প্রথমেই সবাইকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা!
যাদের পার্টিক্যাল ফিজিক্স সম্পর্কে খুব বেশী ধারনা নাই বা যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বিজ্ঞান তেমন ছিলো না তারা আগে এই পোস্ট টা পড়লে বুঝতে পারবেন বাকি পোস্ট।
ফেব্রুয়ারী ২২, ২০১৬ তে ফার্মিল্যাবের ডিজিরো প্রজেক্ট থেকে ঘোষনা দিলো যে তারা একটা নতুন কনিকারসন্ধান পেয়েছে যদিও তারা হিগস বোসনের মতো এতটা শিওর না। তবে ভাবেসাবে মনে হচ্ছে এই কনিকা থাকার সম্ভাবনা খারাপ না। কনিকাটার নাম আপাতত দেয়া হইছে X (5568)। এখন হয়তো জিজ্ঞেস করতে পারেন এ আবার কেমন নাম। আসলে কনিকাটার ভর পাওয়া গেছে ৫৫৬৮ মেগা ইলেক্ট্রন ভোল্ট।
আপনারা হয়তো জেনে থাকবেন মুসলমানদের কোরান শরীফের মতো পার্টিক্যাল ফিজিক্সেরও তেমন একটা ব্যাপার আছে যেটার নাম স্ট্যান্ডার্ড মডেল। যারা ছোটবেলা রসায়ন পড়েছেন তারা জানবেন সমগ্র মহাবিশ্বের যত জিনিস আছে সব গুলো যেসব মৌলিক পদার্থ দিয়ে তৈরী তাদের একটা চার্ট আছে যার নাম পর্যায় স্মরনী। ধরা যাক মহাবিশ্বের সকল কিছু ভেঙ্গে ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র করলে আমরা পাবো সেই অনু তারপর পরমানু তারপর আরও ভাংলে পাবো একটা নিউক্লিয়াস যার চারপাশে কিছু সংখ্যক ইলেক্ট্রন মৌমাছির মতো আজীবন ঘুরেই যাচ্ছে। তো এগুলো ভাংলে আরও ছোট করলে আমরা যেই কনিকা গুলো পাবো তাদেরও একটা চার্ট আছে সেটাই স্ট্যান্ডার্ড মডেল। তবে রসায়নের পর্যায় স্মরনীর সাথে এর পার্থক্য হলো পর্যায় স্মরনীতে আপনি আরও মৌলিক পদার্থ যোগ করতে পারবেন কিন্তু স্ট্যান্ডার্ড মডেল বলে দিতে পারবে কি কি কনিকা আপনি পাবেন আর কি কি সম্ভাব্য কনিকা থাকতে পারে, তাদের ভর কত হবে, কি হবে তাদের ধর্ম সবকিছু। এর বাইরে আর কোনো কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তো এখনও পর্যন্ত যত কনিকা পাওয়া গেছে তা মোটামোটি এই মডেলের ভবিষ্যতবানীর সাথে বেশ ভালোভাবেই মিলে গেছে। এমনকি হিগস বোসন কনিকা যে থাকতে হবে কনিকাসমূহের ভরের জন্য সেটাও এই স্ট্যান্ডার্ড মডেলে ৭০ দশকে গনিত কষে ভবিষ্যদ্বানী করে গেছে।
সমস্যা হলো গত বছর ডিসেম্বর মাসে আর এ বছরের মার্চ মাসে এলএইচসিতে ডিজিরো প্রজেক্টের মতো একই রকম কনিকার আভাস দেয়, এই উদ্ভট কনিকার নাম টেট্রাকোয়ার্ক বা X (5568) । কারন এই কনিকার সৃষ্টিও চারটি কোয়ার্ক দিয়ে। আশ্চর্য্যের ব্যাপার এই চারটি কোয়ার্কের দুটি কোয়ার্ক আর দুটি এন্টি কোয়ার্ক। এই কনিকাটা উচ্চ শক্তিস্তরে নির্দিস্ট সময়ে স্ট্যাবল থাকে, এরপর ক্ষয় হয়ে Bs এবং পাই মেসন কনিকায় রুপান্তরিত হয়। এর অভ্যন্তরীন গঠন সম্পর্কে এখনও সন্দেহ থাকলেও এর ক্ষয়ীষ্ণু চ্যানেলে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে যাবে এর দুটো সম্ভাব্য গঠন থাকতে পারে।নীচের ছবিতে এই গঠন দুটি দেয়া হলো।
উপরের চিত্রানুসারে বায়ের দিকের মলিকুলার মডেল অনুযায়ী X (5568) কনিকাটির চারটি কোয়ার্ক একক বন্ধন দশায় থাকবে। চারটি কোয়ার্ক হচ্ছে এন্টি স্ট্রেন্জ, আপ, এন্টি ডাউন আর বটম কোয়ার্ক। ডান পাশের ডাই কোয়ার্ক মডেল অনুযায়ী দুই জোড়া মেসন একে অপরকে ঘিরে কিভাবে ঘুরছে সেটা বোঝানো হয়েছে।
আরো বিস্তারিত বলার আগে একটু ইতিহাস নিয়ে কথা বলি। কোয়ান্টাম ক্রোমোডাইনামিক্স অনুসারে একসময় বাঘা বাঘা পদার্থবিদেরা মনে করতেন যে তিন কোয়ার্ক দিয়ে গঠিত কনিকা পাওয়াটা সম্ভব কিন্তু এর চেয়ে বেশী সংখ্যক কোয়ার্ক দিয়ে কোনো কনিকা পাওয়া সম্ভব না। সমস্যা হলো:
*২০০৩ সালে জাপানের বেল্লে ল্যাবে X (3872) কনিকার হদিসপাওয়া গেলো যেটা মূলত চারটি কোয়ার্কের (m_u-m_d)) সমন্বয়ে গঠিত। প্রকাশিত জার্নালে এটাও প্রমান করে দেখালো যে কোয়ান্টাম ক্রোমোডাইনামিক্সে আসলে ৪টা বা ৫ টা যতগুলাই হোক, কনিকা গঠন সম্ভব।
*২০০৪ সালে ফার্মি ল্যাবে পাওয়া গেলো DsJ(2632)।
* ২০০৭ সালে বেল্লে ল্যাব আরও দুটো কনিকার হদিসেরকথা বললো Z(4430) এবং Y(4660) যেগুলোর মধ্যে চারটি কোয়ার্কের দশা থাকতে পারে।
* ২০০৯ সালে ফার্মিল্যাবে Y(4140) নামের একটা অস্থায়ী কনিকার অস্তিত্বের কথা জানান দিলো।
* ২০১০ সালে জার্মানীর একটা সিঙ্কট্রোন আর পাকিস্তানের কায়েদ ই আজম ইউনিভার্সিটির এক পদার্থবিদ ϒ(5S) নামের এক কনিকার ঘোষনা দেয়া হলো যার মধ্যে কোয়ার্কের সংখ্যা ৫ টি বলে ধারনা করা হলো। নাম দেয়া হলো বটমোনিয়াম।
* ২০১৩ সালে চীন আর জাপানের বেল্লে মিলে Zc(3900) কনিকার অস্তিত্বের কথা জানান দিলো যার মধ্যে চারটি কোয়ার্ক থাকার সম্ভাবনা দেখা গেলো।
* ২০১৪ সালে এলএইচসিবি জানালো Z(4430) নামের আরেকটি কনিকা থাকার সম্ভাবনার কথা।
* ২০১৬ সালে ডিজিরো এক্সপেরিম্যান্ট এই X (5568) কনিকাটার খবর জানালো।
এখন কথা হলো এই কনিকা লইয়া আমরা কি করিবো? এটা নিয়ে পোস্ট লেখার কি দরকার ছিলো?
লার্জ হেড্রন কোলাইডারে এখনও পর্যন্ত সুপার সিমেট্রির কোনো কনিকা পাওয়া যায়নি। যার ফলে অনেকেই সন্দিহান সুপার সিমেট্রি আসলেই সঠিক তত্ব কিনা। তার ওপর
এমন চার পাচ কোয়ার্কের অদ্ভুত সব কনিকার খোজ খবর নিয়ে সবাই একটু হতবাক। সবচেয়ে আশ্চর্য্যের কথা হলো এই কনিকার খবর জানানো হয় গতবছরের ডিসেম্বর মাসে আর এই পর্যন্ত এই কনিকা কি হতে পারে আর তার ধর্ম কি সেটা নিয়ে প্রায় ২০০ জার্নাল লেখা হয়ে গেছে।
এখন বুলেট পয়েন্টে এই কনিকার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ন কথা বলে ফেলি:
১) গত বছরে যখন কলিশন ঘটানো হয়এলএইচসিতে তখন ৭৫০ GeV এর দিকে একটা স্পাইক দেখতে পাওয়া যায় ২২ MeV ব্যান্ডউইডথের মধ্যে। এলএইচসির সিম্যুলেশন এমনভাবে করা যে যখনই কোনো কনিকা গঠিত হয় কোনো সংঘর্ষ থেকে তখনই একটা স্পাইক দেখতে পাওয়া যায় গ্রাফে। তো এই ৭৫০ GeV এর স্পাইক নির্দেশ করে যে কনিকা পাওয়া গেলো তার শক্তিস্তর প্রোটনের চেয়ে প্রায় ৬ গুন বেশী।
উপরের গ্রাফে x অক্ষের ৭৫০ GeV বরাবর উপরের দিকে লাল লাইনের ওপরে যে তিনটি ফোটা দেখানো হইছে এইটাই সেই সিম্যুলেশনের ছবি।
২) ডিজিরো প্রজেক্টের এই এক্সপেরিম্যান্ট টা গতবছর এলএইচসি করে যেখানে এই কনিকার সিগন্যালটা খুব বেশী শক্তিশালী ছিলো না। এর ডাটা তারা মরিয়ন্ড কনফারেন্সে উপস্থাপন করে।
উপরের টেবিল থেকে বোঝা যায় যে গতবছর ১৫ ডিসেম্বর আর এই বছর ১৭ মার্চ এটলাস আর সিএমএস স্বতন্ত্র ভাবে তাদের কলিশন চালায় এগুলো দুইটা হাইপোথিসিসের উপর ভিত্তি করে সম্পন্ন করা হয়। প্রথম হাইপোথিসিস অনুসারে নতুন এই কনিকাটি হিগস কনিকার কোনো সুপার সিমেট্রি জোড় কিনা অথবা তার কোনো প্রতি কনিকা কিনা। এটা দেখার জন্য স্পিন ০ তে এই কনিকা পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু তা নির্নয় করা আর দ্বিতীয় টেস্টে স্পিন ২ হলে এই কনিকা পাবার সম্ভাবনা কতটুকু আর সেই কনিকাটা গ্রাভিটন কিনা। গ্রাভিট্রন সম্পর্কে সাধারন ধারনার জন্য এই পোস্টে যান আর যদি ডিটেইলে জানতে চান তাহলে এখানে যান।
টেবিলের লোকাল মানে হলো একটা নির্দিষ্ট এনার্জী ক্ষয়ের রেন্জে (৭৫০ থেকে ৭৬০ GeV) এই টেট্রাকোয়ার্ক কনিকার সিগনাল কতটা শক্তিশালী আর গ্লোবাল মানে হচ্ছে স্বল্প পরিসরে প্রচন্ড ভারী কোনো কনিকার ভরের দেখা পাবার সম্ভাবনা কতটুকু! পদার্থবিজ্ঞানে এরকম পরিংখ্যানে গড়মিল হরহামেশাই হয়। আর তাই গ্লোবাল এর দিক থেকে সাধারনত যদি সম্ভাবনার মান ৩ সিগমা না পাওয়া যায় তাহলে কেউ গুনায় ধরে না সেখানে পাওয়া গেছে মাত্র ২ সিগমা। ৫ সিগমা হলে সম্পুর্ন নিশ্চিত যে পাওয়া গেছে।তবে মে এর দিকে এই এক্সপেরিম্যান্টের দ্বিতীয় ধাপ শুরু হবে তখন আমরা জানতে পারবো আসলে কনিকাটার কাহিনী কি। সিগমা সম্বন্ধে ধারনা পেতে এই পোস্ট পড়ুন।
৩) X (5568) কনিকা কলিশনের পর পর যখন উৎপন্ন হয় উচ্চ এনার্জী স্তরে, এর কিছুক্ষন পরেই শক্তিশালী মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষয় হয়ে Bs মেসন আর পাই মেসনে রূপ নেয়। এই কনিকা গুলোর গঠনের দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি যে X (5568) এ মোট চারটি কোয়ার্কের সমন্বয়ে এন্টি স্ট্রেন্জ, আপ, এন্টি ডাউন আর বটম কোয়ার্ক।
এই চিত্রে দেখা যাচ্ছে যে সংঘর্ষের পর গঠিত হওয়া X কনিকাটি কিভাবে নির্দিষ্ট সময় পর ক্ষয় হয়ে রূপ নিচ্ছে Bs মেসন আর পাই মেসনে।
৪) স্পিন ০ হাইপোথিসিস অনুসারে হিগস কনিকার যেসব রূপ নেবার সম্ভাবনা আছে তার মধ্যে হলো হিগসিনো। আরো যেসব কনিকার দিকে অনুমানটা যাচ্ছে সেগুলো হলো এস লেপ্টন, এস কোয়ার্কের দিকে। এই সবগুলো কনিকা সম্পর্কে ভবিষ্যতদ্বানী করেছে সুপার সিমেট্রি তত্বে। এসব কনিকার জায়গায় স্ট্যান্ডার্ড মডেলে না থাকলেও যদি আমরা সুপার সিমেট্রি তত্ব আমলে নেই তাহলে এর অস্তিত্ব সেখানে পাওয়া যায়। সুপার সিমেট্রি সম্পর্কে জানতে এই পোস্ট পড়ুন। সুপার সিমেট্রি নিয়ে এই পোস্টে আরো গভীরে আলাপ করা হয়েছে।
৫) এখন সম্ভাব্য প্রশ্ন আসে অনেক মেজোরামা পার্টিক্যালে দেখা যায় তারা নিজেরাই নিজেদের এন্টি। আবার এসব সাবএটমিক পার্টিক্যাল গুলো নিজেদের সাথে সংঘবদ্ধ হয়ে আরেকটি পার্টিক্যাল গঠন করে। তার মানে আমাদের মৌলিক ৪ টি বল ছাড়াও এমন একটা বলের সম্ভাবনা আছে যেটা এই বন্ধ শক্তির জন্ম দিচ্ছে। এই মৌলিক অতিশক্তির মূল ভিত্তি এই টেট্রাকোয়ার্ক পার্টিক্যালটি হতে পারে। ধারনা করা হয় মাত্রাহীন এই বন্ধন শক্তি তড়িৎ চৌম্বকীয় বল আর দুর্বল নিউক্লিয় বল থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী। আর যখন উচ্চ শক্তিস্তরে সব বল মুখোমুখি হয় তখন একত্রিত হয়ে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০১৬ রাত ৮:০৬