■■"শবে কদর শবে বরাত
বছরের সেরা এ দুই রাত"- এটা ছিল আমাদের সময়ের মাদরাসার প্রথমশ্রেণীর বাংলা বইয়ের পঙ্ক্তি (এখন হয়তো নেই)।
এরকম শবে বরাতকে শবে কদরের সাথে মিলিয়ে ফেলা- এটা যেমন চরম আপত্তিকর বিষয়। তার চেয়েও অনেক বেশি উদ্বিগ্নের বিষয় হচ্ছে, শবে বরাত নিয়ে ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্টে প্রচলিত বিদ'আহ সমূহ। বছরের আর কোনো দিনকে উপলক্ষ্য করে এতো অনৈসলামিক কাজ হয় না। এখন অবশ্য শবে মি'রাজ উপলক্ষ্যেও বহুত নব-চিজ দেখা যাচ্ছে। শুধু ভারতবর্ষ বললে ভুল হবে, পৃথিবীজুড়েই বেদ'আতের ছড়াছড়ি। একেক এরিয়ায় একেক ধরণ।
শা'বান মাসের শুরু থেকে ঘরে ঘরে শিরনি বিতরণের রেওয়াজ আমাদের দেশে কত শতাব্দী ধরে, জানা নেই। ধনী-গরীব সবাই করে। মনে হয়, এটাকে ইসলাম ফরয করে দিয়েছে। বরাতের রাতে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে, নির্দিষ্ট সুরা/দোয়ার মাধ্যমে বরাতের নামায পড়া। সম্মিলিত হয়ে মসজিদে ওয়াজ, মিলাদ ইত্যাদি করা।
সবচে' আশ্চর্য্যের বিষয়, শবে বরাতের মিছিল। আমাদের অঞ্চলে রাতে আগরবাতি জ্বালিয়ে মশাল মিছিলের মত মিছিল দিতাম-
"আমার বরাত তোমার বরাত
শুবে বরাত শুবে বরাত,
আমার দিন তোমার দিন
নেকির দিন নেকির দিন।"
এসব ছিল অনেক বাড়াবাড়ি। উলামা-এ-কেরাম যে কেন তখন বাঁধা দেন নি, এখনো উত্তর পাইনি!
■■এখন সমস্যাটা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। একদিকে বিদ'আতিরা ঝিনুককে কাদা মাখিয়ে মূল্যহীন করে তুলছে, অন্যদিকে কিছু লোক ঝিনুকে মুক্তার অস্তিত্বই অস্বীকার করছে!
দ্বিতীয় দলের মতে, শবে বরাত কন্সেপটাই একটি ফাও, ভাওতাবাজি এবং ইসলাম বহির্ভূত। তারা বলেন- এই রাতের ফযিলত বা মহিমায় কোনো দলিল কোর'আন- হাদিসে নেই। এটি ইসলাম বিক্রি করে যারা খায়, এমন সব আলেমদের নব সংযোজন।
বিরোধিতা আবার দুটি কারণে করা হচ্ছে। এক; শুধুই বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা। দুই; না জানার কারণে। দ্বিতীয় কারণে যারা "শবেবরাত" বলতে কিছুই পান না তাদের জন্য হাদিস থেকে কিছু দলিল বর্ণনা করা হল।
☆১ম হাদীসঃ
ﻋﻦ ﻣﺎﻟﻚ ﻣﻦ ﻳﺨﺎﻣﺮ , ﻋﻦ ﻣﻌﺎﺫ ﺑﻦ ﺟﺒﻞﻋﻦ ﺍﻟﻨﺒﻰ, ﻗﺎﻝ : ﻳﻄﻠﻊ ﺍﻟﻠﻪ
ﺍﻟﻰ ﺧﻠﻘﻪ ﻓﻰ ﻟﻴﻠﺔ ﺍﻟﻨﺼﻒ ﻣﻦ ﺷﻌﺒﺎﻥ , ﻓﻴﻐﻔﺮ ﻟﺠﻤﻴﻊ ﺧﻠﻘﻪ ﺇﻻ ﻟﻤﺸﺮﻙ ﺃﻭﻣﺸﺎﺣﻦ
মুআয ইবনে জাবাল বলেন, নবী করীম(ﷺ)ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।
(হাদীসটির সনদ সহিহ) ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে হিব্বান তাঁর সহীহ ইবনে হিব্বানে উদ্ধৃত করেছেন। এটি এই কিতাবের ৫৬৬৫ নং হাদীস। এ ছাড়া ইমাম বাইহাকী (রহঃ) শুআবুল ঈমানে (৩/৩৮২, হাদীস ৩৮৩৩); ইমাম তাবরানী আলমুজামুল কাবীর ও আলমুজামুল আওসাতে বর্ণনা করেছেন।
☆☆২য় হাদিসঃ
হযরত আলা ইবনুল হারিস (রহঃ) থেকে বর্ণিত, হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাতে নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হল তিনি হয়ত মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশাঞ্চ অথবা বলেছেন, ও হুমাইরা, তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম- না, ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার এই আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। নবীজী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম- আল্লাহ ও তার রাসুলই ভাল জানেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন ইরশাদ করলেন,
هذه ليلة النصف من شعبان ان الله عزو جل يطلع على
عباده فى ليلة النصف من شعبان فيغفر للمستغفرين
ويرحم المشترحمين ويؤخر اهل الحقد كماهم
‘এটা হল অর্ধ শাবানের রাত (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত)। আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনযোগ দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।‘ (শুআবুল ঈমান, বাইহাকি ৩/৩৮২-৩৬৮)। ইমাম বাইহাকি (রহঃ) এই হাদিসটি বর্ণনার পর এর সনদের ব্যাপারে বলেছেন,
هذا مرسل جيد(ইহা উত্তম মুরসাল(
☆☆৩য় হাদিসঃ
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে ঃ
عن على بن ابى طالب رضى الله عنه قال : قال رسول اللَّه إذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا نهارها, فإن الله ينزل فيهالغروب الشمس الى سماء الدنيا, فيقول : ألا من مستغفر فاغفر له، ألا مستزرق فأرزقه، ألا مبتلى فأعافيه ألا كذا ألا كذا, حتى يطلع الفجر
হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, নিসফ শাবানের রাত (চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে তখন তোমরা রাতটি ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোযা রাখো। কেননা, এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোন ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিযিক প্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দেব। এভাবে সুব্হে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ তা'আলা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদের ডাকতে থাকেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩৮৪)
এই বর্ণনাটির সনদ যয়িফ। কিন্তু মহাদ্দিসীন কেরামের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হল, ফাযায়েলের ক্ষেত্রে যয়িফ হাদিস গ্রহণযোগ্য। তাছাড়া শাবান মাসে বেশি বেশি নফল রোযা রাখার কথা সহিহ হাদিসে এসেছে এবং আইয়ামে বিয অর্থাৎ প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখার বিষয়টিও সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
অতএব, লাইলাতুল বারাত উপলক্ষ্যে যাচ্ছেতাই করা যেমন হারাম, ঠিক তেমনি অতিশুদ্ধির চক্করে একেবারে ছেঁটে ফেলাও হারাম।