তখন ক্লাশ ফাইভে পড়ি। জলবসন্তে আক্রান্ত আমি সারাদিন বই পড়ে শুয়ে- কাটাই। আমাকে তিন গোয়েন্দার বই যোগান দিতে দিতে ত্যাক্ত-বিরক্ত আমার বোন আমাকে 'দেবী' বইটা ধরিয়ে দেয়।কি করবে বোন আমার! বেচারি! একে তো আমি মায়ের আদরের ছোট ছেলে, তার উপরে জলবসন্তের রোগী। মুখ বুজে আবদার মেনে নিতে নিতে না পেরে শেষে বাচ্চাদের জন্য আমাদের পরিবার মতে নিষিদ্ধ বই-ই হাতে দিয়ে দেয়। বুভুক্ষ আমি জানালা দিয়ে মাঠে বন্ধুদের খেলা দেখতে দেখতে বিরস বদনে শুরু করলাম 'দেবী'।
বিশ্বাস করুন আর নাই করুন তার আগে পর্যন্ত তিন গোয়েন্দা ছাড়া আর কোনো বই আমার সহ্য হয়নি। অথচ, দেবী পড়ার পর থেকে লেখকের বাকী বইগুলো শেলফ থেকে নিয়ে পড়া শুরু করলাম। যতই পড়ি ততই মনে হয় আরো কিছু পড়ি। এরমধ্যেই পরিচিত হয়ে গেলাম মিসির আলী আর হিমুর সাথে। পেয়ে গেলাম এক নতুন জগতে সন্ধান। শুরু হলো আমার 'বই গেলা'।
'বই গেলা' শব্দটা আমার মায়ের। আমি নাকি বই পড়তামনা শুধুই গিলতাম। খাওয়ার সময় বই, শোয়ার সময় বই এমনকি বাথরুমে গেলেও বই। গল্পের বই পাওয়ার জন্য ক্লাশের বই তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলার দরুন রেজাল্ট হতে লাগলো দূর্দান্ত। অথচ, তার আগে আমাকে পড়ার টেবিলে বসাতে ক্রেন নিয়ে আসতে হতো। পরীক্ষায় পাশ করানোর জন্য মা্য়ের মাজারে মানত করা লাগতো। সেই আমি গুন্ডা গরু থেকে শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট হয়ে গেলাম শুধু এক দেবীর কল্যাণে।
দেবীর কল্যাণে শুধু এক লেখকেরই না, পরিচিত হলাম আরো আরো অনেকের সাথে। ভান্ডার পরিপুর্ন হতে লাগলো। একসময় জীবিকার সন্ধানে বিদেশে আসলাম। কি্ন্তু সেই পিপাসা মিটেনি। ব্রিক লেইনে গিয়ে নতুন বইয়ের সন্ধান করি। ভাইয়েরা কিছু পাঠালে বই পাঠাতে ভুলেনা। এমনকি শ্বাশুড়িও আমার জন্য বই নিয়ে আসেন।
সেই দেবীর স্রষ্টা হুমায়ুন আহমেদ স্যার, যিনি একটা বইয়ের মাধ্যমে পাল্টিয়ে দিয়েছেন আমার জীবন।নয়তো আমি হতে পারতাম বল্টু রফিক, কিরিচ মিলন কিংবা কোপা শামসু'র মতো কেউ একজন। মাঝে মাঝে বসে ভাবি আজকের যেখানে আমি তারজন্য দায়ী কে? হুমায়ুন আহমেদ নাকি আমার জলবসন্ত??? সেই প্রশ্নের উত্তর মিলানো কঠিন।তারপরও স্যারের কাছে আমি অনেক অনেক কৃতজ্ঞ। এই অভাজনের কোনোদিন সৌভাগ্য হয়নি স্যারের সাথে দেখা করার। স্যারের বইয়েরই মতোই তার স্বপ্ন আমাকে ছুঁয়ে গেছে। ‘ক্যানসার রিসার্চ সেন্টার’ দিয়েই বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার ক্যানসার শিক্ষা বা চিকিৎসার তীর্থ। আমার মেয়েকে কিংবা কোনো ব্রিটিশ বন্ধুকে যখন বলি বাংলাদেশে কক্সবাজার আছে, সুন্দরবন আছে; তখন গর্বে বুক ফুলে উঠে। হয়ত অদূর ভবিষ্যতে আরো গর্ব করে বলতে পারবো দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ক্যানসার রিসার্চ সেন্টার আমাদের বাংলাদেশেই।
এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন না করে আপনি কোথাও যাচ্ছেন না স্যার। আপনাকে শেষ করতেই হবে। আপনার স্বপ্নের বীজ আমাদের ভিতরে আজ মহীরুহ হয়ে ডাল-পালা ছড়িয়ে গেছে। তাইতো মিরাক্কেলের মীর আলীর মতোই নেচে গেয়ে বলছি: আপনি থাকছেন স্যার! আপনি থাকছেন স্যার!! আপনি থাকছেন স্যার.... আপনি.... আপনি......আপনি থাকছেন স্যার
লেখাটি লিখেছিলাম ২০ শে নভেম্বর, ২০১১ রাত ১০:৪৯
আজ আবার লেখাটি একবার নয় বারবার পড়লাম। বিস্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিলো। আর আমার মেয়ে তা দেখে বলছিলো বাবা তুমি কান্না করছো কেনো? তুমি কান্না করলে আমিও কান্না করবো। জবাবে বললাম, কান্না কর মা, আজ সারা বাংলাদেশ কান্না করছে।
তবে মনে হলো এই শোক কি আমরা শক্তিতে পরিণত করতে পারি না? পারিনা সমস্ত হানাহানি দলাদলি পাশে রেখে বাংলাদেশে একটি বিশ্বমানের ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টার গড়ে তুলতে? না হোক এশিয়ার সেরা তারপরেও বিশ্বমানের ক্যানসারের চিকিৎসা দেশেই পাওয়া যাবে।
নাকি সেই হুজুগে বাংগালী হয়েই দুই দিন ব্লগ আর সামাজিক যোগাযোগ সাইটে মাতম তুলে তৃতীয় দিন থেকেই ভুলে যাবো???