পূর্ববর্তী দুইটি প্রবন্ধে আমি নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের প্রয়োগ/অপপ্রয়োগ এবং এই আইনের অধীন মামলা/অপরাধ বৃদ্ধির কারণ ও প্রকৃতি বর্ণনা করেছি। বর্তমান প্রবন্ধে জেলার পুলিশ নেতৃত্ব ও তৃণমূল পর্যায়ে কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য কিছু করণীয় নির্দেশ করেছি। এই সব নির্দেশনা পালন করলে নারী ও শিশু নির্যাতনের অপরাধ ও একই সাথে এই আইনের অধীন রুজুকৃত মামলার সংখ্যা হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়।
১. মাঠ পর্যায়ে কর্মরত পুলিশ অফিসার বিশেষ করে থানায় কর্মরত পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর, ইন্সপেক্টর ও থানার অফিসার-ইন-চার্জগণ ও অন্যান্য ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারদের নিয়ে পুলিশ সুপার বিশেষ কর্মশালার আয়োজন করতে পারেন। কারণ, সমস্যার কাছাকাছি যারা কাজ করেন, তারাই সমস্যা সমাধানের আসল নিয়ামক হতে পারেন। সাধারণত প্রতিমাসে পুলিশ সুপার থানার অফিসার-ইন-চার্জ ও অন্যান্য ঊর্ধ্বতন অফিসারদের নিয়ে অপরাধ সভা করে থাকেন। এখানে অপরাধের ঘাটতি-বাড়তি, সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হলেও অপরাধ সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে তেমন কোন পথ নির্দেশনা থাকে না। তাছাড়া যারা মাঠ পর্যায়ে অপরাধকর্মগুলো মোকাবেলায় প্রাথমিক সাড়া দিয়ে থাকেন, সেই সাব-ইন্সপেক্টরগণ সেই মিটিং এ থাকে না।
২. কমিউনিটিতে বিরাজমান নারী নির্যাতন সমস্যাগুলো স্বপ্রণোদিত উপায়ে সংগ্রহ করতে হবে। এই ক্ষেত্রে থানায় মামলা করতে আসুক বা না আসুক, যে পরিবারে বা গ্রামে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে সেই গ্রামের চৌকিদার, মহল্লাদার, কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামের সদস্যগণ বা অন্য কোন ভাবে প্রত্যেকটি ঘটনাই তালিকাভূক্ত করতে হবে। এই তালিকাভূক্তি মানে থানায় মামলা করা নয়। জিডিতে নোট দিয়ে কিংবা নোট না দিয়ে পৃথক কোন রেজিস্ট্রারে এই তালিকাভূক্তির কাজ সম্পন্ন করা যেতে পারে।
৩. এই তালিকা থেকে নির্বাচিত ঘটনাগুলো নিয়ে পুলিশ স্বপ্রণোদিত ব্যবসস্থা গ্রহণ করবে। এ ক্ষেত্রে ঘটনার সাথে জড়িত (ঘটনার পক্ষে বা বিপক্ষে ) ব্যক্তিদের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে প্রণোদনামূলক উপদেশদান, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের থানায় ডেকে নেওয়া, ঘটনাস্থল পরিদর্শন এমনকি মামলা রুজুকরণ পর্যন্ত হতে পারে। পুলিশ উদ্যোগী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা গ্রহণ কাজটি অনেকে পছন্দ করবেন না। তারা যুক্তি দিতে পারেন, এমনিতেই মামলার যন্ত্রণায় বাঁচি না, তারপরে আবার গায়ে পড়ে মামলাগ্রহণ? কিন্তু, কয়েকটি মাত্র ক্ষেত্রে এই কাজ করলে মানুষ একটি বার্তা পেয়ে যাবে, যে নির্যাতনের ঘটনায় পুলিশ নিজ উদ্যোগেও মামলা গ্রহণ করে। এতে একটি প্রতিরোধমূলক অবস্থার সৃষ্টি হবে।
৪. থানায় আগত ভূক্তভোগীদের কোন আবেদনই নিতে অস্বীকার করা যাবে না। কারণ, পুলিশ যেসব মামলা থানায় নিতে অস্বীকার করে কিংবা যে ভূক্তভোগীদের থানায় খুব একটা পাত্তা দেওয়া হয় না তাদের প্রায় সবাই ট্রাইব্যুনালে গিয়ে মামলা করে। এই মামলাগুলো শেষ পর্যন্ত থানায় এসে অপরাধ পরিসংখ্যান ভারি করে তোলে।
৫. নারী নির্যাতনের অপরাধের ঘটনাগুলোর খবর সংগ্রহ, আবেদন গ্রহণ, জিডি করণ ইত্যাদি কাজ সম্পাদনের জন্য একজন পৃথক অফিসারকে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। কোন ভূক্তভোগিই যেন নারী শিশু নির্যাতনের ঘটনা পুলিশের কাছে উত্থাপন কতে এসে ফেরত না যায়। অভিযোগ প্রাপ্তিমাত্রই যে নিয়মিত মামলা রুজু করতে হবে এমন কোন কথা নেই। এক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৪ ধারাকে বিবেচনাপ্রসূতভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
৬. নারী নির্যাতনের ঘটনার অভিযোগ পাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব কোন পুলিশ অফিসারকে ঘটনাস্থলে প্রেরণ করতে হবে। ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশ অফিসার ঘটনার সকল খুঁটিনাটি বিষয় জেনে ক্ষেত্রমতে ঘটনাস্থলেই নিজে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিতে পারেন, স্থানীয় ইউপি সদস্য/ চেয়ারম্যান, কোন গণ্যমান্য ব্যক্তি কিংবা কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামকে মধ্যস্থতার জন্য অনুরোধ করতে পারেন। প্রয়োজনে দুই পক্ষকে থানায় ডাকা যেতে পারে এবং অবস্থা মীমাংসারযোগ্য না হলে মামলা রুজু করা যেতে পারে।
৭. কোন ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসার জানুন আর নাই জানুন; মানুক আর নাই মানুন থানা পুলিশকে ঘিরে থাকে একটি বড় দালাল চক্র। কোন পুলিশ অফিসার তার নিজের অধিক্ষেত্রের থানায় কোন দালাল নেই বলে দাবী করতে পারেন। কিন্তু, আপনারা যে এলাকার সন্তান সেই স্থানীয় থানায় দালাল চক্রের উপস্থিতি নিশ্চয়ই অনুভব করতে পারেন। এই দালাল চক্র থানার একটি বড় সংখ্যক মামলাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তারা প্রথমে অর্থের বিনিময়ে ভূক্তভোগীদের সাথে পুলিশের সংযোগ ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দেন। যে ঘটনায় থানায় মামলা হওয়ার কথা নয়, দালালদের চক্রে পড়ে সেই ঘটনায় পুলিশ মামলা গ্রহণ করে। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মামলাগুলোর সিংহভাগই দালালদের মাধ্যমে থানায় উপস্থাপিত হয়। তাই, থানা থেকে দালাল তাড়াতে হবে।
৮. নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ১৭ ধারায় মিথ্যা মামলা রুজুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে ধারাটিতে কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে। এখানে বলা হয়েছে কোন ব্যক্তির লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল —- সংঘটিত অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ ও মামলার বিচার করিতে পারিবে । এ থেকে মনে হতে পারে কেবল সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরাই মিথ্যা মামলার প্রতিকারের জন্য ট্রাইব্যুনালে যাবেন। অনেক পুলিশ অফিসার দণ্ড বিধির ২১১ ধারার সাথে এর পার্থক্য করে ফেলেন। তারা মনে করে পুলিশ নয়, বাদীকেই (যিনি বা যারা আসামী ছিলেন) এই ধারায় প্রতিকারের জন্য আদালতে যেতে হবে। কিন্তু, জেলা পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে আমি বুঝেছি এই ধারায় পুলিশ অফিসারের আদালতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে অনুরোধ বা আবেদন করতে কোন বাধা নেই। তাই, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে রুজুকৃত মামলাগুলো মনিটর করে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মিথ্যা মামলাগুলোর বাদীদের বিরুদ্ধে আইনের ১৭ ধারা অনুসারে প্রসেস শুরু করার জন্য পুলিশকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে হবে। এই কাজের জন্য পুলিশ সুপার সংশ্লিষ্ট সার্কেল এএসপিদের বা অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে বিশেষভাবে দায়িত্ব দিতে পারেন। এর সাথে কোর্ট ইন্সপেক্টরকেও সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।
৯. মামলা রুজুর ক্ষেত্রে সব ধরণের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। অভিজ্ঞতাই বলে ব্যস্ত থানাগুলোতে পুলিশ সহজে মামলাগ্রহণ করতে চায় না। মামলা না নেওয়ার ক্ষেত্রে মিথ্যা, অসত্য, উদ্দেশ্য প্রণোদিত ইত্যাদি বিষয়কে সামনে আনা হয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতা পুলিশকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে। অন্যদিকে, অনেক মামলাই রুজু করা হয় যেগুলোর মধ্যে প্রমাণ করার মতো তেমন সাক্ষ্য প্রমাণ নেই। মামলার বাদী দরিদ্র হলে তার মামলা যতদূর সম্ভব পরিহার করা হয়। অন্যদিকে অবস্থাসম্পন্ন বাদীর মামলা দ্রুত রুজু করা হয়। অভিযুক্ত বা আসামী দরিদ্র হলে সে অভিযোগও মামলায় পরিণত হওয়া দূরূহ। অপরপক্ষে ধনী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কোন প্রকার বাছ-বিচার না করেই মামলায় পরিণত হতে পারে।
১০. অন্যান্য মামলার মতো নারী নির্যাতনের মামলার ক্ষেত্রেও স্থানীয় রাজনীতিবিদ, আমলা এমনকি ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদেরও বিশেষ চাপ লক্ষ্য করা যায়। একজন স্বল্পবুদ্ধি সম্পন্ন মধ্যবয়সী মহিলা বৃদ্ধ স্বামীর বাড়ি থেকে অভিমান করে স্বেচ্ছায় চলে গেছেন। গ্রামের মানুষ সবাই দেখেছেন স্কুটারে করে তার চলে যাওয়া। চলে যাওয়ার আগে তিনি ক্ষেত থেকে কিছু সবজিও সংগ্রহ করেছিলেন। তার সতিনের ঘরের ছেলের বউ তাকে চলে না যাবার জন্য রাস্তায় গিয়ে প্রকাশ্যে অনুরোধও করেছিলেন। কিন্তু, একজন ঊর্ধ্বতন আমালার তদবিরে এই ঘটনার জন্য নোয়াখালী জেলায় আমাদের মহিলার বৃদ্ধ স্বামী, তার ছেলেগণ ও পুত্রবধুদের নামে অপহারণ মামলা রুজু করতে হয়েছিল। মামলা রুজুর পর সবার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিলের জন্যও ছিল প্রচণ্ড চাপ। অবশেষে, এই মহিলাকে উদ্ধার করা হলে তিনি জবানবন্দি দেন, তিনি কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে তার ভাতিজার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা কমাতে গেলে এই জাতীয় চাপের কাছে নতি স্বীকার করা চলবে না।
১১. নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে কর্মরত সরকারি ও বেসরকারি আইনজীবী তাদের সহকারীগণ (মোহরার) এই আইনে মামলা বৃদ্ধির ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।নিয়ে পুলিশ সুপার বৈঠক করে এই বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সহায়তা প্রার্থনা করা যেতে পারে।
মোঃ আব্দুর রাজ্জাক