দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসি বাহিনীর দখলে ইউক্রেন, তখন ইউক্রেন নাগরিক ভ্যাসুলি আব্রামোভিচ বাকুতিন তাদের দোসর-দালাল হিসেবে নিজামী-মুজাহিদ-সাঈদীদের ভূমিকা পালন করে একটি শিশুসহ ইহুদি পরিবারকে হত্যা করে এবং জামার্নির শিবিরে ইউক্রেনীয় তরুণীদের প্রেরণ করে। এছাড়াও ইউক্রেনের ৯ জন মুক্তিসেনাকে হত্যা করে। এভাবেই সে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে মানবতাবিরোধী কাজ করেছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর নাম গোপন করে বদর বাকুতিন অস্ট্রিয়ায় আত্মগোপন করেছিল।
যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সদ্য কারাদ-প্রাপ্ত কম্পোডিয়ার খেমাররুজ নেতা কাইং গুয়েক ইভ ওরফে দুকও চায়নায় ১৯৭৯ থেকে এক যুগ পালিয়ে ছিলেন, পরে ১৯৯৯ সালে এক আইরিশ সাংবাদিক যুদ্ধাপরাধ দুকের প্রকৃত পরিচয় ফাঁস করে দেন এবং তিনি গ্রেফতার হন। (দ্র : এপিপি, রয়টার্স, বিবিসি, ২৬ জুলাই ২০১০)
ইউক্রেন রাজাকার-আলবদর বাকুতিন পাঁচ বছর পর ১৯৫১ সালে কৌশলে কানাডায় ঢুকে রিফিউজি সাজে এবং মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে রুমানীয় নাম ধারণ করে ওয়াসিল বাকুতি।
এ সম্পর্কে নজরুল মিন্টু তার 'উত্তর আমেরিকার চালচিত্র' গ্রন্থে লিখেছেন : ১৯৮০ সালের প্রথম দিকে সাইমন উইজেনথাল ইনস্টিটিউট (দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইহুদি নিধনে জড়িতদের খুঁজে বের করার জন্য জন্য একটি সংগঠন) উলি্লখিত ব্যক্তিটি কানাডায় বসবাস করছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করে কানাডীয় সরকারকে তথ্যাবলি প্রদান করে। যেহেতু সে অন্য নামে কানাডায় আশ্রয় প্রার্থনা এবং ১৯৫৯ সালে নাগরিকত্ব লাভ করে সেহেতু কানাডীয় কর্তৃপক্ষ এতদিন পর্যন্ত তাকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু সমপ্রতি ইমিগ্রেশন রেকর্ড পত্রের ব্যাপক অনুসন্ধানের পর কানাডীয় সরকার এ ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে সমর্থ হয়। প্রাপ্ত তথ্যাবলির ওপর ভিত্তি করেই মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠনের দায়ে এ রাজাকারটির নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে কানাডা সরকার তাকে বহিষ্কার করার জন্য আদালতে মামলা দায়ের করেছে। (কানাডায় যুদ্ধাপরাধী/ পৃষ্ঠা ১৪০, প্রকাশক : দেশ-বিদেশ পাবলিকেশন্স, কানাডা ২০০৯)
এদিকে একাত্তরের অনেক যুদ্ধাপরাধী (যুক্তরাজ্যে চৌধুরী মঈনুদ্দিনসহ তিনজন এবং যুক্তরাষ্ট্রে আশরাফুজ্জামান খান) বিদেশে অবস্থান করছে, তারা এসব দেশের নাগরিকত্ব পেয়েছে। তবে কানাডায় কোন যুদ্ধাপরাধী আছে কি-না তা এখনো জানা যায়নি, কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার খুনি রয়েছে।
উল্লেখ, ২০০৬ সালে দেলোয়ার হোসেন সাঈদী টরেন্টোতে এসেছিল। তখন তাকে জুতাপেটা করা হয়। এ সচিত্র সংবাদ স্থানীয় সাপ্তাহিক বাংলা কাগজে ছাপা হয়। ২০০৯-এ টরেন্টোতে এসেছিল মওলানা আবুল কালাম আজাদ। তখন প্রবাসীরা তীব্র শীত উপেক্ষা করে প্রতিবাদ জানায়। ২০০৬-এ দেলোয়ার হোসেন সাঈদী লন্ডনে অনুরূপভাবে বিক্ষোভের মুখে পড়ে। সে সময় ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা 'ডেইলি সান' তার ২০০৬-এর ১৪ জুলাই সংখ্যায় তাকে জানোয়ার হিসেবে উল্লেখ করেছিল। অবজারভার, টাইমস, মিরর, চ্যানেল ফোর তাকে নিয়ে রিপোর্ট করেছিল। এবং সাঈদী পালিয়ে বেঁচে ছিল সেই সময়। (দ্র : বাংলাদেশী যুদ্ধাপরাধী বাঁচাতে বিলেতি পাঁয়তারা/ ফারুক যোশী, দৈনিক সমকাল, ৩ আগস্ট ২০১০ ঢাকা)।
গত ২৪ জুন ২০১০-এ ঢাকাস্থ দৈনিক 'সংবাদ'-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কানাডার বিশিষ্ট আইনজীবী, মানবাধিকার আন্দোলনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা এবং আন্তর্জাতিক রিফিউজি আইন বিশেষজ্ঞ উইলিয়ান শ্লোন বললেন, বিশ্ব সম্প্রদায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাংলাদেশকে সক্রিয় সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত। তবে এজন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশকে। বিদেশিরা বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে, আইনি ও আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু বিচার করতে হবে বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশের মানুষকেই। যেখানে বিদেশিদের কোন হাত নেই, থাকা উচিতও নয়।
যুদ্ধাপরাধের বিচারে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনকে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ মনে করে উইলিয়ান শ্লোন বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার অসম্ভব কিছু নয়। ... মূলত অপরাধের তথ্য-প্রমাণ তুলে আনাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি সরকারকে সর্তকতার সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে নিতে হবে। সরকারের নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে এ বিচার সম্পন্ন করতে না পারলে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় সরকার পাল্টে গেলে তখন সংবিধান পরিবর্তন করে যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করেও দেওয়া হতে পারে। তাই চলতি মেয়াদের মধ্যেই যথার্থ তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
যুদ্ধের পর বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে দীর্ঘ সময় কোন নেতিবাচক প্রভাব রাখবে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে শ্লোন জানান, আর্জেন্টিনায় নোবেল বিজয়ী এডলফ প্যারেজ ইসকুইভ ১৪ বছর পরে নির্যাতনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে গত সপ্তাহে বিচার পেয়েছেন। এখানে কতটা সময় বিলম্ব হলো সেটি বিষয় নয়, বিষয় হচ্ছে আর্জেন্টিনা, চিলি, রুয়ান্ডা, নুরেমবার্গ ট্রায়াল, কম্বোডিয়ায় এ জাতীয় অপরাধের বিচার হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিচার ৭০ বছর পরে করা সম্ভব হলে মাত্র চার দশকের মাথায় বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা যাবে না এমন কথার কোন মূল্য নেই।
ঢাকায় গত ২০ জুন ২০১০-এ তিনটি সংগঠন আয়োজিত এ সংক্রান্ত এক ত্রিমহাদেশীয় সম্মেলনে উত্তর আমেরিকার জুরিস্ট এসোসিয়েশনের সাবেক প্রধান অ্যাটর্নি উইলিয়াম শ্লোন আরও বলেছেন, ... মৃত্যুদ- না দিয়ে যদি যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই অপরাধীরাও কারাগার থেকে বেরিয়ে আসবে, অতীতে এমনটি ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয়ও আলোচিত হয়েছে, সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের সার্বভৌমসত্তা এবং নিজস্ব আইনের ধারাবাহিকতা। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় মৃত্যুদ-ের বিধান থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার বিরোধিতা করার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের সার্বভৌমসত্তাকে অশ্রদ্ধা করা।