক পার হতেই হাতের বামদিকে পড়ে গেস্ট রুম। গেস্ট রুমের চৌকাঠের ওপরের দেয়ালে সিমেন্ট দিয়ে খোদাই করে লেখা - অতিথিশালা!
গ্রাম সম্পর্কে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা না থাকা মারুফের কাছে চেয়ারম্যান বাড়িটা অনেক আধুনিক মনে হলো। গেস্ট রুমের মেঝে প্লাস্টার করা হলেও এটাস্ট বাথরুমটির মেঝে দেয়ালে টাইলস রয়েছে। আর হাই কোমড দেখে সে খুবই অবাক হয়েছে। এতোটা সে মোটেও আশা করেনি।
চোখে-মুখে পানি দিয়ে বাথরুম থেকে বের হলো মারুফ। বেশ বড়ো একটা ভ্রমণে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। ঠিক তখনি দরজার কড়া নাড়ার শব্দ হলো। উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই ট্রে হাতে বারো-তের বছর বয়সী এক বালককে দেখলো। ট্রেতে দুই গ্লাসে পানীয়। বালকটি বললো, লেবুর শরবত।
দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বালকটিতে ভেতরে ঢুকতে দিল। ওকে দেখে কাজের মানুষ বলেই মনে হলো মারুফের। বললো, ঠিক আছে রাখো।
বালকটি দেয়াল ঘেঁষে পড়ে থাকা টেবিলে ট্রে নামিয়ে রাখলো। মারুফ বললো, তোমার নাম কী?
- বাচ্চু।
- বাহ সুন্দর নাম। তুমি স্কুলে যাও।
- আগে যাইতাম।
- কোন ক্লাশ পর্যন্ত পড়েছো?
- ফাইভ পাশ দিছি।
- বাহ ভালো তো। এখন যাও না কেনো?
- এহন আমি বড়ো হইছি। হের লাইগা মায়ে কামে লাগায় দিছে। আমি যাই?
- আচ্ছা যাও।
- কুনো দরকার হইলে আমার নাম ধইরা ডাক দিয়েন।
- ঠিক আছে বাচ্চু।
বাচ্চু চলে গেলে মারুফ ট্রেতে রাখা গ্লাসের দিকে তাকালো। এক গ্লাসে লেবুর শরবত হলেও আরেক গ্লাসের পানীয়- স্বচ্ছ। অর্থাৎ পানি। পানির গ্লাসে হাত দিয়ে দেখলো- ঠাণ্ডা। প্রথমেই সে পানি খেল, তারপর খেল শরবত। শরীরটা জুড়িয়ে ক্লান্তিভাব অনেকটা কেটে গেল। ঘরের একপাশে রাখে খাটে আধশোয়া হয়ে বসলো। চোখবুজে খানিকটা সময় পার করলো। নাহ, সাময়িক ক্লান্তি কাটলেও শরীর আসলে খুবই নিস্তেজ। পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলো। নেটওয়ার্ক চেক করা দরকার। মোবাইল ডেটা চালু করলো। খুবই ভালো অবস্থা নেটওয়ার্কের, মোটামুটি সকল ধরনের কাজই করা যাবে। ‘স্ট্রং নেটওয়ার্ক’ বলে নিজেকে আশ্বস্ত করলো যেন। হোয়াটসঅ্যাপে কয়েকটা মেসেজ ঢুকে পড়লো টু টু শব্দ করে নোটিফিকেশন দিয়ে। না, তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো মেসেজ নেই। তবে সে কয়েকটা মেসেজ পাঠালো। কাসেম নগরে পৌঁছানোর খবরটা দেয়াও দরকার ছিল।
ঘড়িতে চোখ বোলালো। বারোটা পেরিয়ে গেছে। অর্থাৎ দুপুর প্রায় হতে চললো। খানিকক্ষণ রেস্ট নেয়া যেতে পারে। ফোনটা রেখে চোখে বন্ধ করলো।
গ্রামের মানুষের আর্থ-সামাজিক জরিপের জন্য একটা সাধারণ প্রশ্নমালা তৈরি করা হয়েছে। সে নিজ তৈরি করেনি, এক্ষেত্রে কাছের একজন সহযোগীতা করেছে। প্রিন্ট কপিগুলো ব্যাগে আছে, তবে এখনো ভালো ভাবে প্রশ্নগুলো দেখা হয়নি। সেগুলো নিয়ে বসতে হবে, প্রয়োজনে সংযোজন-বিয়োজন করতে হবে। হাতে পর্যাপ্ত সময় আছে কাজেই প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। পুরো পরিকল্পনাটা ঢেলে সাজাতে হবে। অন্যের সহযোগীতা নিয়ে সে আগে কখনো কাজ করেনি। নিজের পরিকল্পনায় মাফিক কাজ করার মজাই আলাদা।
(চলবে)
ছবি: গুগলমামা।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২০ সকাল ১১:২০