আমি দেখি, এবং ইউটিউবের প্রতি এজন্য আমি কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞ সেইসব ইউটিউব আপলোডারদের প্রতিও, যারা এগুলো আপলোড করে রেখেছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব পরিচালকের গুরুত্বপূর্ণ সব ছবি দেখার সাধ খানিকটা পূর্ণ হবার পরও দেখি অপূর্ণতা যাবার নয়। ছাত্রজীবনে ক্লাসিক বা মডার্ন ক্লাসিক সব সিনেমা দেখতাম ঢাকার ফিল্ম সোসাইটিগুলোর নানা আয়োজনে হাজির হয়ে। সিনেমা নিয়ে একটু-আধটু পড়াশুনার পাশাপাশি কোনো কোনো সিনেমা দেখে দিউয়ানা হয়ে যাবার মতো অবস্থা হতো তখন। দু-চারদিন কিংবা সপ্তাহ ধরে একেকটি সিনেমার অনুরণন চলতে থাকে নিউরনে। পরে ডিভিডি সার্কিটে সেইসব নানান দেশের (বিশেষত মার্কিন ও ভারতীয় ছবির বাইরের) ছবি সহজলভ্য হলে উদ্বেলিত হই, প্রতি মাসে ৮০ বা ১০০ টাকায় একটি দু-টি ছবি সংগ্রহ করতে থাকি। বাড়তে থাকে নিজস্ব সংগ্রহ, গড়ে উঠতে থাকে ক্ষুদ্র অডিওভিস্যুয়াল লাইব্রেরি। একেকটি মণিমানিক্য যোগাড় করতে থাকি, যা নেড়েচেড়ে দেখার আনন্দই আলাদা। এইতো সেদিন এক জাপানি মেয়ে আমার সংগ্রহ থেকে আকিরা কুরোসাওয়ার কিছু ছবি ধার নিয়ে গেল। জাপানিকে জাপানি সিনেমা ধার দেবার যে আনন্দ, সেটাও বা কম কি!
কিন্তু অনেক সিনেমাই তো দেখা হয়নি। নাম শুনেছি, কাহিনী জেনেছি, কিন্তু কোথাও পাইনা, বা বাজারে থাকার পরেও কেনা হয়নি। ইউটিউবে একসময় এটা ওটা সার্চ দেয়া শুরু করলাম। প্রায় সব ছবিরই অন্তঃত ট্রেলার পাওয়া যায়। কিন্তু তাতে তো চলবে না, মন ভরবে না। এরপর পদ্ধতিগতভাবে সার্চ দেয়া শুরু করলাম। ধরুন চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বারংবার পড়েছি, এমনকি পড়িয়েছি, কিন্তু দেখার সৌভাগ্য হয়নি -- কারণ এগুলো বাজারে যেমন পাওয়া যায়না, কারও সংগ্রহে আছে এমনও শুনিনি -- এরকম ছবি খোঁজা শুরু করলাম। এভাবে ধরে ধরে সার্চ দিয়ে দেখলাম। বিস্ময়ের পালা শুরু হলো। পেয়ে গেলাম বিশের দশকের বিখ্যাত জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট ছবি 'দি কেবিনেট অব ড. ক্যালিগরি' (১৯২০, পরিচালক রবার্ট ভাইন)। আর পেয়ে গেলাম চার্লস চ্যাপলিনের 'মডার্ন টাইমস' (এই ছবিটা ঢাকার বাজারে পাইনি, মালয়েশিয়ার বাজারেও নেই)। 'ক্যালিগরি' ছবিতে বিকৃতমস্তিষ্ক ডাক্তার ক্যালিগরির একজন বিশ্বস্ত একজন স্লিপওয়াকার, সিজার আছে, যে ক্যালিগরির কথামতো বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ করে থাকে। 'মডার্ন টাইমস' ছবিতে চ্যাপলিন শিল্পসভ্যতা বা যান্ত্রিক সভ্যতাকে তীব্র ব্যাঙ্গ করেছেন। এখানে চ্যাপলিন হলো এক ইন্ডাস্ট্রির এমন একজন শ্রমিক যার কাজ কেবল একজায়গায় দাঁড়িয়ে রেঞ্জ হাতে বেল্টে আসতে থাকা সব নাট-বল্টু টাইট করা। এটা ক্রমাগত করতে করতে তার এমন অবস্থা হয় যে তার মানবসত্ত্বাকে যন্ত্র গ্রাস করে ফেলে। সে নাটসদৃশ কিছু দেখলেই তা টাইট দিতে চায় (যেমন এক মেয়ের জামায় বড়ো বড়ো বোতাম সে একবার টাইট দিতে যায়)। দারুন চলচ্চিত্র।
এরপর একে একে দেখলাম:
১. 'গুডফেলাস' (১৯৯০), পরিচালক মার্টিন স্করসিস। স্করসিস আমার প্রিয় পরিচালক, কিন্তু এই ছবিটি আমার ভালো লাগেনি। ছবিটি অস্কারে বেশ কয়েকটি নমিনেশন পায়। একজন অপরাধী হেনরী ও তার দু’জন সঙ্গীর কাহিনী এই ছবিটি। স্করসিসের ছবি মানেই রবার্ট ডি নিরো, তবে এখানে তিনি মূল চরিত্রে নেই।
২. 'ডেইজ অব বিয়িং ওয়াইল্ড' (১৯৯০) এবং 'ইন দ্যা মুড ফর লাভ' (২০০০), পরিচালক ওং কার ওয়াই। হংকংয়ের বিখ্যাত এই পরিচালকের ২০৪৬ আমার সংগ্রহে ছিল আগেই। এই তিনটি ছবি মিলে আবার একটি ট্রিলজি। সত্তর দশকের হংকংয়ের তারুণ্য, তাদের নাগরিক বিচ্ছিন্নতা, নৈতিকতার সঙ্কট -- এইসব এই ট্রিলজির কমন থিম। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ছবিতে আছেন হংকংয়ের আর্ট ফিল্মের বিখ্যাত অভিনেতা টনি লেয়ুং।
৩. 'অন্তরমহল' (২০০৫), পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ। ঋতুপর্ণের এই ছবিটির নাম তেমন উচ্চরিত হয়না। কিন্তু এর কাহিনী দেখে আমি হতবাক। ব্রিটিশ আমলের নিঃসন্তান এক জমিদার পুত্রসন্তান ও রায়বাহাদুর খেতাবের জন্য কোথায় নামতে পারে, তা দেখানো হয়েছে ছবিটিতে। স্বাভাবিকভাবেই তার এই দুই খেয়ালের শিকার তার দুই স্ত্রী। বড়ো স্ত্রী ব্রাহ্মণ্যবাদেরও শিকার হয়। জমিদারের চরিত্রে আছেন জ্যাকি স্রফ আর দুই স্ত্রীর চরিত্রে আছেন রূপা গাঙ্গুলী ও সোহা আলী খান। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আছেন অভিষেক বচ্চন।
৪. 'চরাচর' (১৯৯৩), পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। তাকে বলা হয় সত্যজিৎ পরবর্তী সময়ের নির্মাতাদের মধ্যে সত্যজিতের সবচাইতে কাছাকাছি। 'তাহাদের কথা' (১৯৯২), 'উত্তরা' (২০০০), 'নিম অন্নপূর্ণা' (১৯৭৯), 'মন্দ মেয়ের উপাখ্যান' (২০০২) ইত্যাদি আগেই দেখা ছিল। চরাচরের নাম অনেক শুনেছি, এইবেলা দেখলাম। গ্রামের যুবক লখাইয়ের পেশা পাখি ধরা ও তা বিক্রি করা। কিন্তু তার পাখিপ্রীতি তার পেশাগত উন্নয়নে বাধাস্বরূপ। সে পাখি ধরে আর ছেড়ে দেয়। স্ত্রী এজন্য উঠতি ব্যবসায়ী যুবকের সঙ্গে প্রেম করে, শরীরের বিনিময়ে টাকাপয়সা এনে সংসার চালায়, একসময় ভেগেও যায়। লখাইয়ের এই অতি পাখিপ্রীতি তার চরিত্রের মধ্য দিয়ে ন্যাচারালি আসেনি, এই রোমান্টিসিজম পরিচালকের এবং তা এক পর্যায়ে আরোপিত মনে হয়েছে। লখাই চরিত্রে আছেন রজত কাপুর এবং স্ত্রীর চরিত্রে লাবণী সরকার। বলা যায় ছবিটা বুদ্ধদেবের অনান্য ছবির তুলনায় তত ভালো লাগেনি।
৫. 'এ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ' (১৯৭১), পরিচালক স্ট্যানলি কুব্রিক। কুব্রিক আমেরিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচালকদের একজন। তার সবচাইতে বিখ্যাত '২০০১: আ স্পেস অডিসি' (১৯৬৮) দেখেছিলাম। তার দ্বিতীয় বিখ্যাত ছবি 'এ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ' (এজন দায়িত্বশীল মানুষ) ইউটিউবেই দেখলাম। লন্ডনের এক বিপথগামী তরুণের কাহিনী এটি, যে তার তিন বন্ধুকে নিয়ে সন্ধ্যার পরে নানা 'আকাম' করে বেড়ায় -- ভবঘুরেকে পেটায়, ধর্ষণোদ্যত পোলাপানকে খেদায় এবং নিজেও ধর্ষণ করে, খুন করে। অন্যদিকে সে আবার বিটোভেনের সিম্ফনির ভক্ত। একপর্যায়ে সে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হয়। জেলে তার ওপরে নানা সংশোধনী কার্যক্রম চলে। একটি বিশেষ পদ্ধতির সংশোধনী কার্যক্রম তার ওপরে সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়, একপর্যায়ে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। সংশোধিত হয়ে সে সমাজে স্বাভাবিকভাবে চলতে চায়, কিন্তু তার শিকার হয়েছিল যে যে মানুষ, এবার তারা তাকে তাড়া করতে থাকে। এই ছবিটার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডে ব্যাপক সমালোচনা হয়, কুব্রিক একপর্যায়ে প্রদর্শনী বন্ধ করে দেন। বিখ্যাত চিত্রসমালোচক রজার এবার্ট ছবিটিকে পাঁচের মধ্যে দুই রেটিং দিয়েছেন। তার ভাষায়, ইটস এন ইডিওলজিকাল মেস।
হয়তো খুব অপ্রাসঙ্গিক নয়, তাই বলি, আমেরিকায় গ্যাংস্টার/অপরাধ জঁরার অনেক ছবিই নির্মিত হয়েছে এবং তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি খুব বিখ্যাতও হয়েছে। কিন্তু এগুলোর বেশিরভাগই আমার ভালো লাগেনা/লাগেনি (যেমন এখানে আলোচিত 'গুডফেলাস' বা 'এ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ')। তবে খুব ভালো লেগেছিল ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলার 'গডফাদার' ১,২,৩ (১৯৭২, ১৯৭৪, ১৯৭০), স্করসিসের 'ট্যাক্সি ড্রাইভার' (১৯৭৬) ও তারান্তিনোর 'পাল্প ফিকশন' (১৯৯৪)। পশ্চিমের নাগরিক বিচ্ছিন্নতা বা নৈতিক সঙ্কট জঁরার ছবিগুলোও আমাকে মুগ্ধ করেনা। হয়তো আমাদের মানসিক গড়ন অপশ্চিমা বলেই, ওই সংস্কৃতি হজম করতে কষ্ট হয়। মানে সিনেমা দেখার পর মনে প্রশান্তি আসেনা, অস্বস্তিকর অনুভূতি তাড়া করে। গদারের 'ব্রেথলেস' (১৯৬০) বা ফেলিনির 'লা ডলচে ভিটা' (১৯৬০) তাই আমার মন হরণ করতে পারেনা। একই ধাঁচের হংকঙের ছবি 'ডেইজ অব বিয়িং ওয়াইল্ড' তাই অস্বস্তিকর, অথচ একই পরিচালকের ২০৪৬ ভালো লাগে। এই ছবিতে নৈতিক/যৌন অস্থিরতার পাশাপাশি সায়েন্স ফিকশনের চমৎকার ব্যবহার ছবিটিতে ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়।
খুঁজতে খুঁজতে আরও অনেক নামকরা-অথচ-অদেখা ছবি ইউটিউবে পেয়ে যাবো আশা করি। ভালো লাগুক বা না লাগুক, অতি বিখ্যাত এইসব ছবিগুলো যাদের দেখার ইচ্ছে আছে/ছিল তারা ইউটিউব থেকে এগুলো দেখে নিতে পারেন। যা আমার ভালো লাগেনি, তা আপনার খুব ভালো লাগতেও পারে। কারণ প্রচুর মানুষের এইসব ছবি ভালো লেগেছে বলেই ছবিগুলো এত বিখ্যাত হয়েছে।
বলা দরকার পুরো ছবি সাধারণত কয়েকটি পার্ট-এ ভাগ করা থাকে। এই ছবিগুলোর সার্চ দিন এবং পার্ট ১ থেকে দেখা শুরু করুন। ভালো হেডফোন বা সাউন্ডবক্স ব্যবহার করুন, সাউন্ড ইফেক্টের জন্য। এনজয়!