ঘুম ভাঙার পর থেকেই রমিজ আলির মেজাজটা চরম খিটখিটে হয়ে আছে। ঘরের দরজায় পা ছড়িয়ে বসে মনে মনে নিজের ভাগ্যের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করছে সে। অবশ্য তার জন্য যথেষ্ঠ কারণও আছে। ঘুম ভাঙার পর বিড়ি ধরিয়ে নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করা তার দীর্ঘ দিনের অভ্যাস, অথচ আজ সেটা করতে পারেনি। ঘুমানোর সময় বিড়ির প্যাকেটটা রেখেছিলো পট্টি মারা ছিঁড়ে যাওয়া শার্টের পকেটে, আর শার্টটা ছিলো জানালার ধারের দড়িতে ঝুলানো। কিন্তু ভোর রাতের এক পশলা বৃষ্টি জানালা দিয়ে ঢুকে শার্ট সহ বিড়ি গুলোকে ভিজিয়ে একাকার করে ফেলেছে। বহু চেষ্টা করেও একটাতেও আগুন ধরাতে পারেনি সে। তারপর থেকেই বিড়ির নেশাটা যেন আরো চেপে বসেছে। কিন্তু পকেটে কানাকড়িও নাই যে বিড়ি কিনে ধরাবে। কাশেমের দোকান থেকে বাকি নেওয়ার কথা ভেবেছিলো একবার কিন্তু গত পরশুর চালের দামটা এখনো দেওয়া হয়নি, তাই নতুন করে বিড়ি চাইতে গেলে একগাদা কথা শুনতে হবে। এখন উপায় একটাই, রিকশাটা নিয়ে বের হয়ে একটা ভাড়া মেরে তারপর সেই টাকা দিয়ে বিড়ি খাওয়া।
কিন্তু সেখানেও একটু সমস্যা আছে! গত দুইদিনের জমার টাকাটা সে মহাজনকে দিতে পারেনি। আর টাকা সে দিবেই বা কি করে, জমার টাকা দিলে তো ঘর ভাড়ার টাকায় কম পড়ে যেত!
অবশ্য এগুলো ভেবে তো আর লাভ নাই, তাকে যেতেই হবে আবার মহাজনের কাছে। বলে কয়ে রিকশাটা নিয়ে বের হতেই হবে আজ, তারপর না হয় তিন দিনের জমার টাকা একসাথে চুকিয়ে দিবে সে। মুখ-হাত ধুয়ে এসে বউকে ডাক দিলো,
-রাজিয়া, ও রাজিয়া! ভাত দেও, বাইর হমু এখন।
-ভাত নাই!
-ভাত নাই মানে?!
-এহ্, লাটসাহেবের কথা দেখ! ভাত মুনে হয় চাইলেই পাওয়া যায়! ভাত নাই মানে ভাত নাই, এমনেই যান!
-ক্যান? হেই দিনই না দেড় কেজি চাইল আইনা দিলাম! সব শ্যাষ?
-দেড় কেজি চাইলে আর কয় দিন চলবো আপনেই কন দেহি? বাড়িত মানুষ চাইর জন, দুই দিন যে চলসে হেইডায় তো মেলা! ঘরের তো কুনো খবরই লন না, খালি খাই খাই!!
বউয়ের কথা শুনে মেজাজটা আরো খারাপ হয়ে গেল! ভাবছে দু-চার ঘা লাগিয়েই দিবে নাকি! এমনিতেই বিড়ির জন্য মনটা আকুপাকু করছে, তার উপর ভাত নিয়ে বউয়ের এমন খ্যাচ খ্যাচ করা কথা-বার্তা! অবশ্য কথা গুলো ফেলে দেওয়াও যায় না। ছোট মেয়ে, বৃদ্ধ মা, বউ আর সে নিজে এই নিয়ে তার সংসার। বউ যে কিভাবে দেড় কেজি চাল দিয়ে দুই দিন চালালো সেটা ভেবেই অবাক হলো রমিজ আলি।
তবে যাই হোক, শালার দিনটাই খারাপ! ভাবতে ভাবতে গামছাটা ঘাড়ের উপর নিয়ে বের হয়ে গেল সে গ্যারেজের উদ্দেশ্যে। আর সেই সাথে ঠিক করে নিলো যে করেই হোক মহাজনের হাতেপায়ে ধরে রিকশাটা নিয়ে একটা ভাড়া মেরেই এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা, একটা বিড়ি আর দুইটা নোনতা বিস্কুট খাবে। চা-বিড়ি-বিস্কুটের কথা মনে হতেই জিভে জল চলে আসলো তার, মনটাও খুশি খুশি হয়ে গেল। জোর পায়ে গ্যারেজের দিকে রওনা হলো সে।
গেদু মহাজন বরাবরের মতো তার বিশাল ভুড়িটায় হাত রেখে জলচৌকির উপর বসে আছে। চৌকির পাশ ঘেঁষে দাড়িয়ে চিঁ চিঁ করে বললো সে,
-কাকা, রিকশাডা এট্টু বাইর করমু।
-আঁ? কি কইলি?
-ইয়ে মানে রিকশাডা এট্টু বাইর করবার কথা বলসিলাম আরকি!
-রিকশা বাইর করবি ভালা কথা, তা গত দুই দিনের ট্যাকা কৈ? ট্যাকা না তোর কাইলই দাওয়ার কথা আছিলো? এহন যা ভাগ, ট্যাকা নিয়া আয় আগে তারপর কথা!
মনে মনে এরকমটিই ভেবেছিলো রমিজ আলি। আর এ ধরণের ব্যবহার এর আগেও দেখেছে সে, জানে কি করতে হবে। গেদু মহাজন যখন বলেছে টাকা ছাড়া রিকশা দিবে না তখন একটাই উপায়, দুই পা চেপে ধরে কান্নাকাটি করা। সেটাই করলো সে,
-কাকা, এইবারই শ্যাষ! আর ইরাম হবে না, কথা দিলেম কাকা!
- যা ভাগ তো, মাগি মাইনসের মতো কান্দিস না!
- কাকা, আপনে ভাগায়া দিলে কৈ যামু! পরিবারের সবাই না খায়া আছে কাকা! এইবার ক্ষমা করে দ্যান, আইজ সন্ধ্যায়ই সব ট্যাকা দিয়া দিমু।
এমন সময় গেদু মহাজনের একমাত্র মেয়ে জামাই গ্যারেজে এসে উপস্থিত হলো। জামাইকে দেখে গেদু মহাজন একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল! সকাল সকাল একজন তার পা ধরে পড়ে আছে জামাইয়ের সামনে ভাবতেই লজ্জা পেয়ে গেল সে। ঠাস করে পা টা ঝাড়া দিয়ে আপদ বিদায় করার জন্য বললো,
-যা যা, আইজ নিয়া যা, তয় এর পর থিকা এমন করলে আমার সামনেও আর আইবিনা হারামজাদা! আর সন্ধ্যায় গুইনা গুইনা তিন দিনের ট্যাকা তো দিবিই।
রমিজ আলি ভেবেছিলো আজ সহজে পার পাবে না। কিন্তু জামাইয়ের উসিলায় কাজটা একেবারে সোজা হয়ে গেল। এখন তার ইচ্ছা করছে জামাইয়ের পা ছুয়ে একবার সালাম করে। কিন্তু কাজটা মনে হয় ঠিক হবে না। তাই মাথা নিচু করে সালাম দিয়ে হন হন করে গ্যারেজের পিছন দিকে চলে গেল সে। রিকশাটা নিয়ে বের হতে হবে তাড়াতাড়ি, বেলা বাড়ছে।
মোড়ের মাথায় যেতেই একটা ভাড়াও পেয়ে গেল। মনটা খুশি হয়ে উঠলো রমিজ আলির। রেলগেট পর্যন্ত গেলেই ২০ টাকা, এক কাপ চা, বিড়ি আর নোনতা বিস্কুটের জন্য যথেষ্ঠ। দ্রুত প্যাডেলে চাপ দিয়ে এগিয়ে চললো তার রিকশা। শহরের ব্যাস্ত রোড, এই সকাল বেলাতেও কার, মাইক্রো, রিকশা, অটো রিকশা আর মানুষের ভিড়ে গিজ গিজ করছে। সবাই যে যার কাজের উদ্দেশ্যে ছুটছে। রমিজও ছুটছে রেলগেটের উদ্দেশ্যে.....অবশেষে রেলগেট আসলো, পেলও সে ২০টা টাকা। রেলগেটে মতির মায়ের দোকানে সে প্রায়ই বসে। ভালো চা বানায় মতির মা, দুধ-চিনি বেশী বেশী দেয়। আর নোনতা বিস্কুট গুলাও অন্য দোকানের চেয়ে বড় বড় রাখে। রিকশাটা সাইড করে রেখে সে দিকেই পা বাড়ালো রমিজ আলি। বাঁশের তৈরি মাচানের উপর বসে হাঁক ছাড়তে যাবে সে....কিন্তু হঠাৎ কি যেন হলো!
মনে পড়ে গেল বাড়িতে থাকা ছোট্ট মেয়ে, বউ আর বৃদ্ধ মায়ের কথা। সেই সন্ধ্যা রাতে দুমুঠো ভাত খেয়ে ঘুমিয়েছে ওরা। ওর মতো ওরাও কিছু খাইনি, মেয়েটা হয়তো মায়ের আঁচল ধরে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করে দিয়েছে। দুমুঠ ভাত পেলেই খেয়ে-দেয়ে খেলতে বের হবে পাড়ায়। মতির মাকে চা বানানোর কথা বলতে যেয়েও বলতে পারলো না সে। ঘুরে হাটা ধরলো আবার রিকশার দিকে, আবার ভাড়া মারতে হবে। সন্ধ্যার মধ্যে তিন দিনের জমার টাকা, চাল আর এক-আধটু তরকারী নিয়ে ঘরে ফিরতে হবে তাকে। তার আপন মানুষ গুলো সারাদিন না খেয়ে থাকবে আজ, সে কিভাবে এক কাপ চা,নোনতা বিস্কুট আর বিড়ি খেয়ে বিলাসিতা করতে পারে!
রেলগেটে রিকশা নিয়ে দাড়িয়ে চাতক পাখির মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছে রমিজ আলি, যদি একটি প্যাসেঞ্জার জোটে....।।
[এমনি শত শত রমিজ আলি প্রতিদিন আমাদেরকে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে এই শহরে, এই দেশে। কিন্তু আমরা কি কখনো তাদের মনের কথা, অন্তরের ব্যাথা জানার চেষ্টা করি? তারা আমাদের কাছে শুধুই রিকশাওয়ালা, তাদের নাম থাকতে নেই। "এই খালি" বলে ডাক দিলেই এরা হাজির হয় বহন করার জন্য। তুই/তুমি ছাড়া এদের সাথে কথা বলা যায় না। আবার দুই টাকা বেশী চাইলে ঠাস করে চড় কসাতেও বিবেকে বাধে না! এটাই আমাদের সভ্যতা, আমাদের ভদ্র সমাজের শিষ্ঠাচার]