দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
আমরা মাঝে মাঝেই বলে থাকি বিজ্ঞানের কোনো কিছু স্হির বা ধ্রুব সত্য নয়। আজকে যাকে আমরা ধ্রুব সত্য হিসেবে ধরে নিলাম কালকে সেটা পরিবর্তন হয়ে আরেক রূপ নেবে। কথাটা আসলে আক্ষরিক অর্থে ঠিক আছে কিন্তু এর ভাবানুবাদটা মনে হয় ঠিক নেই। বিজ্ঞান যেহেতু সমগ্র মানবজাতীর অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান সেহেতু তার প্রায়োগিক দিকটাও বেশ প্রয়োজনীয় উপাদান। একসময় ইথারের কনসেপ্ট দিয়ে গ্যাসীয় অবস্হার নানা হিসেব করা হয়েছিলো। কিন্তু পরে যখন সবাই বুঝতে পারলো ইথার বলতে কিছু নেই, সবকিছু শক্তির রূপান্তর, তখনও ফলাফল একই তবে প্রসেসটা বদলে যায়। উন্নততর টেকনোলজীর ছোয়ায় বদলে যায় পুরো সভ্যতার অগ্রযাত্রা।
এটাই বিজ্ঞানে সৌন্দর্য্য। স্ট্রিং থিওরী প্রথমত পুরোটাই গণিত নির্ভর তার ওপর নতুন তত্ব হিসেবে অনেক সমালোচনার স্বীকার এমনকি সার্নের বিজ্ঞানীদের মাঝে সম্প্রতি এক জরীপে দেখা গেছে সুপারসিমেট্রির কনিকা সমূহ পাওয়া যাবে এমন ধারনা বিশ্বাস করেন মাত্র ২৮% বিজ্ঞানী। বাকি ৭২% সন্দিহান স্ট্রিং থিওরী অথবা সুপার সিমেট্রির সফলতা নিয়ে।লার্জ হেড্রন কোলাইডার প্রায় রিনোভেশন শেষ করে ফেলেছে। আগামী কয়েকবছর আমরা কিছু অবিশ্বাস্য আবিস্কারের দেখা পাবো যার মাধ্যমে আমরা জানতে পারবো আসল সত্যটা কি ঘটতে চলেছে। তবে এটা আমার বিশ্বাস, ফলাফল যাই আসুক না কেন সব ফলাফলই স্ট্রিং থিওরীর দিকেই এগিয়ে যাবে, হয়তো কিছু এদিক ওদিক।
বিগত চার পোস্টে আমরা যেসব জানতে পেরেছি সেগুলো একটু সামারী করি।
স্ট্রিং কি? স্ট্রিং হলো শক্তির আদি রূপ যাকে আমরা কল্পনা করতে পারি সুতোর মতো। আমরা বাস্তবিক অর্থে যেসব সুতো দেখি সেগুলো রেশম বা কটনের তৈরী। স্ট্রিং থিওরীগুলো উন্মুক্ত স্পেস বা স্হানে তন্তু বা আশের আকারে রয়েছে।
এসব তন্তু বা আশ দু প্রকারের একটা হলো বদ্ধ আরেকটা উন্মুক। বদ্ধ হলো এই আশের কোনো উন্মুক্ত মাথা নেই আর উন্মুক্ত তন্তু হলো এর অন্তত একটি মাথা উন্মুক্ত থাকবে।
এসব শক্তির তন্তুগুলো স্হির নয়। সর্বদা কম্পমান এবং এরা পরস্পরের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় অংশগ্রহন করে। এসব তন্তুগুলো আমাদের চেনাজানা মহাবিশ্বের পুরোটা স্হান জুড়ে রয়েছে এবং একেকটি স্ট্রিং যতটুকু স্হান জুড়ে থাকে তাকে ওয়ার্ল্ড শীট বলে থাকি। এরা মাত্রা ১ থেকে ২, ৩, ৪, ক্রমান্বয়ে বর্ধনশীল।
এই তত্ব অনুসারে আমরা কিভাবে গ্রাভিটি পেলাম সেটার ব্যাখ্যা থেকে শুরু করে চার বল কিভাবে একত্রিত হয়ে আছে পরিশেষে থিওরী অব রিলেটিভিটির ব্যাখ্যা দেয়া যায়। স্ট্রিং থিওরী অনুযায়ী আমাদের মহাবিশ্ব মোট ১১ মাত্রার সৃষ্টি যার মধ্যে ১০ টি হলো স্হানিক আর বাকিটা সময়।
স্ট্রিং থিওরীতে ৫ রকমের সজ্জা বিদ্যমান। ৫ রকমের সজ্জা বলতে এই যে বদ্ধ এবং উন্মুক্ত স্ট্রিং বা তন্তু সমূহ এগুলো বিভিন্ন মাত্রায় এবং ঠিক কিভাবে একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে এই বর্তমান মহাবিশ্বের সমস্ত মৌলিক কনিকা যার ওপর ভিত্তি করে এত বড় মহাযজ্ঞের রূপদান করা হয়েছে সেটার ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম।
এই রকম ৫ রকম সজ্জায় সমন্বিত স্ট্রিং থিওরীর প্রকারভেদ গুলো হলো:
Type IIB: সবগুলো স্ট্রিং বদ্ধ, উন্মুক্ত কোনো স্ট্রিং নেই।D-brane এর মাত্রা সমূহ হলো -১,১,৩,৫,৭
Type IIA: এটাও বদ্ধ স্ট্রিং এর এবং এর D-brane এর মাত্রা সমূহ ০,২,৪,৬,৮
E8 x E8 Heterotic : বদ্ধ স্ট্রিং এর এবং D-brane মাত্রাহীন
SO(32) Heterotic: বদ্ধ স্ট্রিং এর এবং D-brane মাত্রাহীন
Type I SO(32): উন্মুক্ত এবং বদ্ধ স্ট্রিং এর সমন্বয় এবং D-brane এর মাত্রা সমূহ ১,৫,৯
গত পর্বে আমরা স্ট্রিং ডুয়ালিটি বা স্ট্রিং দ্বিজতা নিয়ে কথা বলেছিলাম। দ্বৈততা হলো এই যে স্ট্রিং থিওরীর রকম সজ্জার প্রকারভেদ; এগুলো দ্বারা স্ট্রিংগুলোর ব্যাখ্যা যেভাবেই দেই না কেন তার ফলাফল গুলো একই হয়। এই সাদৃশ্যকেই আমরা দ্বিজতা বলে থাকি। গত পর্বে T-duality এর সংজ্ঞা পেয়েছি।
(T-duality র ধারনা আরেকটু পরিস্কার করার জন্য একটা উদাহরন দেয়া যেতে পারে সেটা হলো নীচের ছবির মতো আমরা দুটো ডাইমেনশন বা মাত্রা নেই যার মধ্যে একটা মাত্রা হলো X। X মাত্রাটি ধরা যাক ভূমির সাথে সমান্তরাল। আরেকটা মাত্রা ধরি Y। Y মাত্রাটি হলো একিভূত করনের সেই মাত্রা যেটার ব্যাপারে আমরা বিষদ আলোচনা করেছিলাম পর্ব ৪ এ কালুজা ক্লেইনের একীভুত করনের তত্ব অনুসারে।
এখন এই দুটো মাত্রার মধ্যে আমরা একটা মুক্ত বদ্ধ স্ট্রিং আনলাম যেটা মূলত X মাত্রা ধরে যেতে পারে অথবা Y মাত্রা বরাবর ঘুরতে পারে আবার দুটো মাত্রার মাঝামাঝি হয়েও চলতে পারে। এই সব ভাবে চলতে পারার জন্যই এর নাম দিলাম মুক্ত স্ট্রিং। Y গোলক মাত্রার ব্যাসার্ধ ধরি R এবং যেহেতু এটা স্ট্রিং লেভেলের সেহেতু এর মান হবে খুবই কম।তাহলে মুক্ত স্ট্রিংটির শক্তির পরিমান হলো W=n/R যেখানে n হচ্ছে একটা পূর্ন সংখ্যা যেটা স্ট্রিংটির ঘূর্ন সংখ্যা নির্দেশ করে মাত্রা বরাবর।
এখন কথা হলো যেসব স্ট্রিং মুক্ত নয়, মানে মাত্রার ডি ব্রেনের সাথে লেগে থাকে তাদের ক্ষেত্রে যেটা হয় তারা Y মাত্রা বরাবর ঘুরতে থাকে। যে স্ট্রিং উপরের দিকে ঘুরে তার জন্য m=1 আর যেটা নীচের দিকে ঘুরতে থাকে তার জন্য m=-1। আমরা স্বভাবতই জানি এসব স্ট্রিংগুলো স হজেই একে অপরের সাথে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে জোড়া লাগে এবং ছুটেও যায় যেটা পর্ব দুই এ বিষদ বলা আছে। এখন এই দুটো স্ট্রিং জোড়া লাগলে যেটা হবে যেটা হলো ১+(-১)= ০ অনেকটা নীচের ছবির মতো।
যার মানে হচ্ছে আমরা ঘুরে ফিরে একটা মুক্ত স্ট্রিং পাচ্ছি ঘুরে ফিরে। আর সেক্ষেত্রে এর শক্তি হবে w= mR।
আমরা হিসাব যেভাবেই করি না কেন ফলাফল একই হচ্ছে আর এটাই হলো T-duality
)
আরেক ধরনের দ্বিজতা হলো S-duality যেটা এক ধরনের প্রতিসাম্যতা বা সাদৃশ্যতাও বলা যায়। মিথস্ক্রিয়তার ধ্রুবক বা কাপলিং কনস্ট্যান্ট হলো মিথস্ক্রিয়ার মান। ধরা যাক পৃথিবীর মধ্যাকর্ষন শক্তির জন্য মিথস্ক্রিয়ার ধ্রুবকের মান দ্বিগুন হতো তাহলে আমরা যে চাপটা অনুভাব করছই তার দ্বিগুন অনুভব করতাম, আমাদের পৃথিবী এই ঘনত্বের মধ্যে আরও দ্বিগুন বড় হতো। আর যদি এই ধ্রুবকের মান কম হতো তাহলে পৃথিবীর ঘনত্ব কম হতো, আমরা হয়তো আকাশে ভাসতাম যেমনটা চাদে মানুষ ভেসে ভেসে হাটে।
আমরা জানি স্ট্রিং থিওরীর ৫ ধরনের সুপার স্ট্রিং থিওরীর কথা বলে। একেক টাইপের স্ট্রিং থিওরীতে তন্তু সমূহ একেকভাবে মিথস্ক্রিয়ায় অংশ গ্রহন করে। এখন ১০ মাত্রা মহাবিশ্বে যদি এক টাইপের স্ট্রিং থিওরীর মিথস্ক্রিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী মান আরেকটা টাইপের স্ট্রিং থিওরীর মিথস্ক্রিয়ার সবচেয়ে দর্বল মানের সমান হয় তাহলে সেটা হবে S-duality।
যেমন ১০ মাত্রায় SO(32) Heterotic এবং the Type I স্ট্রিং সমূহ এমন সাদৃশ্যতা দেখায়। সোজা কথা হলো এক টাইপের স্ট্রিং থিওরীতে থাকা স্ট্রিং সমুহ একটা একটার সাথে কঠিন টানে আছে আরেকটা থিওরীতে ঐ কঠিন টানটাই সবচেয়ে দুর্বল টান। তার মানে ঐ টাইপের স্ট্রিংগুলা পরস্পরকে আরও কঠিন ভাবে টানে যত তারা একে অপরের সাথে মিরথস্ক্রিয়ায় অংশ নিতে থাকে(পারটাবেশন থিওরীর পাওয়ার সিরিজ- পর্ব ৩)।Type I সুপার স্ট্রিং থিওরী heterotic SO(32) এর সাথে এই দ্বিজতা প্রদর্শন করে, এবং Type IIB তত্বে এরকম সাদৃশ্যতা নিজেদের মধ্যেই প্রদর্শন করে।
১৯৯৫ সালের দিকে এডওয়ার্ড উইটেন নামের একজন গণিতবিদ এমনি একটা ধারনা দেন যে ১১ মাত্রায় Type IIA এবং E8 x E8 তত্ব সমূহ একে অপরের সাথে এই S-duality সাদৃশ্যতা প্রদর্শন করে যাকে পরে তিনি এম-থিওরী নাম দেন।
এম থিওরী:
এম থিওরীর কনসেপ্ট হলো এতে স্ট্রিং থিওরীর ১০ এর জায়গায় ১১ টা মাত্রা থাকবে যেগুলো নিম্ন শক্তি স্তরের সুপারগ্রাভিটি মাত্রা নামে পরিচিত। আশ্চর্য্যের ব্যাপার হলো ১১ মাত্রা হওয়াতে এর কোনো স্ট্রিং নেই নিম্ন শক্তি স্তরে তাই এর কোনো D brane ও নাই। তার বদলে এর আছে M brane যার মানে হলো এর ওয়ার্ল্ড শীট বা বিশ্বপাতের পরিবর্তে আছে স্তর। অনেকটা হলো একটা বিল্ডিং এর মতো যার ওপরের তলায় আছে আমাদের মহাবিশ্ব আর নীচের তলা গুলো আরো ব হু বিশ্ব। প্রত্যেক তলায় আছে বিভিন্ন রকম মাত্রার সন্নিবেশ এবং যত নীচের যত থাকবে এর শক্তির স্তর কমতে থাকবে এবং শেষের দিকে মাত্রার পরিমান বিজোড় সংখ্যক ভাবে বেড়ে যাবার কারনে এতে কোনো স্ট্রিং থাকবে না। ১১ টি সুপারগ্রাভিটির মাত্রা দিয়ে গঠিত এই বিশ্বকে Type IIA সুপার স্ট্রিং এর শাখায় ফেলতে পারি।
ধরা যাক এম থিওরীর ১০ টা মাত্রাকে একটা বৃত্তে আবদ্ধ করলাম যার ব্যাসার্ধ R। M brane এর ২টা মাত্রা থাকায় এর M২ brane কে যদি বৃত্তটাকে পেচিয়ে ফেলি তাহলে যেটা দেখা যাবে জোড় সংখ্যক মাত্রাগুলো ঐ M২ brane এর সাথে লীন হয়ে বিজোড় সংখ্যকগুলো বৃত্তে প্রতীয়মান হবে। তার জন্য এটি Type IIA সুপার স্ট্রিং এর মধ্যে পড়ে।Type IIA সুপার স্ট্রিং এই জন্য যখন স্হানিক বিজোড় সংখ্যায় বাড়তে থাকে এবং ৯ এর পর এক্সট্রা মাত্রার প্রয়োজন পড়ে তখন সেটা এমথিওরীর সাথে সামন্জ্ঞস্যপূর্ন হয়ে যায় এবং এর মিথস্ক্রিয়া খুবই শক্তিশালী হয়।
এই মিথস্ক্রিয়ার মান এবং অন্যান্য সাদৃশ্যতার দিকে লক্ষ রেখে বিভিন্ন প্রকারের স্ট্রিং থিওরীর সাথে এক ধরনের সম্পর্ক খুজে পাওয়া যায় যেটাকে আমরা নীচের চিত্রের মতো আকতে পারি।
তার মানে চার বলের মধ্যে সম্পর্ক স্হাপনের জন্য স্ট্রিং থিওরী যেমন ভূমিকা রেখেছিলো তেমনি বিভিন্ন প্রকারের স্ট্রিং থিওরীর মধ্যে সম্পর্ক স্হাপনের জন্য এমথিওরীর জুড়ি মেলা ভার।যদিও আমরা এই এম থিওরী সম্পর্কে এখনো তেমন কিছু জানি না, তবে এটা অবশ্যই আশাব্যান্জ্ঞক যে এই তত্বেই মোটামোটি সকল কিছুর প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সম্ভব।
এখানেই আমরা স্ট্রিং থিওরীর উপাখ্যান শেষ করছি যদিও অনেক কিছু বাকী আছে। আসল থিওরীর তুলনায় এটা শিশুতোষ পাঠ বলা যায় যেখানে হয়তোবা স্ট্রিং থিওরীকে উপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে নেয়ার সাথেই তুলনা করা যেতে পারে।
শেষ