জ্যোৎস্নাত রাতে ঘুম জড়ানো চোখে বাড়ি ফিরছিলাম। সারাদিন এর ব্যাস্ততায় অনেক ক্লান্ত আর অবশাদ এ ভরা আমার মন। পা যেন আর চলছে না। আর একটা লেন পার হলেই আমার বাড়ি। ঘুম জড়ানো চোখে আশে পাশের কিছুই যেন আমি দেখছি না। এত জোরে হাটছি, তবুও যেন পথ শেষ হচ্ছে না। মনে হল, কেউ একজন আমাকে পেছন থেকে ডাকছে। প্রথম ডাকে সাড়া দিলাম না। কারন ঘুরে যে তাকাব, তাও ইচ্ছে করছে না। দ্বিতীয়বারের ডাকে ঘুরে তাকালাম।
আমাকে বলল, শুনছেন, আপনাকে বলছি ! আপনি কি বাড়ি যাচ্ছেন ? চলুন আপনাকে পৌঁছে দেই।
আমি বললাম, কে আপনি ? আপনাকে তো আমি চিনলাম না ?
সে বললঃ আমি পথ হারানো ক্লান্ত পথিক এর পথের সাথী। পথ হারানো ক্লান্ত পথিককে বাড়ি পৌঁছে দেয়াই আমার কাজ।
আমি বললামঃ আমি পথ হারাব কেন ? এই লেনটা পার হলেই আমার বাড়ি। আমি নিজেই চলে যেতে পারব।
সে বললঃ পারলে তো ভালই। যান...!
আমি বললামঃ আপনাকে তো আমি চিনলাম না ? আপনি আমার বাসা চিনবেন কি করে ? আপনি কে ?
সে বললঃ বললাম না, আমি পথ হারানো পথিকের পথের সাথি।
আমি বললামঃ এখন কয়টা বাজে বলতে পারেন ?
সে বললঃ তিনটা।
আমি বললামঃ তিনটা ! কিভাবে ?
আমার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, সত্যিই তিনটা বাজে। আমার মাথায় যেন বাজ পড়ল। কারন আমি অফিস থেকে বারটার দিকে বেরিয়েছি। অফিস থেকে বাসার দূরত্ব মাত্র ২০ মিনিট। এতটা সময় কিভাবে গেল, ভেবে পেলাম না ! তাহলে কি আমি সত্যি সত্যিই পথ হারিয়েছি ? মুহূর্তের মধ্যেই চোখের ঘুম আর জড়তা কেটে গেল। আশেপাশে ভাল করে খেয়াল করে দেখলাম সত্যিই আমি একটা অন্য রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু পথটা আমার অনেক চেনা। কিন্তু মনে করতে পারছি না। তবে মনে হচ্ছে, অনেক বার এসছি এই রাস্তায়। লোকটির দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখি, সে আর কেউ নয়, আমাদেরই এলাকারএক বড় ভাই। তার নাম ছিল লিটন। আমার স্পষ্ট মনে আছে। স্কুল শেষ হলে প্রায় প্রতিদিন বিকালেই ফুটবল খেলছি তার সাথে।
আমি বললামঃ আরে, আপনি লিটন ভাই না ? আমি রিমন। কত দিন পর দেখা, তাও এই ভাবে।ভাবতে অবাক লাগছে। কেমন আছেন ভাই ?
সে অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চেনা তাকানো। ফুটবল মাঠে গোল খেলে, আমার দিকে ঠিক এমন ভাবেই তাকাতো। আমি আবার বললামঃ আমাকে চিনতে পারেন নাই, লিটন ভাই ?
বেশ কড়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি লিটন নই। পথ হারানো পথিককে পথ খুঁজে দেয়াই আমার কাজ।
আমি বললাম, দুষ্টামি বাদ দিন তো। আমি আপনাকে ঠিক চিনেছি। আপনি বললেই হবে ? এত দিন আপনার সাথে খেললাম, আর আপনাকে চিনব না। হয়ত অনেক দিন পর দেখা। তাই বলে কি এত সহজে ভুলে যাব।
সে বলল, দেখুন, আপনি ভুল করছেন। আমি লিটন নই। চলুন বাড়ি পৌঁছে দেই। ভোর হতে চলল।
আমি বললামঃ আচ্ছা বাদ দিন, এইটা কোন রাস্তা?
সে বললঃ আমি নাম জনি না, শুধু জনি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। আমাকে আর কোন প্রশ্ন করবেন না।
আমি বললাম, ঠিক আছে, বলুন কেমন আছেন ?
সে বলল, কোন কথা নয়। শুধু আমাকে অনুসরন করুন।
সে অনেক জোরে জোরে হাটতে শুরু করল। আমি তার পিছে হাটতে শুরু করলাম, ভাবলাম, এমন করছে কেন, লিটন ভাই। খেয়াল করে দেখলাম, একটা আলো আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোথা থেকে আসছে, বুঝতে পারলাম না। মনে হল আকাশ থেকে পড়ছে। আকাশের দিকে তাকালাম। মনে হল, ঠিক যেন চাঁদ থেকে আলোটা আমাদের উপরই পড়ছে। আর আলোর উৎস, ওই চাঁদটা অদ্ভুত রকমের সুন্দর। চোখ যেন ফেরাতে পারছি না। কতক্ষণ যে চাঁদ-এর দিকে তাকিয়ে হেঁটেছি, বলতে পারব না। ঘোর কাটতেই, সামনে তাকিয়ে দেখি লিটন ভাই নাই। পুরো রাস্তায় আমি একাই। সামনে, পিছে বা পাশে, কোথাও কেউ নাই।আমার গা শিউরে উঠল। মিষ্টি সেই আলোটাও নাই। আমার শরীর কেমন যেন ভারী হয়ে এল। বামে ঘুরতেই দেখলাম, আমার বাড়ির মেইন গেট। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, রাত চারটা বেজে ত্রিশমিনিট। মেইন গেটে তালা পড়ে গেছে। অনেক ডাকাডাকি করে, দারোয়ান কে দিয়ে গেট খোলালাম। দারোয়ান বলল, এত দেরি কেন স্যার। আমি কোন কথার উত্তর না দিয়ে, সোজা দরোজা খুলে ঘরে ঢুকে গেলাম। ঘরে ঢুকেই, টেবিল থেকে জগটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে প্রায় অর্ধেক জগ পানি খেয়ে, বেসিন এর সামনে গিয়ে চোখে-মুখে পানি দিলাম। চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। চোখ বন্ধ করতেই মনে পড়ল, এই লিটন ভাই তো অনেক আগে, প্রায় ১০ বছর আগে রাত তিনটার দিকে, দুবৃত্তদের ছুরিকাঘাতে মার যায়। কে বা কারা, কেন তাকে খুন করেছে এখনও কেউ জানে না। তবে কি............! যাই হোক, কিন্তু রাত ১২ টা থেকে রাত ৪ টা ৩০ মিনিট, এতটা সময় কোথায় ছিলাম আমি ?