কিত্তনখোলা: বাঙালির সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের সন্ধানে
নদীতীরে আয়োজিত মেলায় নৌবহর নিয়ে এসেছে যাযাবর বেদে সম্প্রদায় যারা বিক্রি করবে চুড়ি-ফিতা-কবিরাজি ঔষধ। জুয়ার আসর বসেছে, দেশি মদও সহজলভ্য। মেলার প্রধান আকর্ষণ যাত্রাদল ‘আদি মহুয়া অপেরা’। স্থানীয় ঠিকাদার ও প্রভাবশালি ব্যক্তি ইদু কন্ট্রাক্টর মেলার ইজারা নিয়েছে। গ্রামের সহজ-সরল যুবক সোনাই মেলার টানে ঘুরতে ঘুরতে প্রেমে পড়ে যায় বেদে মেয়ে ডালিমনের। যাত্রাদলের অভিনেত্রী বনশ্রীবালাকে শয্যায় পেতে চায় আয়োজক ইদু। যাত্রাদলের মালিক সুবল দাস বনশ্রীবালাকে ইদুর কাছে পাঠাতে চায়। বাধা দেয় অভিনেতা রবি দাস। এতিম শিশু ছায়ারঞ্জনকে দলে স্থান দিয়েছিল সুবল, আবার সুবল ছায়ার ওপর যৌন নির্যাতনও করেছিল। তরুণ ছায়া জীবনের অভিশাপ ভুলে থাকতে চায় মদ খেয়ে। রবি ও ছায়া দুজনই বনশ্রীকে ভালবাসে, বনশ্রীও জীবনে থিতু হতে চায়। কিন্তু পতিতাপল্লী থেকে আসা যাত্রা অভিনেত্রীর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা হয়না। ইদুর লালসা এড়াতে আত্মহত্যা করে। সোনাইও ডালিমনকে পায়না, বেদেসমাজের কঠোর নিয়ম-অনুশাসনের কারণে। ইদুর লোকের প্ররোচনায় জুয়া খেলে ইদু সর্বস্ব হারায়। সোনাইয়ের বন্ধকের জমিটা এবার পুরোপুরি হাতে চলে আসবে ইদুর।
কিত্তনখোলা সেলিম আল দীন রচিত একটি সফল নাটক ছিল ঢাকার মঞ্চে। এই নাটকটি থেকেই সেলিম আল দীন পশ্চিমা নাট্যরীতি থেকে সরে এসে স্থানীয় নাট্য-আঙ্গিককে আশ্রয় করে নাটক লেখা শুরু করেন। এই নাটকটিতে সেলিম আল দীন যেমন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছেন তেমনি এই নাটকটির মধ্য দিয়ে গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামোর যে স্বরূপ, তার এক চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। আর প্রান্তিক সাধারণ মানুষ যে বিবর্তন ও রূপান্তরের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করে চলেছে, তার বিশ্বস্ত রূপায়ণ দেখা যায় কাহিনীতে। জীবনযাপনের নানান প্রতিকূলতা কীভাবে মানুষের আত্মপরিচয় ও পেশায় পরিবর্তন ঘটায় তার এক বয়ান কিত্তনখোলা চলচ্চিত্রে হাজির রয়েছে। প্রান্তিক বাংলায় শোষক বনাম শোষিত কিংবা জাতিগত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বিবর্তনশীল যে মানবজীবন, কিত্তনখোলা যেন বৃহত্তর সেই চিত্র আঁকে। সোনাই ‘শান্তিপুরে’ যেতে চেয়েছিল, কিন্তু ইদু তার সমস্ত সম্পত্তি গ্রাস করার পর বেদে-যুবা রুস্তমের সঙ্গে সে ‘দুখাইপুরে’ যেতে বাধ্য হয়। রুস্তম যাযাবর জীবন ছেড়ে ভূমিতে থিতু হতে চায়, সঙ্গী হিসেবে পেতে চায় ডালিমনকে। কিন্তু ডালিমন বেদে সমাজ ত্যাগ করতে চায়না, তা সে-সমাজ যতই অভিশপ্ত হোক না কেন। বনশ্রীবালা পতিতাপল্লী থেকে বেরিয়ে এসে যাত্রাদলের অভিনেত্রী হয়েছিল, কিন্তু শেষরক্ষা হয়না, ইদুর হাত থেকে বাঁচতে সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। রবি বা ছায়ার ভালবাসা তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনা। ছায়ারঞ্জন কখনো সংখ্যালঘু হিন্দু পরিচয় মুছে মুসলমান হয়ে যেতে চায়, কখনোবা কলকাতায় অভিবাসন করতে চায়। কিন্তু ছায়ারঞ্জনের ভাগ্যে শেষপর্যন্ত কী ঘটে তা আমরা জানতে পারিনা। শেষ দৃশ্যে আমরা একটা ওপেন এন্ডেড শটে দেখি ছায়া-সোনাই-রুস্তমেরা তাদের অজানা ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলে। জাতিগত ও পেশাগত ছোট ছোট গোষ্ঠীর হতভাগ্য মানুষেরা নানান ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করতে থাকে, কিন্তু জীবন থেমে থাকে না, চলে তার নিজস্ব গতিতে। আবু সাইয়ীদ চলচ্চিত্রায়ণের সময়ে মানুষের প্রত্যাশার বাইরে জীবনের এই লাগামহীন বয়ে চলাকে তুলনা করেছেন পাগলা ঘোড়ার সঙ্গে। চলচ্চিত্রের থিম সংগীতের মতো করে তিনি তিনবার ব্যবহার করেছেন এক পাঁচালি সংগীত: “আমার পাগলা ঘোড়া রে, কইর মানুষ কই লইয়া যাও?”
কেবল এই গানটিতে নয়, চলচ্চিত্রজুড়েই বাঙালির সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় বিধৃত রয়েছে। মেলার এক স্বল্পপরিসরে এবং কয়েকদিনের কাহিনীতে বাংলার সাংস্কৃতিক শেকড়ের বিশাল ক্যানভাসকে পাওয়া যায়। লেখকের সঙ্গে ২০০৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে কিত্তনখোলা সম্পর্কে আবু সাইয়ীদ বলেছিলেন, মাত্র তিন-চারদিনের ঘটনা, স্পেস অ্যান্ড টাইম সীমিত, কিন্তু গ্রামের অনেকগুলো পেশাজীবী মানুষের সমন্বয় হয়েছে এখানে। এছাড়া লোকজ সংস্কৃতির ক্রাইসিস ও কনফ্লিক্ট উঠে এসেছে। প্রত্যেকটি বিষয় কিন্তু বিশাল মাত্রায় ধরা হয়েছে। এই ব্যাপারটি আমাকে আকৃষ্ট করে, অল্প সময়ের মধ্যেই বিশাল ক্যানভাস ধরার সুযোগ আছে বিষয়টিতে। এত ছোট স্পেস ও টাইমের মধ্যে এরকম বিশাল ক্যানভাস ধরার সুযোগ আপনি খুব কম আর্ট পিস-এ পাবেন (সাইয়ীদ, ২০০৬)। আখ্যানে যাত্রাপালা, পাঁচালি ও বাউল গান, রূপকথার উপস্থিতি সমৃদ্ধ বাঙালি সংস্কৃতি ও দর্শনের পরিচায়ক হয়ে উঠেছে। নাট্যকার সেলিম আল দীন বলেন, এ নাটকের গঠন পদ্ধতিতে আমরা প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় পূজা উৎসবকেন্দ্রিক মৌখিকরীতির বাংলা নাটকের সম্ভাব্য আঙ্গিক ব্যবহার করতে চেয়েছি। এ ক্ষেত্রে ইউরোপীয় নাটকের প্রচলিত রীতির নাটকের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে আমাদের। বাংলা নাটকে দেশজরীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যসমূহ -- শাবারিদ খান-এর বিদ্যাসুন্দর -- শ্রীকৃষ্ণকীর্তন -- পাঁচালি -- যাত্রা ইত্যাদি ছিল আমাদের আশ্রস্থল (দীন, ২০০৬: ৩৩২)। সেলিম আল দীনের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট হয় যে কিত্তনখোলায় কেবল বাঙালির জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতিই উঠে আসেনি, বাঙালি জীবনের যে সাংস্কৃতিক অভিপ্রকাশ তাকেই নাটকের আঙ্গিক হিসেবে অবলম্বন করা হয়েছে।
গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামোর এক চিত্র কিত্তনখোলায় আমরা দেখতে পাই। ইদু কন্ট্রাক্টরকে আমরা দেখতে পাই একজন প্রভাবশালী ও ধনী ভূস্বামী হিসেবে যার মধ্যে অন্যের সম্পত্তি গ্রাস করার বৈধ ও অবৈধ প্রয়াস দেখা যায়। অন্যান্য জমির পাশে সোনাইয়ের জমিটা আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে তার কাছে; সোনাই জমি বিক্রি করতে রাজি না হলে ইদুর লোকেরা তাকে জুয়া খেলতে প্ররোচিত করে। সোনাই জুয়ায় হেরে ও ইদুর লোকের কাছে ঋণ করে, বাধ্য হয় ইদুর কাছে বন্ধকী জমিটা বিক্রি করতে। মেলার আয়োজকও ইদু কন্ট্রাক্টর। প্রতিপত্তি ও অর্থের বরাতে সে অভিনেত্রী বনশ্রীবালার ওপরে তার লালসা চরিতার্থ করতে চায়। স্থানীয় প্রশাসক শফিক চেয়ারম্যানের সঙ্গেও তার দহরম মহরম সম্পর্ক। সবমিলিয়ে এক ক্ষমতাকাঠামোর চিত্র আমরা দেখি যে ক্ষমতাকাঠামো প্রান্তিক সাধারণ গরিব মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে শোষণের এক জাল বিস্তার করে। তবে এই শোষণ একটা দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলতে থাকে। জমি বিক্রি করতে অস্বীকৃত সোনাইয়ের যে একরোখা অবস্থান, তাকেও এক যথার্থ চিত্রায়ণ বলতে হবে।
বনশ্রীবালা চরিত্রের মধ্য দিয়ে নারীত্বের দ্বান্দ্বিতকতা কিত্তনখোলার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। সুবল দাস বনশ্রীকে বেহুলা চরিত্রে অভিনয় করতে বললেও সে পছন্দ করে মনসা চরিত্রে অভিনয় করতে। মনসা হলো পূর্ববঙ্গের অনার্য দেবী, আর্য দেবতা শিবের সঙ্গে যার দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্বের খেসারত দিতে হয় বেহুলাকে, তার স্বামী লক্ষীন্দরকে সাপে কাটে বাসররাতে। কারণ তার শ্বশুর চাঁদবেনে মনসাকে পূজা দিতে রাজি নয়, তিনি শিবভক্ত। বেহুলার সতীত্ব ও স্বামীভক্তির জয় হয়, লক্ষীন্দরকে সে বাঁচাতে সমর্থ হয়, বিনিময়ে চাঁদবেনে মনসাকে পূজা করতে স্বীকৃতি জানায়। অন্যদিকে, দেবী হবার পরও মনসার জন্ম দুর্ভাগ্য নিয়ে, তার বাসররাতও ভেঙ্গে গিয়েছিল। পূজা পাবার ব্যাপারে তার দুর্মর আকাক্সক্ষা ও সংহার মূর্তি বনশ্রীকে আকর্ষণ করে। বনশ্রী মনসার সঙ্গে নিজের সাদৃশ্য খুঁজে পায়। বেহুলার সতীত্ব, সংসার, স্বামীভক্তি বনশ্রীর জীবনের সঙ্গে খাপ খায়না। সে এসেছে পতিতাপল্লী থেকে, সংসার করা তার সাজে না, ইদু কন্ট্রাক্টরের মতো লোকেরা তাকে বিছানায় নিতে চায়।
কিত্তনখোলা চলচ্চিত্রে সমীরন দত্তের ক্যামেরা বড় বেশি স্থির। জমজমাট মেলাপ্রাঙ্গনের কাহিনীতে আরও বেশি গতিশীল ক্যামেরা কাক্সিক্ষত ছিল। কোনো ক্রেন শট ছাড়াই মেলার ঘটনাবলিকে তুলে ধরা হয়েছে। সুনির্বাচিত ক্যামেরা অ্যঙ্গেল দিয়ে এই ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করা হয়েছে। রুস্তম ও ডালিমন কথা বলছে, তার পেছনে স্থির নদী, তারও পেছনে বাঁধ, সেই বাঁধের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মেলায় আগত লোকজন যার প্রতিফলন নদীর পানিতে -- এরকম দৃশ্য পরিকল্পনা মেলার আবহ ধরে রেখেছে। সেলিম আল দীনের নাটকের শেষে সোনাই, ছায়া, রুস্তমের ঘটনাগুলো আলাদা আলাদাভাবে (যেমন সোনই ইদুকে খুন করে) ঘটলেও চলচ্চিত্রে তাদের অনির্দিষ্ট হয়ে পড়া ভবিষ্যৎভাবনা এক দৃশ্যে এনে একটি ওপেন এন্ডেড শটে, ক্যামেরা প্যান করে সকলের দুর্ভাবনাকে একত্রে দেখানো হয়েছে। এটা চলচ্চিত্রকারের এক বুদ্ধিদীপ্ত নির্বাচন। সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে চলচ্চিত্রে সংযোজিত গান “আমার পাগলা ঘোড়া রে, কইর মানুষ কই লইয়া যাও...”, এই অনির্দিষ্টতাকে বোঝাতে লাগসই হয়েছে।
তথ্যসূত্র
দীন, সেলিম আল (২০০৬)। রচনাসমগ্র-২। ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স।
সাইয়ীদ, আবু (২০০৬)। গবেষণাকর্মের জন্য গৃহীত সাক্ষাৎকার।
রচনাকাল: ১২ আগস্ট, ২০১২
প্রথম প্রকাশ: ইত্তেফাক সাময়িকী, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১২।
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন
আত্মপোলব্ধি......
আত্মপোলব্ধি......
একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !
হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।
আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।
আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন