পর্ব ১
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে বসবাসকারী বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয় অনুসন্ধান করতে গেলে পাওয়া যাবে তিনটি ধারা -- বাঙালিত্ব, মুসলমানিত্ব ও লোকধর্ম। বাঙালিত্ব হলো এই মানুষগুলোর জাতিগত পরিচয়, মুসলমানিত্ব হলো ধর্মীয় পরিচয় এবং লোকধর্ম হলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চর্চিত গৌনধর্মসমূহ।
বাঙালি মুসলমানের কাছে এই দ্বৈধতার প্রশ্নটি বরাবরই ঘুরেফিরে এসেছে যে আমি মূলত কে, বাঙালি না মুসলমান? বাঙালিত্বে বিশ্বাসী যে সে তার মুসলমানিত্ব খারিজ করতে পারলে যেন বাঁচে, আর মুসলমানিত্বে যে বিশ্বাসী, সে মনে করে বাঙালিপনা হলো হিন্দুয়ানি ব্যাপার। অথচ দুটোরই এমন জাতিগত ও ঐতিহাসিক সত্যতা আছে যে কোনোটিকেই পুরোপুরি বাদ দেয়া চলেনা, সম্ভবও নয়। এই অঞ্চলের 'মুসলমানের' জীবনযাপনে যেমন কিছু হিন্দুয়ানি/বাঙালি ব্যাপার ঢুকে গেছে, তেমনি 'বাঙালি'কেও বহির্বিশ্বে মুসলমান পরিচয় বয়ে নিয়ে বেড়াতে হচ্ছে, তা সে ইসলামের চর্চা করুক আর নাই করুক। নাইন ইলেভেনের পর এখন তা এক জটিল রূপ পেয়েছে। তবে লোকধর্ম চর্চাকারীর কাছে এই বিতর্ক অহেতুক মনে হতে পারে। কারণ সে এমন দার্শনিক চিন্তার ও মানবিক ভাবনার পর্যায়ে বিরাজ করে যে, এই বিতর্ককে তার কাছে কৃত্রিমভাবে বানিয়ে-তোলা শিক্ষিত মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চামাত্র মনে হবে।
আমাদের আত্মপরিচয়ের ডিসকোর্সকে ঘিরে বাঙালিত্ব ও মুসলমানিত্বের বিতর্ককে নিয়ে বহু দিস্তা কাগজ ব্যয় হয়েছে, কিন্তু লোকধর্মের বিষয়টিকে এই আলোচনায় অনুপ্রবেশের অনুমোদন দেয়া হয়নি। এই রচনায় বাঙালিত্ব ও মুসলমানিত্বের বিষয়টি ছাড়াও লোকধর্মকে গুরুত্ব দিয়ে বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। লোকধর্মের বিষয়টিকে এই আলোচনায় যুক্ত করতে পারলে যেমন আত্মপরিচয়ের বিষয়টি ভিন্ন মাত্রা পায় তেমনি একটি সমাধানিক একটা জায়গাও পৌঁছা সম্ভব।
বাঙালিত্ব
বাঙালিত্ব হলো আমাদের বাংলা ভাষাভিত্তিক এক জাতিগত পরিচয় যা আসলে আমাদের প্রাথমিক পরিচয়ই বটে। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এজন্যই বলেছিলেন যে মা-প্রকৃতি আমাদের চেহারায় এমন এক ছাপ মেরে দিয়েছে যে টিকি-পৈতা বা দাড়ি-টুপি-লুঙ্গির বাহ্যিক চিহ্ন দিয়ে তাকে লুকানো সম্ভব নয়। তবে বাঙালিত্বের এই জাতিগত পরিচয়টি পূর্ণ রূপ পেয়েছে, ঐতিহাসিক বিচারে, খুব বেশি দিন নয়। গোলাম মুরশিদের (২০০৬) পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যাচ্ছে: ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকের আগে সত্যিকারের বাংলা ভাষা বিকাশ লাভ করেনিভ চতুর্দশ শতকের আগে অখণ্ড বঙ্গদেশ গড়ে ওঠেনি। আর এই অঞ্চলের লোকেরা বাঙালি বলে পরিচিত হননি আঠারো শতকের আগে।
এই সময়কালের পূর্বে এই অঞ্চল বরেন্দ্র, সমতট, বঙ্গ, হরিকেল এরকম কয়েকটি জনপদে বিভক্ত ছিল এবং অধিবাসীরা জনপদ অনুসারেই পরিচিত হতো। আর উত্তর ভারতে আর্যরা খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার বছর পূর্বে আসলেও দূরবর্তী পূর্ব ভারত বা এই অঞ্চলে তারা আসে অনেক পরে। এই অঞ্চলের অনার্য লোকজন তাদের কাছে 'বর্বর'রূপেই পরিচিত ছিল। খ্রিস্টের জন্মের মাত্র কয়েকশ বছর আগে, মৌর্য আমলে (৩২১-১৮১ খ্রি.পূ.) আর্যপ্রভাব অনুভূত হয়। কিন্তু আর্যদের ধর্ম ব্রাহ্মণ্যবাদ তখনও এই অঞ্চলে বিস্তার লাভ করতে পারেনি, এই অঞ্চল তখন ছিল বৌদ্ধদের অঞ্চল। পরবর্তী সময়ে পাল আমলে (৭৫০-১১৬১) বৌদ্ধধর্মের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে। আর ১১৬১ সালে দাক্ষিণাত্য থেকে আসা সেনরা বাংলা দখল করে এবং বৌদ্ধদের হত্যা করে ও তাড়িয়ে দেয়। তবে এই হত্যাযজ্ঞের আগ পর্যন্ত এই অঞ্চলে বৌদ্ধ ও হিন্দুরা পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতো। পালরা হিন্দু দেবতা শিব ও বিষ্ণুর পৃষ্ঠপোষণা করতো। তবে সেনরা শ্রেণীভেদপ্রথাসমেত রক্ষণশীল হিন্দুমত প্রতিষ্ঠা করে। বেঁচে থাকা বৌদ্ধরা উত্তর ভারত বা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে পালিয়ে যায় অথবা হিন্দু পরিচয় গ্রহণ করে এখানেই থেকে যায়।
তুর্কী সেনা বখতিয়ার খিলজি দুর্বল সেনশাসক লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বঙ্গবিজয় করেন ১২০৪ সালে। কিন্তু তার আগমনের পূর্বেই আরবরা বাণিজ্যের লক্ষ্যে এদেশে আসতে শুরু করে নবম শতক থেকে। আর আসতে থাকেন ধর্মপ্রচারক দরবেশরা। এই পীর-দরবেশরা অবশ্য আরব নয়, আসেন ইরান ও মধ্য এশিয়া থেকে। তারা সঙ্গে নিয়ে আসেন অবিকৃত আরব-ইসলাম নয়, পারস্য সুফিমত প্রভাবিত ইসলাম। যাহোক এই সুফিদের শান্তির বাণী, সমাজসেবা বর্ণভেদে বিন্যস্ত হিন্দুসমাজের নিচুতলার মানুষদের আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট হয়। আবার হিন্দুত্বের পরিচয়ে লুকিয়ে থাকা পাল আমলের বৌদ্ধরা ইসলামের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। বখতিয়ার-পরবর্তী সুলতানী আমলে এই প্রবণতা বেগবান হয়। বখতিয়ার-পরবর্তী পাঁচশ বছরের মুসলমান-শাসনকালে (সুলতানী ও মোগল সুবা) এই অঞ্চলে হিন্দু ও মুসলমানরা শান্তিপূর্ণভাবে ও অসাম্প্রদায়িক রীতিতে পাশাপাশি বসবাস করতো। সত্যি বলতে, সেনদের বৌদ্ধবিতাড়ন ছাড়া প্রাচীনকাল থেকেই এদেশের মানুষ সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে বসবাস করার সুযোগ পেয়েছে -- সাম্প্রদায়িকতা নামক বস্তুটির সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছি ব্রিটিশ আমলে। শাসকদের উদারতার পাশাপাশি, মূল কারণটা হলো এই যে বৌদ্ধ, হিন্দু ও ইসলাম, এই তিন ধর্মই অবিকৃত রূপে এখানে চালু হয়নি। বরং অনার্য সংস্কৃতির সঙ্গে মিলে তিন ধর্মেরই একটা বঙ্গীয় চেহারা পেয়েছে। বলা যায় তিন ধর্মেরই সহনশীল বা উদার রূপটি বাংলায় বিকশিত হয়েছে।
পর্ব ২
আর্যরা যখন এদেশে সত্যিকারের প্রভাব ফেলতে পারলো ততদিনে দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তা খানিকটা বদলে যায়, অনার্য সংস্কৃতির মিশেলে তা বঙ্গীয় আর্য বা ব্রাহ্মণ্যরূপ লাভ করে। বৌদ্ধ ধর্মের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। বৌদ্ধ ধর্মের হীনযান ও মহাযান এই দুই যে ধারা, তার মধ্যে বঙ্গে মহাযান ধারাটি এখানে গৃহীত হয়, যা আবার বৌদ্ধ ধর্মের সহনশীল ও উদারপন্থী ধারা। মহাযান ধারাটি সহজযানে রূপান্তরিত হয়ে বৌদ্ধিক তান্ত্রিকতায় এসে স্থির হয়, যা পরবর্তী কিছু লোকধর্ম যেমন নাথপন্থা এবং বাউলমতে ব্যাপক প্রভাব রাখতে সমর্থ হয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত 'চর্যাপদ' আসলে কিছু তান্ত্রিকমতের কবিতা। আর ইসলামের সুফিবাদের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। এই তিন উদারপন্থী ধারা এই অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে একটা উদারবাদী ধর্মীয় ও দার্শনিক ভিত্তি গড়ে দেয়। আজ যে মুসলমান একসময় বৌদ্ধ ছিল, পরে সে হিন্দু হয়েছে এবং আরও পরে মুসলমান হয়েছে। তাই আজকের যে মুসলমান, তারমধ্যে মুসলমানভাব প্রবল হবার পরও, উত্তরাধিকারসূত্রে তিন ধর্মেরই নানা মৌলিক বৈশিষ্ট্য তার অগোচরেই সে বয়ে বেড়াচ্ছে। বাঙালিত্ব বিকাশ লাভ করেছে এই তিনধর্মের সহনশীলতার মধ্য দিয়েই। এবং তাতে হিন্দু কবিলেখকদের তুলনায় মুসলমান কবিদের অবদান কোনো অংশে কম নয়।
রিচার্ড এম ইটনের (১৯৯৩) গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে ষোড়শ শতকের কবি হাজী মুহাম্মদ আল্লাহ ও গোঁসাইকে একইরূপে দেখেছেন, সৈয়দ মুর্তজা রসুলকন্যা ফাতিমাকে ডাকছেন জগতজননী, সৈয়দ সুলতান খোদাকে ডাকছেন নিরঞ্জন বলে। বিখ্যাত সত্যপীর-এর 'সত্য' অংশটি হিন্দু ভগবান বিষ্ণুর আরেক নাম সত্যনারায়ণ থেকে এসেছে। একজন পীরের কাছে এসে হিন্দুত্ব ও মুসলমানিত্ব লীন হয়ে যাচ্ছে। এই মিশ্র সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ উপনিবেশের আগ দিয়ে বাঙালিত্ব ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে। আজও দক্ষিণবঙ্গের মুসলমান বাওয়ালীরা বনবিবির পূজা করে এজন্য যে বনের দেবী তাদের অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা করবে। একসময় ওলাবিবির পূজা দিত মুসলমান হিন্দু সকলেই। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতিতে সেই রীতির বিলোপ ঘটেছে।
তবে ব্রিটিশ আমলে এটা একটা ঘটনা যে মুসলমানরা হিন্দুদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে। তার নানা কারণ রয়েছে। সেই ব্যাখ্যায় আপাতত না গিয়ে বলছি যে ঊনবিংশ শতাব্দিতে কলকাতাকেন্দ্রিক নবজাগরণের মধ্য দিয়ে হিন্দু মধ্যবিত্ত বিকাশ লাভ করলে এবং সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতিতে তারাই এগিয়ে গেলে বাঙালিত্বের বিকাশের প্রক্রিয়াটি প্রায় পুরোপুরি হিন্দুদের হাতে চলে যায়। বাঙালিত্ব ও হিন্দুত্ব প্রায় সমার্থক হয়ে ওঠে। শ্রীকান্ত উপন্যাসে শরৎচন্দ্র তাই এরকম একটি ফুটবল ম্যাচের কথা উল্লেখ করেছিলেন যেখানে 'বাঙালি' ও 'মুসলমান'রা প্রতিপক্ষ হিসেবে অংশ নেয়। এইভাবে ব্রিটিশদের ইন্ধন ও নানা বাস্তব ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে দুই জাতির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা বাড়তে থাকে।
মুসলমানরা ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ দিক থেকে আত্মসচেতন হয়ে ওঠে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে এরকম ভাবা হয়েছিল। কিন্তু হিন্দু নেতা-কর্মীরা এর প্রবল বিরোধিতা করে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী সহিংস আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হিন্দুদের নেতৃত্বে বাঙালিয়ানা রক্ষার দাবি তুঙ্গে ওঠে। এই বাঙালিয়ানার মধ্যে তারা মুসলমানদেরও রাখতে চাইলো, ব্রিটিশরা বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে বাঙালিদের বিভক্ত করে দুর্বল করে দিতে চায়, এই ছিল তাদের মত। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়।
এই পর্যায়ে বাঙালিত্বের আলোচনাটি স্থগিত রেখে মুসলমানিত্বের আলোচনাটি শুরু করা দরকার।
পর্ব ৩
মুসলমানিত্ব
পাঁচশ বছরের মুসলমান শাসনের সময়ে দেখা গেছে সমাজে শাসকদের চাইতে সুফি দরবেশদের প্রভাবই বেশি ছিল। এমনকি শাসকরা সুফিদের সমীহ করতো, তাদের ধর্মপ্রচারের সুবিধার্থে শাসকরা জমিবরাদ্দ করে দিত। সুফিরাও সমাজের মানুষের নাড়ীর স্পন্দন ভালো বুঝতেন, স্থানীয় অনেক আচার-বিশ্বাসকে তাদের মূলনীতিতে আত্তীকরণ করেন। এমনকি অবাঙালি হলেও তারা বাঙালি রমণীদের বিয়েশাদী করে স্থানীয় হবার চেষ্টা করেছেন। শাসকদের চাইতে তাদের প্রভাব বেশি থাকায় শাসকদের তরবারী দীর্ঘ শাসনামলে খুব কমই উদ্ধত হয়েছে। তরবারী দিয়ে বঙ্গ দখল হয়েছে, কিন্তু পরবর্তী শাসকরা সেই তরবারী কোষমুক্ত তেমন করেননি। আবার বহিরাগত শাসকদের শাসনকার্যের জন্য স্থানীয় হিন্দু রাজা বা সামন্তদের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হয়েছে। বহিরাগত শাসকরা স্থানীয় বাঙালি সাহিত্য সংস্কৃতির ব্যাপক পৃষ্ঠপোষণাও করেন। এই সময়কাল এক অর্থে ছিল ইন্দো-মুসলিম শাসন। এমনকি সুলতানী আমলের নির্বিবাদী আড়াইশো বছরের মাথায়, পঞ্চদশ শতকে হিন্দু রাজা গনেশ সালতানাত দখল করলেও তার নিজ সন্তান যদুকে জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ নামে মুসলমান বানিয়ে মসনদে বসান। হিন্দুদের দিক থেকেও উগ্র হবার সুযোগ ছিলনা। বঙ্গে এককভাবে কোনো ধর্মের মানুষেরই প্রাধান্য বিস্তার করার উপায় ছিলনা।
তবে ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশ সরকারের গৃহীত কিছু নীতি, হিন্দু চরমপন্থা এবং ইসলামী সংস্কার আন্দোলনের কারণে এতদিন বাঙালিত্বে বিশ্বাসী মুসলমানদের একটি অংশ খাঁটি আরব-ইসলামের দিকে ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ে।
ইসলামী সংস্কার আন্দোলন
ব্রিটিশরা ভারতের শাসন ছিনিয়ে নেয় মুসলমানদের কাছ থেকে। তাই ব্রিটিশদের সঙ্গে হিন্দুদের চাইতে মুসলমানরাই প্রথম পর্যায়ে বেশি শত্র“ভাবাপন্ন ছিল। তাদের ব্রিটিশবিরোধিতা প্রকাশ পায় সর্বভারতীয় ওয়াহাবী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এই ওয়াহাবী আন্দোলন ছিল আসলে এক ধরনের জিহাদ, যার উৎপত্তিস্থল আরব দেশ এবং ভারতে ব্রিটিশবিরোধিতা এই জিহাদের অন্তর্গত ছিল। তবে বিশেষত বঙ্গে তা ফরায়াজী আন্দোলনরূপে ঊনবিংশ শতাব্দিতে প্রকাশিত হয়। এর প্রবর্তক হাজী শরীয়তুল্লাহ দীর্ঘদিন আরবদেশে শিক্ষাগ্রহণ করেন এবং ওয়াহাবী মতের সঙ্গে পরিচিত হন। ফরায়াজী ও একই ধাঁচের কয়েকটি আন্দোলন বঙ্গে খাঁটি ইসলামের ধারণার জন্ম দেয় ও প্রসার লাভ করে এবং লোকধর্মপ্রভাবিত বঙ্গীয় ইসলাম হুমকির মুখে পড়ে। বিশেষত বৌদ্ধিক তান্ত্রিকতা, সুফিবাদ প্রভাবিত যাবতীয় লোকধর্ম চর্চাকারীরা এই পিউরিফিকেশনের শিকার হয়। বাউল ধ্বংসের ফতোয়া দেয়া হয়, তাদের তৎপরতাকে অনৈসলামিক ঘোষণা করা হয়, বাউলদের ঝুঁটি কেটে নেয়া হয়, সমাজের মূলধারা থেকে বাউলরা প্রান্তিক ধারায় চলে যায়। শহুরে শিক্ষিতদের বাঙালিপনা আর্থিক-রাজনৈতিক-শিক্ষাগত কারণে ক্ষমতাবান হবার কারণে তেমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
ইসলামী সংস্কার আন্দোলনের একটা ইতিবাচক দিক হলো এর ব্রিটিশবিরোধিতা। কারণ হিন্দুরা যখন কেরানি হবার মানসে ইংরেজি পড়ালেখা শুরু করে দিয়েছে, কিন্তু মুসলমানরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লেগে গেছে। আর এর নেতিবাচক ফল হলো এই যে গ্রামভিত্তিক বাঙালি সমাজে যে সমতার, উদারতার, সহনশীলতার একটা পরিবেশ ছিল, মোল্লাতন্ত্রের বিকাশে তা চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাউলতত্ত্বের সঙ্গে মোল্লাতন্ত্রের বিরোধ তাই ঐতিহাসিক। এইবেলা বাউলমূর্তি সরানোর জঙ্গিপনাকে আমরা স্মরণে আনতে পারি। বাউলগুরু লালনের মূর্তি বলে কথা! পৌত্তলিকতা, হাজীদের অসম্মানের যুক্তিগুলো বাহ্যিক, মূলে রয়েছে এই চিরকালীন বিরোধ। লালনের মৃত্যুদিনের প্রাক্কালেই এই ঘটনা ঘটেছে, সেটাও স্মর্তব্য।
সুফিবাদ প্রভাবিত বাউলতত্ত্বের সঙ্গে মোল্লাতন্ত্রের বিরোধের ক্ষেত্র কোনগুলো, তা আলোচনার পরবর্তী পর্যায়ে আলোকপাত করা হবে।
পর্ব ৪
ব্রিটিশ নীতি
যাদের কাছ থেকে ব্রিটিশরা ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিল সেই মুসলমানদের বরাবরই তারা পৃথক রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে ভেবেছে। পৃথকভাবে দেখার এই নীতি কখনও মুসলমানদের বিপক্ষে গিয়েছে, কখনও পক্ষেও এসেছে। ব্রিটিশদের গৃহীত অন্তঃত তিনটি পদক্ষেপ মুসলমানদের ভবিষ্যৎ ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছে: এগুলো হলো ১৮৩৭ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ এবং ১৯৩২ সালের সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা।
ঐতিহাসিক ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের (১৮৭১) মতে, 'ব্রিটিশ শাসনামলে মুসলমান জাতটি সব অর্থে একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়'। প্রথম বড়ো আঘাত আসে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে পুরনো প্রশাসন ও ক্ষমতাকাঠামো একেবারে ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং এভাবে 'আশরাফ' মুসলমানরা (এলিট মুসলমান, যাদের অন্তঃত আরব, তুর্কী বা নিদেনপক্ষে মধ্য এশীয় ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল অথবা যারা ব্রিটিশ আগমণের পূর্বে রাজ-রাজড়া জাতীয় পদবিতে সমাসীন ছিল) সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর এটি মূলত একটি রাজস্বব্যবস্থা হবার কারণে 'আতরাফ' (নিম্নবর্গীয় মুসলমান, মূলত ধর্মান্তরিত স্থানীয় লোকজন) কৃষকরাও এর শিকার হয়। অন্যদিকে এই বন্দোবস্তের ফলে একটি মধ্যস্বত্বভোগী জমিদার শ্রেণীর সৃষ্টি হয় যাদের মূল কাজ ছিল কৃষকদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করে ব্রিটিশ সরকারের কাছে জমা দেয়া। এই জমিদার শ্রেণীর বেশিরভাগই ছিলেন হিন্দু এবং এই করসংগ্রাহকরা নানা উপায়ে 'মুসলমান' কৃষকদের কাছ থেকে কর আদায় করতো। একপর্যায়ে তাদের নিপীড়কের ভূমিকায় দেখা যায়। অন্যদিকে এই নিপীড়নসৃষ্ট প্রাপ্ত উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে এই জমিদারসন্তানরা কলকাতায় ইংরেজি পড়া শুরু করে, ইউরোপীয় শিক্ষায় আলোকিত হয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অবদান রাখা শুরু করে, কিছু সমাজসংস্কারও করে (যেমন সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ), একটি 'ভদ্রলোক' বা 'বাবু' শ্রেণীর জন্ম হয়, ব্রিটিশদের সঙ্গে দেনদরবার করে অধিকার আদায় করতে তারা সমর্থ হয়ে ওঠে। এমনকি ইউরোপীয় শিক্ষা তাদের উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে তাত্ত্বিক সমর্থন দেয়। যখন হিন্দু বাবুরা সমাজে এভাবে অগ্রবর্তী ও আধুনিক হয়ে ওঠে, মুসলমানদের অবস্থা তখন করুণ থেকে করুণতর হতে থাকে। একপর্যায়ে তারা আবিষ্কার করে তারা ব্রিটিশ ও হিন্দু উভয় দ্বারাই নিপীড়িত। ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে তারা সংগঠিত হতে থাকে, ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লিগের জন্ম হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যদি মুসলমানদের জন্য অভিশাপ হয়ে থাকে তবে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ তাদের জন্য আশীর্বাদ বা কম্পেনসেশন হিসেবে দেখা দেয়। ঢাকাকে কেন্দ্র করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামক রাজ্যটিতে মুসলমানরা বিকশিত হবে, এই ছিল লর্ড কার্জনের পরিকল্পনা। কিন্তু এই পদক্ষেপ হিন্দু মধ্যবিত্ত মানতে চায়নি, তারা একে বাংলাকে বিভক্ত করে দূর্বল করে দেবার ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখে এবং তাদের প্রবল প্রতিবাদে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। কিন্তু বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হিন্দু নেতারা যতই মুসলমানদের একক বাঙালিত্বের ছাতায় রাখতে চাননা কেন, দুই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে ততদিনে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সুনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মুসলমানরা মুসলিম লিগ ও হিন্দুরা কংগ্রেসকে ঘিরে সংগঠিত হতে থাকে। কংগ্রেসের যদিও একটা সেকুলার চেহারা ছিল, কিন্তু কংগ্রেসের ভেতরকার চরমপন্থী হিন্দুরা ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের সময় (দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গ) চেয়েছে বাংলা দুই ভাগ হয়ে যাক। কারণটা হলো ১৯৩২ সালের সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা।
জয়া চ্যাটার্জির (১৯৯৪) মতে ম্যাকডোনাল্ডের সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা বাংলায় নাটকীয়ভাবে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র উল্টে দেয়। বিংশ শতাব্দির শুরুতে মুসলমানরা বঙ্গে সংখ্যায় সামান্য বেশি ছিল, কিন্তু সমাজে হিন্দু ভদ্রলোকদের প্রভাবই বেশি ছিল। কিন্তু এই রোয়েদাদে যেভাবে আইনসভার আসন বিন্যস্ত হয় তাতে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হয়। বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় মুসলমানদের জন্য শতকরা ৪৮.৪ ভাগ, হিন্দুদের জন্য ৩৯.২ ভাগ এবং ইউরোপীয়দের জন্য ১০ ভাগ আসন বরাদ্দ করা হয়। এভাবে মুসলমানরা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক অধিকার ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জনের মানসে এভাবে বাঙালি মুসলমানরা ধীরে ধীরে পাকিস্তান আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। মুসলিম লিগে যদিও আবুল হাশিমের মতো উদারপন্থী নেতারা ছিলেন এবং যদিও পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালি মুসলমানরা বেশি মাত্রায় উচ্চকণ্ঠ ছিল, কিন্তু নানা ঘটনাচক্রে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব উর্দুভাষী ও কট্টর আশরাফ মুসলমানদের হাতে চলে যায়।
হিন্দুত্ববাদ
বাঙালি মুসলমানদের দিক থেকে ব্রিটিশ আমলের শেষদিকে মুসলমানিত্বের দিকে অধিকমাত্রায় ঝুঁকে পড়ার জন্য তাদের এককভাবে দায়ী করা যাবেনা। হিন্দুত্ববাদের জোয়ারও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। কারণ হিন্দুদের দিক থেকে ভারতীয়ত্ব মানে হিন্দুত্ব ধরে নেয়া হতো। এমনকি বাঙালিত্বের ডিসকোর্সেও তারা মুসলমানদের ঠাঁই দিতে চায়নি। শ্রীকান্ত উপন্যাসে বাঙালি ও মুসলমানদের মধ্যকার ফুটবল-ম্যাচের কথা আগেই বলেছি। তবে ভারতীয়ত্ব ও হিন্দুত্বকে সমার্থক মনে করে যে ডিসকোর্স চালু হয়, পার্থ চ্যাটার্জির (১৯৮৬) মতে, তাতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অরবিন্দ ঘোষ, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমূখের লেখালেখি ও কার্যক্রম তাত্ত্বিক ভিত্তি দেয়। ১৯২০, ১৯৩০ ও ১৯৪০ দশকের ঘটনাবলী তাই বাঙালি মুসলমানের কাছে মুসলমান পরিচয় বাঙালি পরিচয়ের চাইতে ওপরে স্থান পায়।
তাই বলা যায় ঊনবিংশ শতাব্দির ইসলামী সংস্কার আন্দোলন ও বিংশ শতাব্দির প্রথম পর্যায়ের রাজনৈতিক ঘটনাবলী পূর্ববঙ্গের মানুষের মানসপটে মুসলমানিত্বের অস্তিত্বটি স্থায়ী হয়ে যায়। তবে বিভাগপূর্ব সময়ে যদি বাঙালিত্বের ওপরে মুসলমানিত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করে, বিভাগপরবর্তী পাকিস্তান আমলে মুসলমানিত্বের ওপরে বাঙালিত্বের বিজয় ঘোষিত হয়।
অধুনা সেই সেই ইতিহাস সবারই জানা, সেই পরিসরে অনুপ্রবেশের আগে আমি এবার আলোকপাত করতে চাইবো লোকধর্মের ওপর, যা একসময় সমাজে সর্বসাধারণের ধর্ম ছিল, বাঙালিত্বের বৈশিষ্ট্য গঠনে যার প্রভাব ছিল, কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দির ইসলামী সংস্কারের কারণে যা প্রত্যন্ত সমাজে গৌন ধর্ম আকারে পশ্চাদাপসারণ করে।
পর্ব ৫
লোকধর্ম
আমি এখানে যাকে লোকধর্ম বলছি তাকেই অনেকে 'মাইনর রিলিজিয়াস সেক্টস' (এইচ এইচ উইলসন), বা 'অবসকিউর রিলিজিয়াস কাল্টস' (শশীভূষণ দাশগুপ্ত, ১৯৭৬), অথবা গৌনধর্ম বা উপধর্ম (সুধীর চক্রবর্তী, ২০০৫)এবং মোটের ওপরে সবাই মিস্টিসিজম বলে থাকেন। সুধীর চক্রবর্তী অষ্টাদশ শতকে বাংলায় অন্তঃত ১০২টি লোকধর্ম ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। আর এই লোকধর্মসমূহের অন্যতম ভূমিকা ছিল শাস্ত্রীয় ব্রাহ্মণ্যবাদ ও শাস্ত্রীয় ইসলাম নিয়ে দার্শনিক প্রশ্ন উত্থাপন করা এবং বিতর্ক করা। তান্ত্রিকতা, সুফিবাদ ও বৈষ্ণববাদ -- তিন ধর্মের তিনটি উদারবাদী ধারা এইসব লোকধর্ম সংগঠনে প্রভাব রেখেছে।
বৌদ্ধ তান্ত্রিকতা
অন্ধ্রপ্রদেশে প্রাপ্ত দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকের এক সাঁচিলিপিতে বলা হয়েছে যে বাংলা ছিল এক বৌদ্ধ এলাকা। আবার চীনা পর্যটক হিউয়েন সান লিখেছেন মৌর্য শাসকদের রাজধানী মগধে তিনি যে বৌদ্ধধর্ম দেখেছেন, বাংলার বৌদ্ধধর্ম তা থেকে আলাদা ছিল। আগেই বলেছি বৌদ্ধধর্মের উদার মহাযান ধারাটি বঙ্গে গৃহীত হয় এবং তার বিবর্তিত রূপ সহজযান থেকে তান্ত্রিকতায় এসে স্থির হয় যা অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে বিকশিত হয়। শশীভূষণ দাশগুপ্ত একটি উল্লেখযোগ্য তান্ত্রিক রীতি হিসেবে যোগমৈথুনকে উল্লেখ করেছেন। বোধিচিত্ত লাভে এঅঞ্চলের বৌদ্ধরা গুপ্ত যোগমৈথুন চর্চাকে উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছিল। তবে তান্ত্রিক সাধনায় আরও দুটি রীতি হলো গুরুবাদ এবং মানবদেহে গুরুত্বপ্রদান। ভারতীয় ধর্মসমূহে বিশেষত লোকধর্মসমূহে গুরুবাদের এজন্য গুরুত্ব দেয়া হয় যে, যেসব রহস্যময় বা গুপ্ত চর্চার মাধ্যমে গুরু সত্যকে জেনেছেন, একজন সাধারণ আগ্রহীর পক্ষে সেই সত্যকে জানা সম্ভব নয়। তাই তাকে গুরুর শিষ্য হতে হবে। এ হলো এক লণ্ঠন থেকে আরেক লণ্ঠনে আলো ছড়িয়ে দেবার মতো ব্যাপার। আর তান্ত্রিকতায় ধরে নেয়া হয় মানবদেহ হলো ব্রহ্মাণ্ডের সারবস্তু। যদি দেহের সিদ্ধিলাভ সম্ভব হয়, তবে তিন ভূবনের সব বিষয়েই সিদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে।
সুফিবাদ
বখতিয়ার খিলজির আগমনের পূর্বেই একাদশ শতকে সুফিরা ভারতে মতবাদ প্রচার শুরু করেন এবং দ্বাদশ শতকের শেষে তা জনপ্রিয় মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। শশীভূষণ দাশগুপ্ত বলেন উপনিষদের প্যানেনথিয়েস্টিক মিস্টিসিজম, বৈষ্ণবীয় ভক্তিবাদ, বৌদ্ধধারার সহজিয়া আন্দোলন বিশেষত বঙ্গে যে উদারবাদী দার্শনিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, তা সুফিবাদের প্রসারেও ভূমিকা রাখে। আর এভাবেই আর্যধর্মের মতো পারস্য থেকে বঙ্গে পৌঁছতে পৌঁছতে সুফিবাদও বঙ্গীয় চেহারা পায়। সুফিবাদ আরবের প্রকৃত ইসলামের থেকে বেশ খানিকটা আলাদা।
প্রকৃত ইসলাম অদ্বৈতবাদে বিশ্বাসী এবং এখানে খোদা ও বান্দার সম্পর্ক প্রভূ ও দাসের। কিন্তু সুফিরা দ্বৈতবাদে বিশ্বাস করে যেখানে খোদা ও বান্দার সম্পর্ক ভালোবাসার। সুফিসাধনার একটি পর্যায় হলো 'ফানা' যেখানে খোদা ও বান্দা লীন হয়ে যায়। এই ফানার বিষয়টি বৌদ্ধধর্মের 'নির্বাণ'-এর মতোই। যোগসাধনাও পরবর্তী সময়ে সুফিবাদে যুক্ত হয়, যাকে 'মুরাক্বিবা' বলা হয়ে থাকে। গুরুবাদও সুফিবাদে গুরুত্বপূর্ণ। একজম মুরিদ পীর বা মুর্শিদের সাহায্য নিয়ে ফানাফিল্লার স্তরে পৌঁছতে পারে। অদৃশ্য খোদার চাইতে দৃশ্যমান মুর্শিদ এভাবে ভক্তিবাদী মুসলমানদের কাছে বড়ো হয়ে ওঠেন। আজকের বাংলাদেশেও অজস্র মাজারের অস্তিত্ব ও পীরপূজার রীতি সুফিবাদের প্রভাবকেই স্পষ্ট করে তোলে।
বৈষ্ণববাদ
বৈষ্ণববাদ হলো হিন্দুত্ববাদের একটি র্যাডিকাল ও সংস্কারবাদী ধারা। বাংলার সাধারণ হিন্দুদের ওপরে বৈষ্ণববাদের প্রভাবই বেশি পড়েছে, শাস্ত্রীয় ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতায় যার ভূমিকা অপরিসীম। বৈষ্ণব সহজিয়া আন্দোলন বৌদ্ধ সহজিয়া আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত। ভক্তি, ভালোবাসা ও সমতার নীতিতে বৈষ্ণববাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই ভক্তি ও ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে রাধা ও কৃষ্ণের ভক্তিবাদী সম্পর্ক নিয়ে রচিত পদমালায়। বৈষ্ণববাদের চরম বিকাশ ঘটে নদীয়ায় চৈতন্য দেবের মাধ্যমে যা পরে সারা বাংলায় ও ভারতের কিছু অংশে ছড়িয়ে পড়ে। তবে শ্রী চৈতন্যের আগেও জয়দেব, বিদ্যাপতি ও চণ্ডিদাসের কাব্যের মাধ্যমে বৈষ্ণববাদ বিকশিত হয়েছে।
সমতা ও ভক্তিবাদনির্ভর চৈতন্যের বাণী প্রচারে তৎকালীন মুসলমান শাসক আলাউদ্দিন হোসেন শাহ কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াননি। বরং ব্রাহ্মণরা এর প্রবল বিরোধিতা করে। কারণ ব্রাহ্মণরা বর্ণপ্রথা টিকিয়ে রাখতে চায় আর চৈতন্য এর বিলোপের বাণী প্রচার করেন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো চৈতন্য তার বাণী প্রচারের জন্য সংস্কৃত নয়, ব্রাত্যজনের ভাষা বাংলাকেই বেছে নেন। শাস্ত্রীয় মন্ত্রের পরিবর্তে চৈতন্য নামকীর্তনকে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।
বৈষ্ণববাদের সমতার বাণী বাংলায় প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। আরেক অর্থে ইসলামের সমতার বাণী যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল চৈতন্য তার মতবাদের মাধ্যমে তাকে ভালোভাবেই মোকাবেলা করেন এবং এভাবে বাংলায় হিন্দুধর্ম তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে।
কিন্তু চৈতন্যের মৃত্যুর ৫০ বছরের মধ্যেই গোস্বামীরা বাংলা ছেড়ে বৃন্দাবনে গিয়ে আসন গাড়েন এবং চৈতন্যের সমতার ধারণাকে বাতিল করেন। এবং এভাবে বৈষ্ণববাদ ব্রাহ্মণদের দ্বারাও স্বীকৃত হয় এবং দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে -- বর্ণপ্রথার সমর্থক ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব ও বর্ণপ্রথাবিরোধী সাধারণ বোষ্টম। এভাবে বৈষ্ণববাদ তার প্রকৃত রূপ হারায় এবং সমতাবাদী বৈষ্ণববাদ উপধর্ম বা লোকধর্মে আশ্রয় নেয়।
তান্ত্রিকতা, সুফিবাদ ও বৈষ্ণববাদ -- এই তিন উদার ও সমতাবাদী মতবাদের সর্বোচ্চ প্রতিফলন ঘটেছে বাংলার বাউলদের মধ্যে। এবার বাউলতত্ত্ব সম্পর্কে জানা যাক।
বাংলার বাউল
বাউলতত্ত্ব হলো বাংলায়, বিশেষত পূর্ববঙ্গে সবচেয়ে জনপ্রিয় লোকধর্ম। সবচেয়ে বিখ্যাত বাউল দার্শনিক ও গীতিকার হলেন লালন শাহ (১৭৭৪-১৮৯০) যার আখড়া ছিল কুষ্টিয়ায়। তান্ত্রিকতা থেকে যোগসাধনা, সুফিবাদ থেকে ফানার ধারণা ও বৈষ্ণবদের থেকে ভক্তিবাদ বাউল মতবাদকে সমৃদ্ধ করেছে। এছাড়া গুরুবাদ ও দেহতত্ত্বও বাউল মতের অপরিহার্য অংশ। বাউল মতবাদ প্রশ্ন উত্থাপনের মাধ্যমে, তর্কের মাধ্যমে তার দার্শনিকতার চর্চা করতে চায়। মারফতের অবস্থান থেকে তার প্রশ্ন শরীয়তপন্থা নিয়ে।
বাউলরা বিশ্বাস করেন মুসলমান মাধব বিবি ও আউল চাঁদ বাংলায় বাউলমত প্রবর্তন করেন, মাধব বিবির শিষ্য বীরচন্দ্র তা জনপ্রিয় করেন এবং ঊনবিংশ শতাব্দিতে লালন শাহের মাধ্যমে তা পূর্ণ পরিচিতি লাভ করে। আহমদ শরিফের (২০০৩) দেয়া তথ্যানুসারে সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ৩ লক্ষ বাউল আছেন। বাউলরা দুই ধরনের: গৃহী ও বৈরাগী। বাউল গান কেবল পল্লীগীতিমাত্র নয়, বাউলগুরু একইসঙ্গে কবি ও দার্শনিক।
চৈতন্যদেব বলেছিলেন 'মুই সেই', সুফি মনসুর হাল্লাজ বলেছিলেন 'আনাল হক' আর বাউলরা বলেন 'দেহের মাঝে আছেরে সোনার মানুষ, ডাকলে কথা কয়'। বাউল তত্ত্বে আত্মা ও পরমাত্মা একই, আত্মা পরমাত্মারই অংশ; তাই আত্মাকে জানাই হলো পরমাত্মাকে জানা। দেহের মাধ্যমেই আত্মাকে জানা বাউলদের আধ্যাত্মিক সাধনার অংশ। 'খাঁচা'র ভেতর 'অচিন পাখি'র আসাযাওয়ার অনুসন্ধানের কারণ হলো এই।
বঙ্গে বাউলদের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভূমিকা রয়েছে। তারা তাদের মতবাদের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা, জাতিগত সংঘাত, ধর্মীয় চরমপন্থার বিরোধিতা করেছে বরাবর। এভাবে তারা সব ধর্মের মানুষকে বাউল মতবাদের একক ছাতার নিচে আনতে সমর্থ হয়েছে। অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন ঊনবিংশ শতাব্দির শহরকেন্দ্রিক নবজাগরণে রামমোহন রায়ের যে-ভূমিকা, গ্রামবাংলায় লালনের ভূমিকা একইভাবে সমাজসংস্কারকের। কাঙাল হরিনাথ তার পত্রিকা 'গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা'য় স্থানীয় জমিদারদের বিরুদ্ধে লিখলে জমিদারের লাঠিয়ালরা হরিনাথের ওপর চড়াও হয় এবং লালন তার শিষ্যদের নিয়ে সেই লাঠিয়ালদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান এবং বন্ধু হরিনাথকে রক্ষা করেন। ঘটনাচক্রে সেই জমিদারী ছিল রবীন্দ্রপরিবারের, যদিও রবীন্দ্রনাথের ওপর লালনের প্রভাব অবিসংবাদিত। রবীন্দ্রনাথের মনের মানুষের ধারণাটি বাউলমত দ্বারা প্রভাবিত।
বাউলদের অসাম্প্রদায়িক অবস্থান ব্রাহ্মণ ও মোল্লা উভয়কেই ক্ষিপ্ত করে। বিশেষত ঊনবিংশ শতাব্দির ইসলামী সংস্কার আন্দোলন পরবর্তী সময়ে বাউলদের কার্যক্রমকে মোল্লারা অনৈসলামিক ঘোষণা করে। তাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেয়া হয়, পুস্তিকা লিখিত হয় এবং শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়। অনেক বাউলের লম্বা চুল কেটে ফেলা হয়, দোতরা ভেঙ্গে ফেলা হয়।
পর্ব ৬
এতক্ষণের আলোচনায় এটা হয়তো স্পষ্ট করা গেছে যে বঙ্গের যে-ইসলাম তা প্রধানত পপুলার ইসলাম (জনধর্ম), ঊনবিংশ শতাব্দির সেই সংস্কার আন্দোলনের ফলে জন্ম নিয়েছে স্কলাস্টিক ইসলামের (শাস্ত্রীয় ধর্ম), আর দেশবিভাগের আগ দিয়ে মুসলিম লিগের মাধ্যমে জন্ম নিয়েছে পলিটিক্যাল ইসলামের (রাজনৈতিক ধর্ম), স্বাধীন বাংলাদেশে যা জামাতে ইসলামী অন্য অনেক ছোট ইসলামী দলের মাধ্যমে চর্চিত হচ্ছে। সামাজিক পর্যায়ে অনেক আশঙ্কাজনক ধর্মীয় উন্মাদনা দেখা যাবার পরও, বাংলাদেশের মুসলমানরা গড়পড়তা অন্য মুসলমান দেশগুলোর চাইতে যে অপেক্ষাকৃত উদার তা কিন্তু সুফিবাদ ও লোকধর্মসমূহের প্রভাব হয়েছে। সাধারণ মুসলিম সাইকিতে একটা স্থায়ী উদারনৈতিকতা বা উন্মুক্ততা সেঁটে আছে, যা মধ্যযুগের পাঁচশ বছরের মুসলিম শাসনের সময় মুসলিমমানসে খোদাই হয়ে যায়। লোকধর্মের প্রভাবে পপুলার ইসলাম সংগঠিত হলেও স্কলাস্টিক ইসলাম ও পলিটিক্যাল ইসলাম লোকধর্মসমূহকে শত্র“ চিহ্নিত করেছে এবং নানা সময়ে আক্রমণ করেছে -- ফতোয়া দিয়ে, শারীরিকভাবেও।
অন্যদিকে বাঙালি জাতিসত্তা যখন একটা চেহারা পাচ্ছে মধ্যযুগে, কাব্য ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে, তাতেও লোকধর্মসমূহের অবদান রয়েছে। লোকধর্মসমূহের উদারনৈতিক এপ্রোচ সমাজে যে সমতার পরিবেশ তৈরি করেছিল তার প্রেক্ষাপটেই বাঙালিত্বের চেতনা বিকশিত হয়। পরবর্তী সময়ে বাঙালিত্বের জোয়ারে দুইবার বঙ্গ ভেসে গিয়েছিল, প্রথমবার প্রধানত হিন্দুদের দ্বারা, বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় এবং দ্বিতীয় দফায় ষাটের দশকে পাকিস্তানবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময়ে, প্রধানত মুসলামানদের মাধ্যমে। বাঙালিত্বের সাইকিতেও লোকধর্মের মানবপ্রেমের বাণী স্থায়ী একটা ভূমিকা রেখেছে। মূলত পাকিস্তান আমলের পূর্বেকার পপুলার ইসলামের অনুসারীরাই পরে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে শরিক হয়েছে। তবে মুসলমান হয়ে পাকিস্তানী মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবার পেছনে কমিউনিজমের ভূমিকা রয়েছে। কমিউনিজমের সেকুলার মতাদর্শ আধুনিক তত্ত্বের মোড়কে বাঙালিত্বের সঙ্গে মিশে যায়। যদিও ১৯৭১ সালে কোনো কমিউনিস্ট বিপ্লব হয়নি কিন্তু তখন পর্যন্ত দর্শন হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদে কমিউনিজমের প্রভাব এতটাই ছিল যে শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধানে চার মূল নীতির মধ্যে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রেখেছিলেন। তবে কমিউনিজম প্রভাবিত সেকুলারিজম এবং আধুনিকতা এক পর্যায়ে আল্ট্রা সেকুলারিজমে রূপ পেয়েছে, এবং ইসলামবিরোধিতা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে বাঙালিত্বে অনুপ্রবেশ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে ইসলামপন্থী দলগুলোর বিরোধিতা এই বিষয়টিকে সুনিশ্চিত করেছে। এই আল্ট্রা সেকুলারিজম ও মডার্নিজম বাঙালিত্বের দিক থেকে লোকধর্মকে উপেক্ষা করতে উৎসাহিত করেছে -- কারণ তা গ্রাম্য, কারণ তা অনাধুনিক। বাউল গান আধুনিক শিক্ষিতের কাছে অডিও ইন্ডাস্ট্রিবাহিত পল্লীগীতিমাত্র। লুঙিপরিহিত জটাধারী বাউল তার দৃষ্টিতে নিম্নবর্গের প্রতিনিধিমাত্র। মাজার হলো তার কাছে ভণ্ডগুরু ও গাঁজাখোর শিষ্যের আবাসমাত্র। অথচ দেখা যাবে নিম্নবর্গের বাউলের বা মাজারকেন্দ্রিক মুর্শিদের তত্ত্বকথা বোঝার বুদ্ধি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালির ঘটে নেই বললেই চলে। [ক্রমশ...]