সরকার অনলাইন ব্যবহারকারীদের নিয়ে খুব চিন্তা বা বলা যায় দুঃশ্চিন্তায় পড়েছে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ২০০৬ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনে সংশোধনী আনছে। একথা ঠিক যে ইন্টারনেটকেন্দ্রিক সাইবার অপরাধ পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একটি আইনী পরিকাঠামোর আওতায় একে মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু তা করতে গিয়ে জনগণের মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার ব্যাহত হবার উপক্রম হয়েছে। তাই এই সংক্রান্ত আইনপ্রণয়ন বা তার সংশোধনী আনয়নের পর আইনটির চেহারা যা দাঁড়াচ্ছে তা, কিছু অপরাধীকে শাস্তিপ্রদান নয়, আইনটি সামাজিক মাধ্যমে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে থাকা পুরো অনলাইন সমাজকে যেন নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে। প্রথাগত মূলধারার গণমাধ্যমে তথ্যের প্রবাহ একমুখী। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমগুলোতে দ্বিমুখী পদ্ধতিতে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া ঘটাচ্ছে। মানুষের এই পারস্পরিক যোগাযোগ মাঝে মাঝেই রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্ম দেয়। বিশ্বব্যাপী শাসকেরা তাই এই স্বাধীন মিথস্ক্রিয়াকে ভয় পেয়ে নিয়ন্ত্রণে আনতে চাচ্ছে।
তথ্যপ্রযুক্তি আইনে যেরকম পরিবর্তন আনা হচ্ছে তা দেখে এমন মনে করাই স্বাভাবিক। আগামী ১২ সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসবে। আইনটির সংশোধনী সংসদে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে করা যেত। কিন্তু গত ১৯ আগস্ট মন্ত্রিসভা অধ্যাদেশ আকারে সংশোধনীটি পাশ করেছে। আইন মন্ত্রণালয় এটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়া পাশ করলেই অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে আইনটির নামকরণ হবার কথা তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (সংশোধনী) অধ্যাদেশ ২০১৩। আশংকার বিষয় হলো, সংশোধনীতে কিছু গুরুতর সিদ্ধান্ত কার্যকর করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এতে কেবল ১০ বছরের সর্বোচ্চ সাজা বাড়িয়ে ১৪ বছরই করা হয়নি, সকল অপরাধ জামিন-অযোগ্য এবং সব অপরাধকেই আমলযোগ্য করবার প্রস্তাব করা হয়েছে। আমলযোগ্য অপরাধ কেউ করলে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তারের বিধান রাখা হয়েছে অধ্যাদেশে।
একজন ব্যক্তি দোষী সাব্যাস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাকে অপরাধী বলা যায় না। তাই কোনো অপরাধকে বিচারের পূর্বেই জামিন-অযোগ্য বলা যায় না। সাইবারপরিসরে যেমন অপরাধপ্রবণতা আছে, কিন্তু তার চাইতে বহুল পরিমাণে রয়েছে মানুষের স্বাধীনভাবে কথা বলবার চর্চা। স্বাধীন মতপ্রকাশ একটি গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ানির্ভর সাধারণ মানুষের এই মতপ্রকাশের সুযোগটি প্রায়শই সুশাসন দিতে ব্যর্থ সরকারের বিপক্ষে যায়। পৃথিবীব্যাপী সরকারগুলো তাদের শাসন ও সেবা আরও জনমুখী, উন্নত ও কার্যকর করার পরিবর্তে সামাজিক মাধ্যমের সদস্যদের মতপ্রকাশের বিষয়টিকেই বাধাগ্রস্ত করতে চাচ্ছে। প্রস্তাবিত আইনটির মধ্যে সেই লক্ষণ স্পষ্ট। অপরাধী ও সাধারণ ব্যবহারকারীকে এই আইন সমানভাবে দেখছে এবং যেকোনো বিরুদ্ধমতকে আমলযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ সরকারকে করে দিচ্ছে এবং এর শাস্তি জামিন-অযোগ্য পর্যায়ে রাখবার ব্যবস্থা করছে। একথা ঠিক বাকস্বাধীনতার অপব্যবহার করে অনেকে ব্যক্তি অবমাননা করে থাকেন, অপরের ক্ষতিসাধন করে থাকেন -- এইভাবে সম্ভাবনাময় একটি মাধ্যমকে কালিমালিপ্ত করে থাকেন। কিন্তু ব্লগার ও সামাজিক মাধ্যমের বেশিরভাগ ব্যবহারকারীই পরস্পরের যোগাযোগ, বন্ধুত্ব রক্ষা, সাহিত্যচর্চা, রাজনৈতিক ভাবনা বিনিময়ের জন্য এই মাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করে থাকেন। এটা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের অংশ। প্রস্তাবিত সংশোধনীটি কেবল মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকারই খর্ব করবে না, ব্যবহারকারীদের দৈনন্দিন চর্চাকেও বাধাগ্রস্ত করবে। তাই আইনের সংশোধনীটি পুনর্বিবেচনা করা দরকার। অনলাইন ব্যবহারকারীদের দমনের বিধিগুলো বাদ দিয়ে সংশোধনীটি চূড়ান্ত করার দাবি জানাই।