রুহুলের বাবা মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছে অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে, মা একটি এনজিওর কাছ থেকে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে গাভী কিনেছে, ছোট বোন ফাতেমা গার্মেন্টস শ্রমিক। পরিবারে আর আছে বৃদ্ধ দাদা। রুহুল নিজে ঝরে-পড়া মাদ্রাসার ছাত্র, বেকার অথচ নিরুদ্বিগ্ন। মাঝে মাঝে মামার সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে টুকটাক কম্পিউটার-ইন্টারনেট শেখে। বিস্ময়-যন্ত্রটিকে সে বাগে আনতে পারেনা, মামা বিরক্ত হয়। পাশে বসা এক তরুণ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। এভাবে তরুণ আরিফের সঙ্গে রুহুলের বন্ধুত্ব হয়। শ্মশ্রূমণ্ডিত ও সুশ্রী-স্মার্ট আরিফের সঙ্গে ইসলামের সঠিক পথ কোনটা, তা নিয়ে আলাপ করতে করতে রুহুল আরিফদের জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে পরিচিত হয়। আফগানিস্তান-কাশ্মির যুদ্ধে অংশ নেয়া মুজাহিদ ‘উর্দু ভাই’ তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেন।
জঙ্গিবাদের পাল্লায় পড়ে রুহুল বদলে যেতে থাকে। বোন ফাতেমার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চায়, টেলিভিশনে সংবাদ ছাড়া আর কিছু দেখা যাবে না। বোনের বান্ধবী শিউলীকে সে পছন্দ করতো, তার সঙ্গেও সে আড়ালে থেকে কথা বলে। মাকে নির্দেশ দেয় এনজিওর সুদের ব্যবসা থেকে সরে আসতে। ধার্মিক রুহুলের এই কট্টর রুহুলে পরিবর্তন পরিবারের সদস্যদের কেউই তেমন অনুমোদন করেনা। বরং পাল্টা প্রতিরোধের মুখোমুখি হয় ও তিরষ্কৃত হয়। ফলে রুহুল আরও ঘরবিমুখ হয়ে পড়ে।
ওদিকে আরিফরা সিনেমা হলে বোমা হামলা করে। জঙ্গিনেতা দাবি করে তাদের তৎপরতার কারণেই যাত্রা, মাজারের ওরশ-পালাগান বন্ধ হয়েছে। তিনি কোনো একটা এলাকা নিজেদের ‘মুক্তাঞ্চল’ ঘোষণা করে সেখানে শরিয়ত মোতাবেক প্রশাসনিক কার্যক্রম চালানোর ঘোষণা দেন। তবে তাদের ‘বাড়াবাড়ি’তে বিব্রত হয়ে সরকারের একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তি জঙ্গিদের ডেকে বকাঝকা করেন -- এইরকম বাড়াবাড়ি করলে যে আর ‘প্রটেকশন’ দেয়া যাবেনা, সেকথা স্পষ্ট করে বলেন। বিচারকদের যেন কিছু না করা হয় তা আলাদা করে নির্দেশ দেন। জঙ্গিনেতাও কর্তাব্যক্তির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন যে, তারা মুখে ইসলামী জাতীয়তাবাদের কথা বলেন আর দাতাদের মন যুগিয়ে চলেন। দাতাদের ভয়ে একটাও শরিয়তী আইন পাশ করতে পারেননি।
কিন্তু বিচারকদের ওপর আদালত প্রাঙ্গনে একটি গাড়িবোমা হামলা হয় এবং ঐ হামলায় গুরুতরভাবে আহত হয় আরিফ। টেলিভিশনের পর্দায় ক্ষত-বিক্ষত আরিফকে দেখে জঙ্গিরা ভাবে, হাসপাতালে একটু সুস্থ হলেই, আরিফ সব বলে দিতে পারে। তাই তারা সেই রাতেই সটকে পড়ে। কিন্তু রুহুল সেখানেই থেকে যায়। বন্ধু আরিফের এই পরিণতি রুহুল মানতে পারে না। তার ভাবান্তর হয়। নিজ সত্তার সঙ্গে তর্ক হয়। সে বাড়ি ফিরে আসে। ঘুম থেকে উঠে বিকেলে ঘরের বাইরে এসে বসে। সোনারঙা রোদে সে জীবনের প্রবাহ দেখে -- খালে জেলে মাছ ধরছে, পানিতে এক ঝাঁক হাঁস ভাসছে, পিঁপড়ের সারি দলবেঁধে দৈনন্দিন কাজে চলেছে, ফড়িঙ-প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে ঘাসে-গাছে। রুহুলের সবকিছু ভালো লাগে, সেই আগের জীবনকে নতুন করে ফিরে পায় সে। নবজন্ম লাভ করা রুহুলের মুখ দুধ দিয়ে ধুইয়ে দেয় রুহুলের মা।
সমকালীন বৃহত্তর ঘটনাবলীকে শিল্পে রূপায়ণ ঘটাতে গেলে এর সুবিধে এবং অসুবিধে দুটোই আছে। সুবিধা হলো ঘটনাবলীর টাটকা উপাদানগুলোর সমাবেশ ঘটানো সহজ, গবেষণার প্রয়োজন কমই পড়ে। আবার কল্পকাহিনী হবার পরেও তার একটা দালিলিক মূল্য থাকে। আর অসুবিধা হলো ঘটনার মধ্যে থাকার কারণে এর নির্মোহ মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়না। কালিক নৈকট্য এক্ষেত্রে বিশ্বস্ত ন্যারেটিভের বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু শিল্পীরা সেসব তোয়াক্কা না করেই সমকালকে তাদের কর্মে ধারণ করেন, এই তাগিদ থেকে যে তার কর্ম মানবিক-সামাজিক অগ্রগতিতে তাৎক্ষণিক অবদান রাখবে। অথবা তার কাজটি হতে পারে কেবলই তার ভেতরটাকে তোলপাড় করে দেয়া প্রতিক্রিয়ার ব্যক্তিগত প্রকাশ মাত্র। শিল্প ও দর্শনের সর্বজনীন ও সর্বকালীন আবেদন রাখতে চায় চলচ্চিত্র। কিন্তু তার বাইরে এসে তা প্রায়ই গণমাধ্যম হিসেবে সমাজে ভূমিকা রাখতে চায়। সমকালীন সঙ্কটকে ধারণ করে রানওয়ে সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
তবে ছবিতে যে-বিষয়গুলোকে তুলে আনা হয়েছে সেগুলো সাধারণত ‘স্পর্শকাতর’ বিষয় বলে বিবেচিত। গার্মেন্টসে শ্রমশোষণ ও শ্রমঅসন্তোষের কথা আছে, ফাতেমার বেতন দুই মাস বন্ধ ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে মুসলিম ভাইদের দ্বারা বাংলাদেশী শ্রমিকদের নিষ্পেষণের কথা আছে। শক্তিমান এনজিওর ক্ষুদ্রঋণের উচ্চসুদের কিস্তি শোধের চাপাচাপির কথা আছে -- গরুর দুধ বেচে নয়, মা কিস্তি শোধ করে মেয়ের বেতন থেকে। টেলিকম কোম্পানির কলরেট নিয়ে ধাপ্পাবাজির কথা আছে। আর আছে মাদ্রাসার গরিব ছাত্র রুহুলের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার কথা। শেষোক্ত বিষয়টিই সবচেয়ে স্পর্শকাতর -- ইসলামের প্রকৃত পথ কোনটি, তা নিয়ে রুহুলের মতো সব মুসলমানই কমবেশি বিভ্রান্ত। বাঙালি মুসলমানদের বরাবরই তাড়িয়ে বেড়িয়েছে করেছে ঐ মৌলিক প্রশ্নটি, যে সে প্রথমত বাঙালি না মুসলমান? জটিলতার মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলেছে ৯/১১ ঘটনা, যার সূত্র ধরে, সন্ত্রাস দমনের নামে, আফগানিস্তান-ইরাকের মুসলমানদের ওপরে আগ্রাসন চালিয়েছ ইহুদি-খ্রিস্টান সমরপতিরা। বৈশ্বিক মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা, ‘ক্ষতিকর’ পশ্চিমা সংস্কৃতি-বিরোধিতা আর ইসলামী জঙ্গিবাদ -- আজ সব একাকার হয়ে গেছে। সন্ত্রাসদমনের অভিযানকে আমরা দেখছি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনরূপে যার নেপথ্যে রয়েছে স্থানীয় খনিজসম্পদকে করায়ত্ব করার অভিলাস। মুসলিম জঙ্গিবাদ তাই দমন হচ্ছে না, ডালাপালা মেলে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ২০০৫-০৬ সালে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের পেছনে এই আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটা স্পষ্ট যোগ আছে, স্থানীয় রাজনীতির ঘোরপ্যঁচের সঙ্গে মিলে তার একটা স্থানীয় গ্রহণযোগ্যতাও তৈরী হয়। বঙ্গে ইসলামের যে নানা প্রকরণ, তার মধ্যকার এতদিনে যে স্পষ্ট সীমারেখা, আজ যেন অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বঙ্গদেশে ঐতিহাসকভাবে আমরা ইসলামের তিনটি প্রকরণ দেখতে পাই -- সুফি ইসলাম, শাস্ত্রীয় ইসলাম ও রাজনৈতিক ইসলাম। ত্রয়োদশ শতকে তুর্কী বখতিয়ার খলজির অসিসহযোগে বঙ্গবিজয়ের আগেই ইরানি সুফি-সাধক-দরবেশরা এদেশে ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন, এবং সফল হয়েছিলেন। প্রকৃত ইসলাম অদ্বৈতবাদে বিশ্বাসী এবং এখানে খোদা ও বান্দার সম্পর্ক প্রভু ও দাসের। কিন্তু সুফিরা দ্বৈতবাদে বিশ্বাস করে যেখানে খোদা ও বান্দার সম্পর্ক ভালোবাসার। সুফিসাধনার একটি পর্যায় হলো ‘ফানা’, যেখানে খোদা ও বান্দা লীন হয়ে যায়। বঙ্গে এই সুফি ইসলামই জনপ্রিয় হয়, মুসলিম শাসকদের পাশাপাশি পীর-দরবেশরা সমাজে যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিলেন। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দিতে সর্বভারতে ওয়াহাবী এবং বঙ্গে ফরায়েজী এবং তৎসদৃশ কিছু ইসলামী সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে প্রকৃত আরব-ইসলাম মুসলমান সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়। কোরআন-হাদিসভিত্তিক শাস্ত্রীয় ইসলাম সর্বসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আরব ইসলামের দাপটে সুফি ইসলাম কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতি, ব্রিটিশ সরকারের নানা নীতি, প্রাধান্যশীল হিন্দুত্ববাদ ইত্যাদি কারণে বিংশ শতাব্দির প্রথমভাগে মুসলিম লীগের মাধ্যমে জন্ম নেয় রাজনৈতিক ইসলামের। আধুনিক বাংলাদেশে আমরা রাজনৈতিক ইসলামের প্রতিনিধি হিসেবে জামাত-ই-ইসলামীর মতো দলকে দেখতে পাচ্ছি। ৯/১১-এর পরে আফগানিস্তান-ইরাকে আগ্রাসনের পরে, সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতায় প্রাণিত হয়ে, জেএমবি, হরকাতুল জিহাদসহ আরও অনেক ছোট ছোট দল আত্মপ্রকাশ করে যারা জিহাদের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে বাংলাদেশে ইসলামী শরিয়া আইন বা শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। এরাই জঙ্গি নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। সুফি ইসলামের অনুসারীরা মাজারভিত্তিক পীর-মুর্শিদ-মুরিদ সম্পর্ক ও তার চর্চার মাধ্যমে নিজিদের ব্যাপৃত রাখে, বাউলমতের মধ্যেও সুফিবাদের বহুল প্রভাব রয়েছে। আর সমাজের সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে আমরা শাস্ত্রীয় ইসলামের অনুসারীদের সহজেই খুঁজে পাবো। ঐতিহাসিক নানা ঘটনাক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, এই তিন ধরনের ইসলাম-অনুসারীদের মধ্যেই ভাবনা ও কর্মপরিধিতে স্পষ্ট পার্থক্য এতদিন ছিল। তারেক মাসুদের অপর ছবি মাটির ময়নায় আমরা এই তিন ইসলামের অনুসারীদের খুঁজে পাই -- বড়ো হুজুর ছিলেন জিহাদী বা রাজনৈতিক ইসলামের অনুসারী, ইব্রাহিম হুজুর ছিলেন সুফি ইসলামের অনুসারী আর কাজী ছিলেন শাস্ত্রীয় ইসলামের অনুসারী। ঐতিহাসিকভাবে সমাজে সুফি ও রাজনৈতিক ইসলাম পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থেকেছে। শরিয়া ও মারফতের বিতর্ক আমাদের চেনা। মাটির ময়নায়ও আমরা শরিয়া ও মারফতের বিতর্ক দেখেছি এবং সেখানে মারফত বা সুফি ইসলামকে জয়লাভ করতে দেখেছি।
তবে রাজনৈতিক ইসলাম যেহেতু জিহাদ বা বলপ্রয়োগের পক্ষপাতী, তাই সা¤প্রতিক জঙ্গি-কার্যক্রমে দেখেছি যে তারা সুফি ইসলামের কার্যকলাপ বলপ্রয়োগ করে বন্ধ করতে চেয়েছে। মাজারে বোমা হামলা হয়েছে, বাউলদের অনুষ্ঠান তারা বন্ধ করে দিয়েছে। দীর্ঘদিন যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হয়নি। তাদের কর্মপরিধির আওতায় অন্যান্য বিষয় ছিল উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গে মাওবাদী সর্বহারাদের হত্যা করা, ইসলামমতে অপসংস্কৃতির আখড়া সিনেমা হলে হামলা করা এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রতীক বিচারব্যবস্থার ওপরে হামলা করা। রানওয়ে ছবিতে এইসব প্রসঙ্গই এসেছে, ভালোমতোই এসেছে। এখন এই জঙ্গি কার্যক্রমে কারা যুক্ত? জঙ্গিনেতা হিসেবে আছে আফগানিস্তান-কাশ্মিরে যুদ্ধ করা উর্দু ভাইয়ের মতো উগ্রবাদী, ধর্মান্ধ মানুষ। কিন্তু সেটাই সব নয়। আরিফের মতো স্মার্ট, প্রযুক্তি-দক্ষ তরুণরাও এতে যুক্ত আছে। কারণ বুদ্ধিদীপ্ত এই তরুণ একটি আদর্শ খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে ভীড়েছে। সমাজতন্ত্রের পতন ঘটেছে, সাম্রাজ্যবাদের থাবা আজ যখন মুসলমানদলনের সমার্থক হয়ে উঠেছে, তখন প্রতিরোধকারী প্যালেস্টাইন-যুবক, তালেবান-যোদ্ধা তার প্রেরণা হয়ে উঠছে। আর আছে রুহুলের মতো আধুনিক শিক্ষাবঞ্চিত, মাদ্রাসা থেকে ঝরে-পড়া, গরিব-বেকার তরুণরা। জঙ্গিবাদের তীব্র মতবাদ আদর্শবাদী এইসব তরুণ একটা আদর্শের সন্ধান দেয়, আবার অর্থেরও যোগান দেয়। জেহাদি জোশ তাদের বিবেচনাবোধ, বিচারবুদ্ধিকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার অন্ধত্বে আচ্ছন্ন করে। আরিফের জঙ্গিবাদে জড়ানো স্বেচ্ছাকৃত, রুহুলের জন্য ব্যাপারটা তা নয়। আরিফদের ফেরানো কঠিন। কিন্তু রুহুলদের ফেরানো সম্ভব। তারেক মাসুদ রানওয়েতে রুহুলকে ফিরিয়ে এনেছেন, হয়তো ইসলামের প্রকৃত পথের সন্ধানে ব্যাপৃত রুহুলকে তার আদর্শ থেকে পুরোপুরি ফেরানো যায়নি, কিন্তু রুহুল ফিরে এসেছে জীবনের কাছে। সে এটা অন্তঃত বুঝতে পেরেছে যে, ঐ পথ ইসলামের প্রকৃত পথ নয়। ঐ পথে আরিফের মতো বন্ধুকে বা তার নিজেকে সবসময়ই জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে নিরলম্ব ঝুলে থাকতে হয়।
আদর্শের বিচারে পরিচালক তার মতটি স্পষ্ট করেছেন যে রুহুলদের পথ ভ্রান্ত, এবং তাদের ফেরানো দরকার। আধুনিক গণতান্ত্রিক চেতনা, মানবতাবোধ ও বিদ্যমান আইনের বিচারে যুক্তিমনষ্ক যেকেউই তাই বলবে। কিন্তু রুহুল কী কী কারণে ঐ পথে আকৃষ্ট হয়েছে বা হতে পারে, তার সবধরনের প্রেক্ষাপট বা যুক্তির ডালপালাকে পরিচালক মেলতে দিয়েছেন। জিহাদের পক্ষপাতী হুজুর তাই বলছেন, কোরানে নামাজের জন্য আয়াত মাত্র ৮২টি, সেইখানে জিহাদের জন্য আছে ৬৮১টি। অর্থাৎ রুহুলের মতো কোরান-সুন্নাহরভক্ত একজন, যে দ্বীনের সহি রাস্তা খুঁজছে, তার জন্য জিহাদের শাস্ত্রীয় একটা অনুমোদন আছে। আবার রাজনৈতিক ইসলামের চর্চাকারী দল জামাত-ই-ইসলামের ওপরও আরিফরা তুষ্ট নয়। আরিফের সঙ্গে তার স্ত্রীর বিচ্ছেদ হয়েছে এই মতাদর্শিক কারণে, যে স্ত্রীর দল ঠিকই জানে ইসলাম এবং গণতন্ত্র পরস্পরবিরোধী, অথচ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকার পরিচালনায় অংশ নিয়ে তারা হিপোক্রিসি করছে। হুজুর বলেছেন, পশ্চিমা গণতন্ত্রের লেবাশ গায় দিয়া ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের মিথ্যা ওয়াদার মদ্যেও কোনো সুরাহা নাই। অতএব ঐ দলটির পথে ইসলামের মুক্তি হবে না। রাজনৈতিক ইসলমের অনুসারীদের মতভেদ, জঙ্গিবাদের প্রসারের একটা কারণ। তবে উদীয়মান জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর বৃদ্ধির পেছনে প্রশাসনিক সমর্থনও ছিল। বিশেষত ২০০৫-০৬ সময়কালে জঙ্গিবাদীদের জন্য তৎকালীন সরকারের একটা অংশের সমর্থন ছিল। ছবিতে তাও স্পষ্ট করা হয়েছে। পাশাপাশি ঐ সমর্থন কতদূর পর্যন্ত থাকবে, তা নিয়ে সমর্থিত ও সমর্থনকারী পক্ষের মধ্যে টেনশনও ছিল। কারণ জঙ্গিরা ‘বাড়াবাড়ি’ করছিল, এবং বিচারকদের ওপরে হামলা হলে যে সমর্থন উঠিয়ে নেয়া হবে, সেই ধমকও সরকারপক্ষীয় নেতাকে জঙ্গিদের দিতে দেখা গেছে। ব্যক্তি-জীবনে রুহুলরা সুবিধাবঞ্চিত ও নিগৃহীত শ্রেণীতে বাস করে। শ্রেণীগত নিগৃহের কথাও পরোক্ষভাবে এসেছে। রিকশা-আরোহী রুহুল একবার দেখে যে, সামনের প্রাইভেট কারটি হঠাৎ ব্রেক কষায় রিকশাটি কারের গায়ে আঘাত করে। এতে কারমালিক রিকশাঅলাকে প্রহার করে। রুহুল তার প্রতিবাদ জানায়। ফলে সেও প্রহৃত হয়। এই শ্রেণীপ্রাধান্য রুহুলের মনে খানিক হলেও ভাবান্তর আনে -- যে রিকশাঅলার ত্রুটি না থাকার পরও মার খায়, আবার প্রতিবাদ করার কারণে সে নিজেও মার খায়। তাই রানওয়েতে উড়ে যাওয়া প্লেনের দিকে ছোট্ট ছেলেটা গুলতি ছুঁড়ে মারলে সে খুশি হয়। তার বোনও শ্রেণীবঞ্চনার শিকার। কিন্তু কেবল বঞ্চিত হওয়াই নয়, বঞ্চনার প্রতিবাদের কথাও এসেছে। ফাতেমা বলে, জুলম তাকলে মারামারি থাকপেই দাদা। আমাগো গার্মেন্টে বাংচুর হয় টিবিতে খালি হেইটেই দেহায়। কিন্তু আমাগো মাত্র পনেরশ টাহা ব্যাতন দিয়া মালিকরা যে কত লাক টাহা লাব করতেছে হেইডা তো দেহায় না। এইসব ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত এবং বৃহৎ আদর্শগত কারণ রুহুলদের জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দেয়। জঙ্গিবাদ তাকে ক্ষমতা ও শক্তি যোগায়। আরিফ এখানে একজন অনুঘটক মাত্র। আরিফের দেয়া তথ্যও রুহুলের জন্য একটা বাড়তি উসিলা যে, সারা দুনিয়ার কাফেররা মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণ করতেছে। মুসলমানরা আজ তাদের সহি রাস্তা হারাইয়া পদে পদে হোঁচট খাইতেছে। এই সমসাময়িক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মুসলমানদের বিশেষ উপস্থিতি, এর সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের যে-যোগ, সেবিষয়গুলো ছবিতে আরও খানিকটা স্পষ্টভাবে উঠে আসতে পারতো।
ছবির শেষটা একটু বেশিমাত্রায় মিলনাত্মক, যা ছবির মূলসুরের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এটা কেবল রুহুলের ফিরে আসার মধ্যেই সীমিত নয়। রুহুলের সাইবার-ক্যাফে ব্যবসায়ী মামাকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করেছিল, এটা একটা সন্দেহমূলক অন্যায় গ্রেফতার ছিল। ছবির শেষের দিকে তার ছাড়া পাবার তথ্য জানা যায়। ফিরে আসার পরে রুহুল জানতে পারে তার গোপন-প্রেমিকা শিউলি একটা বাজে-বিয়ে এড়াতে মেসভাড়া করে স্বাধীন জীবনযাপন করছে। অপ্রয়োজনীয় ছিল রুহুলের বাবার ফিরে আসা। যে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে বহুদিন কোনো খবর দেয়নি, যে প্রতারিত হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ইরাকে অভিবাসন করেছে, ঝলমলে-সুখীবেশে তার হঠাৎ ফেরাটা কাহিনীর সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হয়নি। আর অতি-দীর্ঘ হয়েছে মায়ের, ফিরে-আসা রুহুলের মুখ, দুধ দিয়ে ধুয়ে দেবার দৃশ্যটি। রিচুয়ালটি খুব বেশি পরিচিতও নয়।
রানওয়ে ছবির সম্পদ হলো এর সিনেমাটোগ্রাফি। প্লেনগুলো ওঠানামা করার ক্ষেত্রে মিশুক মুনীরের ক্যামেরার মুন্সিয়ানা দর্শকের চোখে পড়বেই। রুহুলের ফিরে আসার পর উঠোনে বসে যখন সে চলমান জীবনকে দেখছে, তখন ক্যামেরার যে-ডিটেইলকে তুলে ধরে, তা অসাধারণ। ছবির প্রথম দিকে, প্লেনের ল্যান্ডিংয়ের সময় ঝুপড়ি ঘরের দেয়ালে দুর্বল তাকে রাখা এনামেলের গ্লাসের কেঁপে ওঠা এবং দাদার দৈনন্দিনের ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার শটটি সহজেই প্রমাণ করে যে এই ঘর, এই পরিবার, বিশাল রানওয়ের ও দানবীয় উড়োজাহাজগুলোর নিচে কত দুর্বল ও অসহায়। অন্তর্যাত্রা থেকে রানওয়ে -- ডিজিটাল ক্যামেরায় চলচ্চিত্রকে ধারণ করার ক্ষেত্রে একটা উল্লম্ফন দেখা গেল। অন্তর্যাত্রার ডিভি ক্যামের ফুটেজ ৩৫ মিমি- এ ট্রান্সফার করার পর ইমজের মান সন্তোষজনক পাওয়া যায়নি -- একটা বাড়তি লেয়ার পর্দায় ধরা পড়েছিল, ডেপথ অব ফিল্ডও সন্তোষজনক ছিলনা। কিন্তু উন্নত এইচডিভি ক্যামেরায় ইমেজের যে-মান পাওয়া গেল তার সঙ্গে ৩৫ মিমি ফরম্যাটের খুব বেশি পার্থক্য থাকেনি। সেদিন আর বেশি দূরে নেই যে, পরিচালকরা আর কখনোই ব্যয়বহুল ৩৫ মিমি ক্যামেরা ব্যবহার করবেন না।
মাটির ময়না বা অন্তর্যাত্রার তুলনায় এই ছবির আবহসংগীত সাধারণ ঠেকেছে। তবে ডলবি ডিজিটাল শব্দের ব্যবহার ছবিতে লাগসই মনে হয়েছে। বিশেষত প্লেনের ওঠানামার সময় শব্দের যে তীব্রতা ও গভীরতা প্রয়োজন, তা ভালোভাবেই পাওয়া গেছে। ক্যাথরিন মাসুদের সম্পাদনা বরাবরের মতোই ঠাসবুনোটে প্রাপ্ত -- কেবল দুধ দিয়ে মুখ ধোয়ানোর দীর্ঘ দৃশ্যটি ছাড়া। রুহুল একটি স্বপ্নদৃশ্যে দেখে যে ট্রলিতে করে গুরুতর আহত আরিফকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি হাসপাতালের করিডোরের ছাদের একটি লং টেক, স্লো মোশনে। লাইটগুলো একের পর এক দেখা যাচ্ছে, ফ্রেমে আলো-আঁধারির বৈপরীত্য খেলা করছে। ধরে নেয়া যায়, এটা আরিফের পয়েন্ট অব ভিউতে দেখানো হচ্ছে, যেহেতু সে শুয়ে আছে ট্রলিতে, তার পক্ষেই কেবল ছাদে লাইটের উপস্থিতি-অনুপস্থিতিকে বা জীবন-মৃত্যুর দোলাচলের সন্ধিক্ষণকে অনুভব করা সম্ভব। কিন্তু গুরুতর আহত অবস্থায়, আরিফকে আমরা অচেতনই দেখি। তার পয়েন্ট অব ভিউ থেকে এই টেকটি নিলে তা একটা ত্র“টিপূর্ণ সিদ্ধান্ত -- সিনেমাটোগ্রাফি ও সম্পাদনা উভয় বিবেচনাতেই।
অপেশাদার অভিনেতা নির্বাচনের কারণে রানওয়ের চরিত্রগুলো বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছে। রুহুলের মামার চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, আর দাদার চরিত্রে নাজমুল হুদা বাচ্চু। একটি দৃশ্যে আরিফের স্ত্রীর ভূমিকায় দেখা গেছে নুসরাত ইমরোজ তিশাকে। এই তিনজন ছাড়া, প্রধান চরিত্রে অভিনয়কারী বাকি সবই অচেনা মুখ। রুহুলের মার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন রাবেয়া আক্তার মনি, যাকে এর আগে নাল পিরান টেলিছবিতে দেখা গিয়েছিল। আর মাটির ময়নার বড়ো হুজুর মোছলেমুদ্দিন অভিনয় করেছেন জঙ্গিনেতা উর্দু ভাইয়ের চরিত্রে। রুহুলের ভূমিকায় ফজলুল হক, আরিফের ভূমিকায় আলী আহসান, ফাতেমা ও শিউলির চরিত্রে নাসরিন আক্তার ও রিকিতা নন্দিনী শিমু -- এরা সবাই অপেশাদার এবং প্রথম বারের মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তারা বাস্তব জীবনে যে-শ্রেণীতে অবস্থান করেন, ঠিক সেরকম চরিত্রেই তারা অভিনয় করেছেন। আর পরিচালকের সাফল্য এখানেই যে তাদের কাছ থেকে যথাযথ অভিনয় বের করে নিয়ে এসেছেন। এদের মধ্যে সবচাইতে উজ্জ্বল ছিলেন আরিফের চরিত্র রূপদানকারী আলী আহসান।
আগেই বলেছি রানওয়ে সমকালের ছবি। এতটা সমকালীন ফিকশন ছবি বাংলাদেশে, সম্ভবত, আর নির্মিত হয়নি। সমকালীন বিষয়গুলোকে, বিশেষত জঙ্গিবাদকে বুঝতে এই ছবি সাহায্য করবে। কারণ জঙ্গিবাদের একতরফা নির্মাণ এখানে হয়নি, বরং জঙ্গিবাদী মানুষগুলোর সব যুক্তিকে এখানে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে, তারপর খণ্ডন করে বলা হয়েছে যে ঐ পথ অযৌক্তিক, আইন-অসিদ্ধ, মানবতাবিরোধী ও ভ্রান্ত। এই সংবেদনশীলতাই এই ছবির শক্তি। এই ছবির বহুল প্রচার দরকার, প্রথাগত কয়েকটি এলিট সিনেমা হলে যেমন এর মুক্তি হবে, অপ্রথাগত বা বিকল্প চ্যানেলেও সব ধরনের মানুষের কাছে এটা পৌঁছা দরকার। যাদের জঙ্গিবাদী হবার সম্ভাবনা নেই, যারা ধর্মীয় সংস্কারের দূরে অবস্থান করেন, ঢাকা শহরের কেবল সেই গুটিকয়েক সামাজিক-সাংস্কৃতিক এলিট মানুষই যদি কেবল এই ছবি দেখার সুযোগ পায়, তবে তা একটা পরিহাসের বিষয় হবে। কারণ, চলচ্চিত্র এখানে শিল্পমাধ্যমের চেয়ে গণমাধ্যমের ভূমিকায় অবতীর্ণ। তার মানে এই নয় যে, রানওয়ের শিল্পমূল্য নেই।
২২ অক্টোবর, ২০১০
প্রথম প্রকাশ: Click This Link