বিষয়টা কেউ কেউ হয়তো জানেন, কিন্তু আমার মতো অনেকেই যে জানতেন না তা আমি নিশ্চিত। ধরুন কেউ একজন আপনার ইমেইল 'ক্র্যাক' করলো, এরপর আপনার এড্রেস বুকের সবাইকে মেইল করে জানালো যে আমি বিদেশে গিয়ে বিপদে পড়েছি, যে হোটেলে ছিলাম সেখানে ডাকাতি হয়েছে, টাকাপয়সা পাসপোর্ট সর্বস্ব খুইয়েছি, আমাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করুন ... ইত্যাদি। আপনার মেইল পেয়ে অন্যরা কী ভাববে ভাবুন তো। বেশিরভাগই খুব চিন্তিত হয়ে পড়বেন, খুব কম লোকই ভাববে যে এটা একটা ভুয়া মেইল। অনেকে আবার ভাবতে পারেন আপনি আবার এই প্রতারণা-ব্যবসা কবে শুরু করলেন? খুব সম্প্রতি আমার ক্ষেত্রে এটা ঘটেছে। এটা যাতে আর কারও না ঘটে, এজন্য বিষয়টা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করছি।
আমার ইয়াহু ও জিমেইলে দুইটা মেইল একাউন্ট আছে। তবে ইয়াহুটাই সবসময় ব্যবহার করতাম। একদিন ইয়াহু এডমিন থেকে একটা মেইল আসলো যে অব্যবহৃত মেইলগুলো তারা মুছে ফেলতে চায়, এজন্য আমার নাম, আইডি, পাসওয়ার্ড, জন্মতারিখ তাদের দ্রুত জানাতে হবে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জানালে ভালো। নয়তো আমার মেইল একাউন্ট অকার্যকর হয়ে পড়লে তারা দায়ী থাকবে না। আমি খানিক সন্দেহ নিয়েই তথ্যগুলো (পাসওয়ার্ডসমেত) জানালাম। সন্দেহ এজন্য ছিল যে ‘পাসওয়ার্ড’ চাচ্ছে, আর মেইলটার গ্রাফিকাল চেহারা ইয়াহুর স্ট্যান্ডার্ডে ছিলনা। কিন্তু অনেক মেইল উত্তরের তাড়া ছিল, এই তথ্যগুলো জানিয়ে দেই।
পাসওয়ার্ড জানিয়ে যে বোকামী করেছি, বুঝতেই পারছেন। দুই কি তিনদিন পরে আমার ছোটবোন গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে ঢাকা থেকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কোথায়? কানাডায় গিয়েছিলে কবে? কী হয়েছিল? ইত্যাদি। এরপরে আরও ফোন দেশ থেকে। আমি বুঝলাম সর্বনাশ হয়েছে। আমি ইয়াহু একাউন্টে ঢোকার চেষ্টা করলাম। ঢুকতে পারলাম না। তার মানে পাসওয়ার্ডও পরিবর্তন করা হয়েছে। আমি ফেসবুকে ঢুকলাম, ইয়াহু মেইল একাউন্ট দিয়েই ঢোকা গেল, কারণ এখানকার পাসওয়ার্ড আলাদা। প্রায় ষাটজন ফেসবুক ফ্রেন্ডকে জানানো গেল কী ঘটেছে। কেউ যেন হতভম্ব না হন, মাফটাফও চাইলাম। আর যাদের ইমেইল নম্বরগুলো মুখস্থ ছিল, সবার কাছে মা চেয়ে মেইল করলাম জিমেইল থেকে -- টাকাপয়সার ব্যাপার! সবচেয়ে আগে মেইল করলাম পিএইচডি সুপারভাইজার (কী সাংঘাতিক, তার কাছেও গিয়েছে 'টাকা চাহিয়া এই পত্র'), এরপরে দুটো ইয়াহুগ্রুপ মেইলে, যার সদস্য আমি। তারপর সিসি করে অনেককেই। কিন্তু আরও অনেকের কাছেই করা গেল না, কারণ বেশিরভাগেরই ইমেইল নম্বর মুখস্থ নেই, থাকার কথাও না। তাই আজ এখন পর্যন্ত অদ্ভূত সব ঘটনা ঘটে চলেছে। এর মধ্যে একটি খুব মজার।
আমার স্ত্রীর সাবেক সহকর্মী আহসান, তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, এখন অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটিতে উচ্চতর গবেষণায় গিয়েছেন। তিনি পাবনা ক্যাডেট কলেজের এক্স ক্যাডেট। তিনি রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের এক বন্ধুর কাছে মেইল করেছেন যে ফাহমিদুল হক নামক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষককে ও তার পরিবারকে তিনি ভালোমতো চেনেন। তাকে কানাডায় অবস্থানরত এক্স ক্যাডেটদের মাধ্যমে সহায়তা করা হোক। (আমিও রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের সাবেক ছাত্র)। সেই এক্স ক্যাডেট আবার রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের এক্স ক্যাডেটদের সংগঠন অরকা’র কমন মেইলিং লিস্টে মেইল করেন যে, ফাহমিদুল হক নামের কোনো এক্স ক্যাডেটকে কেউ চেনেন কিনা। আমার ক্যাডেট কলেজের বন্ধু ইফতেখার (সে আবার আমাদের ব্যাচের মেইলিং লিস্টের মডারেটর) দ্রুত মেইল করেন যে এইটা একটা অনলাইনের পরিচয় চুরির ঘটনা, এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই।
আরেকটি ঘটনা বলি। জাবির শিক্ষক মানস চৌধুরী লিখলেন আপনার (ক্র্যাকারের) অর্থপ্রার্থনার উত্তর দিয়েছিলাম, কীভাবে টাকাটা পাঠাতে পারি জানতে চেয়েছিলাম। 'আপনি' জানালেন আপনি এখন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় আছেন, কোনো এক বান্ধবীর সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন, টাকাটা তার একাউন্টে দেয়া যেতে পারে।
মেইলিং লিস্টে এক বন্ধু জানালেন যা ঘটেছে, তার নাম ফিশিং (phishing)। উইকিপিডিয়া থেকে ফিশিং বিষয়ে জ্ঞানলাভও করলাম। (সামহোয়ারের ইউনিকোড কনভার্টার ও লিংকিংটাও কাজ করছে না, নইলে দিয়ে দিতাম)
অনেকেই পরামর্শ দিলেন ইয়াহুর কাছে আবেদন করতে, আইডি ফেরত পাওয়া যাবে। আমি আবেদন করেছি, মেইলের পর মেইল লেনদেন করে অবশেষে নতুন পাসওয়ার্ড দিয়ে আমার আইডি ফেরত পেয়েছি। আমি এখন প্রিয় সাইবারপরিচয় ফিরে পাবার আনন্দে বিভোর।
নতুন পাসওয়ার্ড ফিরে পেয়ে আমি মেইলবক্সে ঢুকে দেখি ঐ টাকা চাহিয়া লিখিত পত্রের জবাব অনেকেই দিয়েছেন এবং জনাব ক্র্যাকার সবই পড়েছেন। সেই জবাবগুলো পাঠ করা আরেকটু বিচিত্র অভিজ্ঞতা। কেউ পুরোপুরি বিশ্বাস করেছেন, কেউ আংশিক বিশ্বাস করেছেন। কেউ আবার ইতোমধ্যে মূল ব্যাপারটা জেনে যাওয়ায় শেষ মেইলটা করেছেন গালি দিয়ে। সম্প্রতি পরিচিত এক বন্ধু জানিয়েছেন তিনি ইতোমধ্যে টাকাও পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছি, সত্যি সত্যিই টাকা পাঠিয়েছেন কিনা, এখনও উত্তর পাইনি। এ হলো যারা উত্তর দিয়েছেন, তাদের কথা। কিন্তু তার চাইতে অনেক বেশি মানুষ কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। তারা কে কীভাবে বিষয়টা দেখেছেন অজানা থেকে গেল। তাই আবার সবাইকে মেইল করলাম, সিসি দিয়ে, 'দিস ইজ ''রিয়েল'' ফাহমিদুল হক, গট মাই আইডি ব্যাক ...'।
নোট: প্রথমত এই পোস্টে আক্রমণকারী অপরাধীকে 'হ্যাকার' বলা হলেও, ইশতিয়াক জিকোর বরাতে মনে পড়লো এরা আসলে 'ক্র্যাকার' (অপরাধী হ্যাকার); 'হ্যাকিং' শব্দটি একসময় ইতিবাচক ছিল (যারা নেট প্রযুক্তিকে ম্যানিপুলেশন করেন সৃজনশীল বা মানবতাবাদী কাজে)। আমি এক্ষেত্রে 'ক্র্যাকিং' শব্দটি ব্যবহারে পুনঃপক্ষপাতী হলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০০৮ সকাল ১১:১৩