এই পোস্টটি আসলে নৃবিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদ রচিত 'বিশৃঙ্খল দৃশ্য: পৌরুষ, পাবলিক স্মৃতি ও সেন্সরশিপ' শিরোনামের একটি রচনার মুখবন্ধ। রেহনুমার লেখাটি বর্তমান সময়ে, বিশেষত আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে মার্কিনি আগ্রাসনের যুদ্ধসাংবাদিকতা এবং জরুরি অবস্থার সময়ে বাংলাদেশের সেন্সরশিপের ধরনকে, রেপ্রিজেন্টেশনের তত্ত্বের আলোকে ধরার চেষ্টা করেছে। গুরুত্ব বিবেচনা করে, শুধু এই রচনাটি নিয়ে যোগাযোগ পত্রিকা ও দৃক আলোকচিত্র গ্রন্থাগার লিমিটেড-এর যৌথ উদ্যোগে একটি বিশেষ প্রকাশনা অচিরেই বাজারে আসছে। মুখবন্ধটি লিখেছেন যোগাযোগ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক আ-আল মামুন, যিনি সদ্য কারামুক্তির পর তার এক্টিভিজম ও একাডেমিক কাজ নিয়ে পুনরায় সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।
...
খোদ বাস্তবতা কখনোই আমাদের কাছে এসে হাজির হয় না, যদিও আমরা বাস্তবেই বসত করি। বাস্তবতাকে আমরা বুঝি এবং অপরকে বুঝাতে চেষ্টা করি রেপ্রিজেন্টেশনের মাধ্যমে। রেপ্রিজেন্টেশনের প্রধান বাহন ভাষা। ভাষা ছাড়া আমরা যেমন কোনোকিছু ভাবতে পারি না, তেমনই কোনো ভাব প্রকাশ করতেও পারি না। ভাষা একটা সংকেত ব্যবস্থা, যাতে আমাদের সকলেরই এ্যকসেস থাকে। ভাষার সাথে সাথে এবং ভাষার সহযোগিতায় প্রতিটি সংস্কৃতিতে আরও কিছু সংকেত ব্যবস্থা ক্রিয়াশীল থাকে যা সম্মিলিতভাবে আমাদের উপলব্ধির জগত তৈরি করে। এই সংকেত ব্যবস্থাগুলোর মাধ্যমেই জগতের যাবতীয় বিষয়ের রেপ্রিজেন্টেশন ঘটে।
বর্তমান দুনিয়ার রেপ্রিজেন্টেশনে গণমাধ্যম কেন্দ্রীয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে। গণমাধ্যম বাস্তবতা উৎপাদন করে। মিডিয়ায় কাক্সিক্ষত বাস্তবতার উৎপাদন ঘটাতে এবং অনাকাক্সিক্ষত বাস্তবতা গোপন করতে, সাধারণ জনতার চোখের আড়ালে রাখতে নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠীগুলোর তীক্ষ্ণ নজরদারি থাকে। নজরদারির একটা উপায় হলো সেন্সরশিপ, সর্বশেষ উপায়। যখন অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতার প্রকাশ রুদ্ধ করার অপরাপর পথ খোলা থাকে না তখনই সেন্সরশিপের আশ্রয় নিতে হয়। তা না-হলে সাধারণত অগণিত স্তরে বিন্যস্ত গেটকিপিং ব্যবস্থার সুবাদেই মিডিয়াতে কাঙ্ক্ষিত বাস্তবতার উৎপাদন ঘটতে থাকে। এর প্রকট চর্চা দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেদেশের মিডিয়া স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রচারণা-ব্যবস্থার কায়দায় কাজ করে না। বরঞ্চ তারা প্রাণবন্ত বিতর্ক, সমালোচনা ও ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ দেয়জ্জএমনকি উৎসাহিতও করেজ্জযতোক্ষণ পর্যন্ত সেগুলো বিশ্বস্তভাবে পূর্ব-নির্ধারিত এলিট ঐক্যমত্যনির্ভর মূলনীতিগুলোর সীমানার মধ্যে থাকে। গণমাধ্যম সেদেশে কার্যকর ও ক্ষমতাধর মতাদর্শিক প্রতিষ্ঠান, যা বাজার শক্তিসমূহ, সাংবাদিকদের আত্মস্থকৃত পূর্বানুমান ও সেল্ফ-সেন্সরশিপের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠান-সমর্থক প্রপাগান্ডা চালায়। আর সাম্প্রতিক দশকগুলোতে জাতীয় পর্যায়ে টেলিভিশন নেটওয়ার্কের বিকাশ, গণমাধ্যমের অধিকতর কেন্দ্রীভবন, সরকারি মালিকানাধীন রেডিও ও টেলিভিশনের ওপর দক্ষিণপন্থীদের চাপ বৃদ্ধি, এবং সেইসাথে জনসংযোগ ও সংবাদ-ব্যবস্থাপনার আওতা ও পরিশীলন বৃদ্ধির ফলে এই প্রচারণা-ব্যবস্থা খুবই দক্ষ হয়ে উঠেছে। এভাবেই কাক্সিক্ষত বাস্তবতা উৎপাদনের কাজ বহুলাংশে সম্পন্ন হয়। ফলত 'মুক্ত' মিডিয়ার মিথ তৈরি হয়, যদিও তা কোনোভাবেই মুক্ত নয়। আর এর সাথে সাথে ব্যাপকমাত্রায় সেন্সরশিপেরও প্রয়োগ ঘটে। নিয়মিত। বিদেশের মাটিতে মার্কিনি যুদ্ধগুলোতে পুলভুক্ত এবং/বা প্রোথিত সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীর মাধ্যমে মিডিয়ায় ইতিবাচক ইমেজ নির্মাণের চেষ্টা এবং যুদ্ধের নৈতিকতা চ্যালেঞ্জকারী ও নেতিবাচক দিকগুলো গোপন করার প্রচেষ্টা একইসাথে চলতে থাকে। 'বিটুইন দ্য লাইন' পড়তে শিখলে সংবাদ-ভাষ্য ও -ছবির এরূপ পাঠোদ্ধার করা যায়।
৩০শে আগস্ট বিকেল বেলা কড়া পুলিশ প্রহরাধীন অবস্থায় 'আদালত প্রাঙ্গণে এজলাসে যাবার আগে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ এবং সেনা সদস্যদের আত্মমর্যাদায় আঘাত পড়ার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।' (ইত্তেফাক ৩১শে আগস্ট ২০০৭) তিনি জোর করে প্রেসের সাথে কথা বলার সুযোগ করে নিয়েছিলেন নাকি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সুযোগ করে দিয়েছিল সেটা ভিন্ন জিজ্ঞাসা। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, এটা ছিল একটা বিরল মুহূর্ত যা পাঠক-দর্শকদের মনে প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে, বিস্মিত করে, হয়তো কোনো প্রশ্নের উত্তরও পেশ করে। কে হাজির করলো তার চেয়ে বড় প্রশ্ন কেন পাঠক-দর্শকের অভিজ্ঞানে এই টেক্সট হাজির করার প্রয়োজন হলো। গণমাধ্যমে যে টেক্সট -- বক্তব্যের কথাগুলো, ছবি, ভিডিও ফুটেজ -- উৎপাদিত হলো সেটাকে আমরা কীভাবে পাঠ করবো? উপরিতলে এই টেক্সট যে অর্থ নির্দেশ (ডিনোটেট) করে, টেক্সটের গভীরেও কি সেই অর্থ থাকে নাকি আরও অনেক অর্থের ইঙ্গিতময়তা লুকিয়ে থাকে? আমাদের উপলব্ধির জগতে এই টেক্সট কী অর্থবোধকতা তৈয়ার করতে চায়? এই টেক্সট কি স্বয়ংসম্পূর্ণ সয়ম্ভু নাকি এই টেক্সট ব্যাখ্যার জন্য আমাদেরকে অপরাপর টেক্সটের দ্বারস্থ হতে হয়?
বার্তার ভিতরে বার্তা পরিবেশনকারীর আকাক্সক্ষা লুকিয়ে থাকে -- যেমন পণ্যের বিজ্ঞাপনের ভিতরে লুকিয়ে থাকে প্রত্যক্ষভাবে পণ্য বিক্রয়ের আকাঙ্খা, এবং পরোক্ষে একটা ভোক্তা সমাজ নির্মাণের আকাঙ্খা। বার্তা হিসেবে ভিস্যুয়াল রেপ্রিজেন্টেশনের ভিতরেও আমরা এরূপ আকাঙ্খার অনুসন্ধান করতে পারি। বিপরীতের সাপেক্ষে, সম্পর্কের সাপেক্ষে অর্থ তৈরি হয়। যেমন, আলো আমাদের কাছে কেবল তখনই বোধগম্যতা তৈরি করতে সক্ষম হয় যখন আমরা অন্ধকারের সাথে তুলনা করতে পারি। সেন্সর-করার অর্থও এর বিপরীত সেন্সর-না-করার সাথে সম্পর্কিত। কাঙ্ক্ষিত ইমেজের বারম্বার পুনরুৎপাদন এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ইমেজের উৎপাদন রুদ্ধকরণ মিলে হয় প্রত্যাশিত বাস্তবতা নির্মাণ। নৃবিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদ তাঁর প্রবন্ধে সাম্প্রতিক কয়েকটি ছবি বিশ্লেষণের মাধ্যমে নির্মিয়মান বাস্তবতার ভিতরে লুকিয়ে-থাকা আকাঙ্খার সন্ধান করেছেন, অপরাপর অর্থের ইঙ্গিতগুলো প্রকাশ করেছেন।
এই প্রকাশনার উদ্দেশ্য কোনো পক্ষ-বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ নয়, বরং বার্তার রেপ্রিজেন্টেশন কীভাবে অর্থ তৈরি করে তা অনুসন্ধান, টেক্সটের ভিতরে কীভাবে ক্ষমতা ও রাজনীতি সক্রিয় থেকে জ্ঞান উৎপাদন করে পদ্ধতিগতভাবে তা দেখা। এটাই যোগাযোগ অধ্যয়নের মূখ্য উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অনুসন্ধানের আওতায় নিতে হয়: বার্তা, বার্তার উৎপাদক, পরিবেশনের মাধ্যম ও উদ্দিষ্ট দর্শকশ্রোতা। এগুলো পরস্পর সাপেক্ষ, আন্তনির্ভরশীল এবং এই পারস্পরিকতার ভিতর দিয়েই অর্থ উৎপাদিত হয়। আর অবশ্যই, অর্থ উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটে নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিসরে।
যোগাযোগ পত্রিকার গত সংখ্যায় (সংখ্যা ৮; ২০০৭) মুখ্য মনোযোগ ছিল রেপ্রিজেন্টেশন বিশ্লেষণের তত্ত্ব ও পদ্ধতি বুঝবার দিকে। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি থাকাকালে ২০০৭ এর নভেম্বরে আমি এ লেখাটি হাতে পাই। পাঠ করে মনে হয়, যথাশিঘ্র এটি প্রকাশ করে পাঠকের হাতে তুলে দেওয়া কর্তব্য। বিকল্প সমাজভাবনা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে মিডিয়া এ্যক্টিভিজম-এ সক্রিয় দৃক পূর্ণ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। সেইসূত্রে যোগাযোগ পত্রিকা দৃক আলোকচিত্র গ্রন্থাগার-এর সাথে যুক্তভাবে রেহনুমা আহমেদের 'বিশৃঙ্খল দৃশ্য : পৌরুষ, পাবলিক স্মৃতি ও সেন্সরশিপ' প্রকাশনায় উদ্যোগী হয়েছে।
আ-আল মামুন
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০০৮ রাত ১১:২৫