একজন মুসলমান হিসাবে অবশ্যই নবী (সঃ) আমার গর্ব ও আদর্শ হবেন। হয়তো সব সময় তাঁর সকল কথাই মনে আসেনা সবার, তারপরও খুব প্রচলিত উদাহরণ দিয়েই তাঁর আদর্শ, উদারতা সকলের কাছেই পরিষ্কার। আমি এত বছরের জীবনে যা শিখেছি তা হল, ধর্ম বৈষম্য শেখায় না, প্রকৃত ধর্ম শত্রুকে জয় করতে শেখায়, ধর্ম সবাইকে এক কাতারে আসতে শেখায়।
আজকের এই লেখা সবাইকে ধার্মিক করতে হয়তো নয়, কিন্তু যখন দেশে জনগণের ধর্মভীরুতার সুযোগ নিয়ে আবারো ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে মানবতার বিপক্ষে তখন আর চুপ থাকা যায়না।
দেশ আজ তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনে উত্তাল। ১২ দিনের এই আন্দোলনের প্রতিটি মুহূর্তই নাটকীয় ছিল। সেই নাটকের সব থেকে রোমাঞ্চকর দৃশ্য মঞ্চস্থ হল গতকাল (১৫-০২-১৩)। হটাৎ করেই আন্দোলনকে নির্দিষ্ট সময়ে নিয়ে আসার ঘোষণা আসলো (যা কিছুদিন আগে সংসদে প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাব করেছিলেন)। তবে এই নাটকের চূড়ান্ত সুযোগের অপেক্ষায় তখনও বসে আছে নাটকের অন্যতম অভিনেতা জামাত-শিবির। যখন সবাই আন্দোলনের ঘোষণায় হতাশ, তখন নিজ বাসার সামনে জবাই করে হত্যা করা হয় রাজীব (থাবা বাবা) নামক একজন ব্লগারকে। এর পরের কাহিনী সকলেই জানেন, কিভাবে সহানুভূতি বদলে যেয়ে আস্তিক-নাস্তিক যুদ্ধে লিপ্ত হয় সকলে!!! অনেকেই শাহবাগের এই আন্দোলনে আর যোগ না দেয়ার ঘোষণা দেন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় যে যাই বলেন, একবার কি ভেবে দেখেছেন কেন খুন হল রাজীব......
উত্তর পেতে চলুন ফ্লাশ ব্যাক করে ৪১ বছর আগের কিছু কথা মনে করি। ২৫ শে মার্চ ও তার পরের কিছু দিনের কথা... বাঙ্গালী জাতি মুক্তি চায়, স্বাধীনতা চায়। শত্রু একটাই ‘পাকিস্তানী হানাদার।’ কিন্তু শত্রু যখন সবার একটাই এর মাঝেই একদল লোক বলে বেড়াতে শুরু করল এটা নাকি হিন্দুস্তান- পাকিস্তান যুদ্ধ! আর সেই কথার প্রমাণে গণহত্যার প্রথম কিছুদিন চলল খুঁজে খুঁজে হিন্দু হত্যা। দিশেহারা জাতি বিভ্রান্তির চরমে স্বাধীনতা মানে কি তাহলে পাকিস্তান থেকে হিন্দুস্তান হয়ে যাওয়া??? কিন্তু সকল বিভ্রান্তি দূর হয়ে গেল কিভাবে জানেন?? যখন হানাদাররা গণহারে হিন্দু মারার কিছু দিন পরেই এবার মুখোশ খুলে নির্বিচারে সকল বাঙ্গালীকে হত্যা করতে শুরু করলো। জনতা বুঝল, ভুলটা কোথায় হয়েছে, মিথ্যা কোথায় ছিল। এই যুদ্ধ ধর্মের নয়, শত্রু একটাই পাকিস্তান। এই যুদ্ধ স্বাধীনতার। কিন্তু সেখানেও কিছু নতুন পাপ জন্ম নেয়, সেই পাপের নাম রাজাকার। যারাই এই স্বাধীনতার যুদ্ধকে ধর্ম দিয়ে ঢাকতে চেয়েছিল। পরিকল্পনা পরিষ্কার। ৯ মাসে শত্রু চলে যায়, পাপ রেখে যায়।
এবার ৪১ বছর পরের বাংলাদেশে যারা গতকাল থেকেই দ্বিধায় তারা গেম প্ল্যান মিলিয়ে নিন। আজকের এই গনজাগরনের শত্রু কে, লক্ষ্য কি? লক্ষ্য একটাই ৪১ বছর আগের, এই জাতির জন্মের সময়ের যে জন্মপাপ আছে, সেই পাপ মুক্তি। যাদের কাছে এখনও পরিষ্কার নয় তাদের আরও বুঝিয়ে বলি। যারা আজ রাস্তায় তারা ধর্মের ইস্যুতে রাস্তায় এক হয়নি। কিন্তু ধর্ম সকলকে এক হতে বাঁধা দেয়না। কেন রাজীব কেই হত্যা করা হল, আর কোন ব্লগারকে নয়?? নাস্তিকই যদি লক্ষ্য হয় তাহলে কেন আরও আগে বা আরও বেশী নেতৃত্ব স্থানীয় কেউ নয় কেন, বা এই আন্দোলনের যেসকল আস্তিক নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের কেউ নয় কেন? কারণ একটাই এইরকম নাস্তিকদের লেখার ভাষা পড়লে আপনি সহজেই রেগে যাবেন, আপনি তখন এই হত্যাকে বৈধতা দিয়ে দেবেন। এভাবে সামনে আরও কিছু নাস্তিক ব্লগারের লাশ পড়বে, আপনি রাজাকার ইস্যু থেকে নাস্তিক তার শাস্তি পাচ্ছে সেই আলোচনায় চলে যাবেন। আর এভাবে যখন হয়তো ৫ জন নাস্তিকের হত্যার পরে ৬ষ্ঠ জন হিসাবে একজন আস্তিক এবং সঠিক চিন্তাশীল ব্যক্তির লাশ পড়বে, তখনও আপনি গতানুগতিক ভাবে তাকেও নাস্তিকের খাতায় ফেলে হত্যার বৈধতা দিয়ে শাহবাগ ত্যাগ করবেন। স্পষ্ট ভাবে বলছি যারা আজ শাহবাগ ত্যাগ করছেন তারা নিজেদের আরও কাছে শত্রুকে আসার সুযোগ করে দিচ্ছেন। কারণ আপনার শত্রু ধর্মের বিভেদ নয়, শত্রু এখন প্রকাশ্য। সেই একই শত্রু, একই গেম প্ল্যান। এমনভাবে হত্যা শুরু কর যেন সবাই ভাবে নাস্তিক হত্যা, যখন সত্য বুঝবে ততদিনে আরও একটি ১৪ ডিসেম্বর ঘটিয়ে দেবে এই তরুণ প্রজন্মে।
আচ্ছা, ভাবুন আপনি যদি যুদ্ধ ক্ষেত্রে থাকতেন, আপনি কি গুলি চালানোর আগে দেখতেন সহযোদ্ধা আদৌ কোন ধর্মে শ্রদ্ধাশীল কিনা? নাস্তিকদের লেখার ভাষা যে আসলেই সুস্থ কাউকে কষ্ট দেয়ার মত সেটা নিয়ে আমার দ্বিমত নেই। কিন্তু আন্দোলন যখন সবার জন্মপাপ মুক্তি তখন ধর্ম কেন ঢাল??? আন্দোলনের পরে আবার যে যার মত নিয়ে আলাদা থাকেন, কে বাঁধা দিচ্ছে? কিন্তু অবাক লাগে যখন একজন মানুষ কে জবাই করে হত্যা, মুহূর্তেই একজন নাস্তিককে জবাই করা দিয়ে পরিবর্তিত হয়। হুম, জানাজা নিয়ে দ্বিধা থাকতে পারে ধর্ম মতে, অবশ্যই সেটার ভাল উত্তরও আছে। সেই জন্য আন্দোলনে দ্বিধা বিভক্তি তৈরি করা কি মশলা বেশী খেলে পেটের পীড়া হয় বলে বাকী জীবন অভুক্ত থাকার সামিল নয়??? যুদ্ধে বন্ধু পাবার আগে, নিশ্চিত ভাবে শত্রুকে চিহ্নিত করুন, শত্রুর ব্যাপারে একমত থাকুন। যেকোনো বিপ্লবের নিয়ম জানেন তো?? আপনি বিপ্লবে যান, বাঁধা নেই। তবে যদি সফল হতে না পারেন, চরম মূল্য দিতে হবে বাকী জীবন। তাই এখন একটাই ইস্যু তে ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী ভুলে এক হয়ে থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ, বিভেদের সময় নয়।
একটি বিষয়ে অল্প বলা ভাল, দেশের সাম্প্রতিক ইস্যু এই আন্দোলনে না থাকায় যারা নিন্দা করছেন তাদের ভাবা দরকার, আপনি চাইলে এর সাথে পদ্মা সেতু দুর্নীতি, শেয়ার বাজার, হলমার্ক, বিশ্বজিৎ, সাগর-রুনি জড়াতে পারেন কিন্তু তখন কিন্তু তার আগের ৫ বছরের গুলাও আনতে হবে। তারপর তারও আগের ৫ বছর... এভাবে ৪১ বছরকেই আনতে হবে। তখন কি আন্দোলন দলীয় হবে না চলবে? তাই আগে জন্মপাপ থেকে মুক্তি দরকার। আর ভুলে যাচ্ছেন কেন, বাকী গুলার হিসাব নিকেশ ভোটের সময় আমরাই করবো। ঐ ক্ষমতাটুকু আমাদেরই থাকছে।
সবশেষে একটি সতর্কতা জানিয়েই সাবধান করবো সবাইকে। যারা এই আন্দোলনে আছেন প্রথম থেকেই, অনেকেই রক্ত গরম হয়ে জামাত-শিবির কে প্রতিহত করার প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে নিয়ে আরও একবার রুখে দাঁড়ানোর ডাক দিচ্ছেন। যারা এমন ভাবছেন, আপনারা নিশ্চিত ভাবেই ওদের ফাঁদে পা দিচ্ছেন। কারণ ওরা সেটাই চাচ্ছে। মনে রাখবেন, একটি পরাধীন দেশ অস্ত্র হাতে নিলে হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ আর স্বাধীন দেশ অস্ত্র হাতে নিলে সেটাকে বলে গৃহযুদ্ধ। এটাই ওদের লক্ষ্য, এই কারণেই তারা গদি দখলের রাজনীতি না করে গদির মানুষদের দখলে কাজ করেছে। সামনে নিজেদের প্রয়োজনে কাউকেই আঘাত করতে তারা থামবে না, আর যদি ভাবেন আবারো সেনাবাহিনী আসবে জাতিকে রক্ষা করতে, তাহলে আবারো ভুল করলেন। হয়তো আপনি ভুলে বসে আছেন, ৪ বছর আগেই সেনাবাহিনী কে সামনের দিনের জন্য ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে পরিকল্পিত বিদ্রোহের মুখোশে। সরকারের পদক্ষেপে আমি বলবো এখন সরকারের খুশী হবার কিছু নেই। যারা সরকার কে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের বুদ্ধি দেয়, সেই একই গোষ্ঠী জামাতকেও রাস্তার প্ল্যান দেয়। তাই কেউই বিপদ মুক্ত নন। নিয়ন্ত্রনহীন জামাতকে সামলাতে সরকার যখন ব্যর্থ হবে পেতে রাখা ফাঁদে পা দিয়ে, তখনই মক্ষম সময় আজকের এই অবস্থা কে আরও তীব্র করে গৃহযুদ্ধে নিয়ে যাওয়ার। কারণ যখন দেশের সেনাবাহিনী কে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে তখন বাইরের সাহায্যই কামনা করতে বাধ্য হবে দেশ। যা সম্ভবত বিরোধী নেত্রী সেই একই গোষ্ঠীর কুপরামর্শে ইতিমধ্যে করে বসেছেন।
তাই আন্দোলনে বারবার মনে রাখুন, অপ্রকাশ্য বুদ্ধিদাতাই সর্বশেষ শত্রু হবে এবং আবারো তার দেশীয় দোসর হবে জামাত। প্ল্যান ছাড়া বিক্ষিপ্ত আন্দোলন ঐতিহাসিক না হয়ে কলঙ্কের কালিমা লেগে যেতে পারে। মনে রাখুন, পরাধীন দেশ অস্ত্র হাতে নিলে হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ আর স্বাধীন দেশ অস্ত্র হাতে নিলে সেটাকে বলে গৃহযুদ্ধ। বুদ্ধি দিয়েই জয় আনতে হবে, শক্তি তে নয়। অসীর চেয়ে মসী বড়।