বাল্যবিবাহ নিয়ে এর আগে বেশ কিছু পোস্ট দিয়েছি যেগুলোর লিংক দিয়ে দেয়া হলো। যে কেউ ইচ্ছে করলে ঐ পোস্টে গিয়ে বিষয় সংশ্লিস্ট ব্যাপার নিয়ে নির্দ্বিধায় আলোচনা করতে পারেন, জানতে পারেন, জানাতে পারেন।
১) বাল্যবিবাহ -১: ইসলামে কি সত্যি বাল্যবিবাহ জায়েজ? একটা উন্মুক্ত আলোচনা
২) বাল্যবিবাহ-২: সমাজ, রাস্ট্রের ওপর এর কি প্রভাব? বিজ্ঞান কি বলে?
৩) বাল্যবিবাহ-৩: ইসলামে এটা কি সুন্নত না শুধুই জায়েজ (অথবা স্বতঃস্ফূর্ত)?
৪) বাল্যবিবাহ-৪: কিছু ভ্রান্ত ধারনা আর আসল তথ্য
কিছু দিন আগে বাংলাদেশ ক্যান্সার গবেষনা ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক কিছু ডাটা প্রকাশ করেন যে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১২ হাজার নারী জরায়ুর ক্যান্সারে আক্রান্ত হন যার প্রধান কারন বাল্যবিবাহ এবং অল্প বয়সে ঘন ঘন সন্তান নেয়া। এ নিয়ে অধ্যাপক সাহেব মৌলবাদীদের ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়েছেন কারন মধ্যযুগীয় আব্রাহামীক ধর্মগুলোতে বাল্যবাবিবাহের ওপর জোর দেয়া হয়েছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উক্ত ধর্মের প্রবর্তকরা বাল্যবিবাহকে উৎসাহ প্রদান করে গেছেন। ইসলাম ধর্ম তো এক কাঠি সরেস,এর প্রবক্তা নবী মোহাম্মদ নারীকে ভোগ্যপন্যের সাথে তুলনা করে গেছেন!
জরায়ুমুখের ক্যান্সার সম্পর্কে জানতে সচলায়তনের এই আর্টিক্যালটি বেশ সুখপাঠ্য এবং এই আর্টিক্যালে আরো খুটিনাটি জানতে পারবেন। আর এই রোগ কিভাবে সনাক্ত করা যেতে পারে সে ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকার বিশেষজ্ঞরা বাংলাতে সবার বোধগম্য করে একটা পিডিএফ তৈরী করেছেন। বিবিসির এই আর্টিক্যালটি পড়লে জানতে পারবেন বাল্যবিবাহে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশে প্রতিবছর কত নারী এই ভয়াবহ রোগে ভুগছে ও অঘোরে প্রান হারাচ্ছে।
প্রশ্ন আসতে পারে বাল্যবিবাহ হলেই কি জরায়ু মুখে ক্যান্সার হবে? তার আগে বলে রাখি আমি নিজে আসলে ডাক্তার নই। তবে যতদূর পড়ালেখা করি এবং বুঝি তা সবার সাথে শেয়ার করতে পছন্দ করি। এছাড়া বাংলাদেশের ডাক্তাররা যে এসব বিষয়ে লেখেন না বা বলেন না তা নয়। অনেকেই বলতে সাহস করেন না কারন জঙ্গি মনোভাবাপন্ন মৌলবাদীরা গত কয়েকদিন অনলাইনে ডাক্তার রাসকিনের এই বক্তব্যগুলোকে এমনভাবে কুরুচিপূর্ন ভাষায় আক্রমন করছে সেটা বলার মতো না। যদিও ব্যাক্তিগত ভাবে উনি বেশ ধার্মিক কিন্তু ধর্মবিশ্বাস দিয়ে বাস্তবতা এড়ানো যায় না। সত্য লুকিয়ে রেখে একটি মধ্যযুগীয় বর্বরতম অনুশীলন যে কতটা ভয়ঙ্কর পরিনাম ডেকে আনে তা আমরা উপরে লিংকে দেয়া ডাটা থেকেই জানতে পারি।
যাই হোউক, কাজের কথায় আসি। বাল্যবিবাহের সাথে এই এইচপিভি ইনফেকশনের সম্পর্ক কতটা নিবিড় সেটা উঠে আসে এই জার্নালের পরিসংখ্যানে। এখানে যে ব্যাপারটা উল্লেখ্য সেটা হলো অল্প বয়সী গৃহবধূরা নিজেদের সন্তানের জন্ম দেয়ার ক্ষমতার যে মিথা তা কাজে লাগাবার জন্য বয়স্ক স্বামীর সাথে ঘন ঘন যৌনমিলনে আবদ্ধ হন। এদের বেশীর ভাগ স্বামী একাধিক স্ত্রীর সাথে ঘর করবার কারনে যৌনবাহিত রোগ অল্প বয়স্ক মেয়েদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তার ফলে ক্লাইমিডিয়া ইনফেকশন, এইচআইভি, এইচপিভি, হেপাটাইটিস সহ মারাত্মক রোগে সংক্রমিত হয়ে পড়ে।
এইচপিভি ভাইরাসের প্রায় ২০০ রকম প্রকারভেদ আছে এবং এর সংক্রমনের বিস্তারিত এখনো জানা সম্ভব হয়নি। তবে বিভিন্ন কন্ট্রোল গ্রুপের ওপর গবেষনা করে দেখা গেছে১৮ বছরের নীচে বিয়ে হয়ে যারা বিয়ের ১ বছরের মধ্যে সন্তান নিয়েছে এবং একাধিকবার সন্তান নিয়েছে তাদের মধ্যে জরায়ু ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা ২১ বছর বয়সে বিয়ে হবার পর সন্তান ধারনকারী মায়েদের থেকে কয়েকগুন বেশী। মোদ্দা কথা ১১ বছরের নীচে যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের মধ্যে এই হার ৫১%, যাদের বয়স ১১-১৩ তাদের মধ্যে এই হার ৪১%, ১৪ থেকে ১৬ এর ৫০ শতাংশ এবং ১৭ বছরের ওপরে ৪ শতাংশ।
মেয়েদের শারীরিক এনাটমি অনুযায়ী, প্রজননতন্ত্রের সামগ্রীক কার্যক্রম মাসিক হবার সাথে সাথেই শুরু হয় না বরংচ তা কয়েকবছর পর শুরু হয় এবং নিয়মিত ওভালুয়েশন অর্থাৎ ডিম্বাশয়ের সাইকেল শুরু হতে প্রায় ২ বছর সময় নেয়। মাসিক প্রাথমিকভাবে ৮ বছরের প্রথম দিকে শুরু হয় মেয়েদের মধ্যে এবং খুব বেশী দেরী হলে ১৩ বছর পর্যন্ত একটি মেয়েকে অপেক্ষা করতে হতে পারে। মেয়েদের মধ্যে বয়ঃসন্ধির প্রথম লক্ষ্মন মাসিক দৃশ্যমান হওয়া শুরু করলেও তার শারীরিক পরিপূর্নতা আসতে আরো ১ থেকে দেড় বছরের মতো সময় লাগে। আরো ভালো ভাবে বলতে গেলে কারো যদি দ্রূত মাসিক শুরুও হয় তার বয়ঃসন্ধির ম্যাচুরিটি আসতে আসতে ১০ - ১১ বছর লেগে যেতে পারে। অর্থাৎ শারীরিক পরিপূর্নতা আসার ২ বছর আগেই মাসিক শুরু হতে পারে। যদিও মাসিক হওয়া মানেই বয়ঃসন্ধির পূর্নতা বোঝায় না। গড়পড়তার যে বয়সে মেয়েরা বয়ঃসন্ধিতে যায় তার চেয়ে কম বয়সে মেয়েরা বয়ঃসন্ধিতে যেতে পারে যেসব স্থানে তারা অপুস্টি বা অসুখ বিসুখে ভুগে থাকে। উদাহরন হিসেবে পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকাতে মেয়েদের মাসিক হবার গড় বয়স ১২.৫ থেকে ১৩.৫ হলেও আফ্রিকাতে এই বয়স হয় ১৪ থেকে ১৭। তার মানে মাসিক হলেই যে মেয়ে বয়ঃসন্ধিতে এসে গেছে এবং সে বাচ্চা নেবার জন্য উপযুক্ত এটা একেবারে ভুল কথা।
তারপরও এই বয়সে বাচ্চা প্রসব করতে গিয়ে মেয়েরা ফিস্টুলা সহ মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে বাকি জীবনের জন্য ভয়াবহ পঙ্গুত্ব বরন করে নিতে পারে।
এখন যদি টেস্টকেস হিসেবে ধরে নেই যে ১৩ বছরের এক মেয়ে বিয়ে করে গর্ভবতী হয়ে গেলো ৬ মাস পর। যখন ১৪ বছর বয়সে উপনীত হলো তখন বাচ্চা প্রসব করার সময় এসে পড়লো। প্রসব বেদনা তিন ধরে চলছে অথচ শিশুটি এখনো বের হয়নি। ততক্ষনে প্রসব বেদনায় কাতর মা। রক্ত ঝরছে ঝর্নার মতো এবং সারা শরীর জ্বরে কাপছে। গত দুদিন ধরে প্রসাব হয়নি এবং যৌনাঙ্গ ফুলে ঢোল হয়ে আছে এবং বার বার পুশ করবার কারনে তা লাল হয়ে গেছে। সবার প্রশ্ন বাচ্চা কেন বের হয়ে আসছে না। এদিকে যেই নার্স আপনাকে সাহায্য করতে আসছেন তার কোনোকিছুতেই কাজ হচ্ছে না। ৪র্থ দিনের মধ্য দুপুরে বাচ্চাটা মৃত হয়ে বের হয়ে আসলো। তিন দিন ধরে পেটে থাকা অবস্থায় মৃত নবজাতকের গায়ের চামড়া নরম হয়ে আছে। তখন হয়তো মা এর সান্তনা যাক বাচ্চাটা বের হয়েছে কিন্তু ৫ম দিনে নতুন সমস্যা দেখা দিলো সেটা হলো মরা চামড়া এখনো বের হচ্ছে এবং প্রসাব বের হয়ে থাই গড়িয়ে মেঝেতে ছড়াছড়ি। কিছু কাপড় খুজে দু পায়ের মাঝখানে গুজেও কুল পাওয়া যাচ্ছে না। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে পুরো কাপড় ভিজে যাচ্ছে, ৬ ঘন্টা পর ঘরে আর কাপড় খুজে পাওয়া যাচ্ছে না কারন সব কাপড়ই ব্যাবহ্রত হয়ে গেছে। ১২ ঘন্টা পর নিয়ন্ত্রনহীন ভাবে মল বেরুচ্ছে, যতই চেস্টা করুন সেগুলো ঠেকানো যাচ্ছে না। বিশ্রী গন্ধ ও ভিজে যাওয়া সবকিছু থেকে রেহাই নেই ওদিকে প্রানের স্বামী শুরু করে দিলো খিস্তি খেউড়। আপনাকে কেউ দুদন্ড সহ্য করতে পারছে না। স্বামী ঘেউ ঘেউ করতে থাকলো,"কি হইছে তোমার? করতেছো কি?" এদিকে সবকিছু ঠিক থাকলে আপনার সদ্য কিশোরী থেকে মা হবার কথা ছিলো কিন্তু আপনি সন্তান হারা বেদনায় শোকে পাথর হবার সময়টাও পাচ্ছেন না, পরিনত হয়েছেন মলের ভাগাড়ে। এর চেয়ে কঠোর শাস্তি আর কি হতে পারে। দিন যায় আপনি কিছুটা উঠে দাড়াতে পারলেও শ্বশুড় বাড়ির লোকজন আপনাকে দুদন্ড সহ্য করতে পারছে না। এদিকে নিজের মা বাবাও আর খোজ খবর নিচ্ছে না। অথচ আপনি যেখানেই বসেন নিজের গন্ধযুক্ত নিয়ন্ত্রনহীন মলে নিজেই অতিষ্ট হয়ে পড়ছেন। আপনার আর ঘরে জায়গা হচ্ছে না, নিজে থেকে হাসপাতালেও যেতে পারছেন না। আপনার বয়স মাত্র ১৪, অশিক্ষিত, পড়ালেখা তেমন করেননি। কি করবেন কোথায় যাবেন, হাতে ১ টা টাকা নেই। কোনো কাজ জানেন না শুধু রান্না বান্না আর ঘর মোছা ছাড়া। তার ওপর এখন জানতে পারলেন আপনার হয়েছে ফিস্টুলা যার জন্য আপনি নিজের প্রসাব পায়খানার ওপর নিয়ন্ত্রন হারিয়েছেন এবং এই রোগ সারাবার মতো সামর্থ্য আপনার নেই। কিন্তু আপনার এই বিশ্রী অসুখটা প্রতিরোধযোগ্য এবং চিকিৎসাযোগ্যও ছিলো। প্রতিবছর এরকম হাজার হাজার মেয়ে অল্প বয়সে বিয়ে করে সন্তান সম্ভবা হয়ে এই রোগে ভুগতো একসময়। বলতে পারেন সীজার করলেই তো হয়ে যায় কিন্তু কয়জনেরই বা সেই সামর্থ্য আছে বা আগে যখন চিকিৎসাব্যাবস্থা সবার দোরগোড়ায় পৌছায়নি তখন কি কঠিন পরিস্থিতির শিকার হতো তারা।
একটা সন্তানের জন্ম দেয়া অনেক কঠিন কাজ। বিভিন্ন ভাবেই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। শুধুমাত্র এই বর্বরতম প্রথাকে বাচিয়ে রাখতে এই মাতৃমৃত্যুর হার কত বেশি ছিলো সেটা চিন্তারও বাইরে। এখন স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্যতার কারনে খুব সস্তায় সন্তানপ্রসব করাতে পারে, কিন্তু এটা তো কোনো সমাধান নয়।
নারীর জন্ম শুধু সন্তান জন্ম দেয়া অথবা স্বামীকে সন্তুস্ট করাই নয়। সেও মানুষ। তাকেও বাঁচার জন্য নিজেকে গড়তে হবে। তার নিজের দেহ তাই তার অধিকার আছে সেটা সে কিভাবে চালিত করবে। নতুবা ব্যাত্যয় অনাচার ঘটবেই। আসুন সবাই আলোকিত হই, সমাজ থেকে বর্বরতা দূর করি।
ছবি সুত্র: গুগল
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১:৫৫