হত্যা ধর্ষণ লুটপাটে অভিযুক্ত দেলোয়ার হোসেন সাঈদী
আশীষ কুমার দে : জামাতে ইসলামীর প্রথম সারির নেতা মওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী মুক্তিযুদ্ধকালে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগী হিসেবে কুখ্যাত। জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ ও শিশুসাহিত্যিক ড. জাফর ইকবালের পিতা তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমানসহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, নির্যাতন, নারী ধর্ষণ ও লুটপাটে অভিযুক্ত ধর্মের লেবাসধারী এই নেতা স্বাধীন বাংলাদেশেও দীর্ঘ সাড়ে ৩ দশক ধরে নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। মওলানা সাঈদী পবিত্র ইসলাম ধর্মকে পুঁজি হিসেবে
ষ প্রথম পাতার পর ব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলসহ তার দল জামাতের হীন রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করে চলেছেন।
দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিরোজপুর-১ (সদর ও নাজিরপুর উপজেলা) আসনে বিএনপি-জামাত জোটের প্রার্থী হিসেবে সাংসদ নির্বাচিত হন। বিগত সপ্তম সংসদ নির্বাচনেও একই আসন থেকে নগণ্য ব্যবধানে জয়ী হলেও সাঈদীর এই জয়ের পেছনে ছিল সা¤প্রদায়িক অপপ্রচার, সংখ্যালঘু হিন্দু স¤প্রদায়ের ওপর নির্মম নির্যাতন, ভোট চুরিসহ নানা গুর"তর অভিযোগ।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ধর্মের দোহাই দিয়ে নিজ জেলা পিরোজপুরে হিন্দু স¤প্রদায়ের ঘরবাড়ি, সম্পদ লুট করেছেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে গণহত্যা ও নির্যাতনে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছেন সাঈদী। পিরোজপুরে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, নির্যাতন, লুটতরাজসহ নানা যুদ্ধাপরাধের অন্যতম হোতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী। তার এসব অপকর্মের বহু নজির ও সাক্ষী আজো পাওয়া যাবে তার হাতে নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বেঁচে থাকা পিরোজপুরের স্বজনহারা মানুষের ঘরে ঘরে।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরোধী ও ঘাতক সাঈদীর দুষ্কর্মের কিছু বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে গঠিত জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্ট’-এ। ওই রিপোর্টে বলা হয় :
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই জামাত নেতা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য তার নিজ এলাকায় আল বদর, আল শামস এবং রাজাকার বাহিনী গঠন করেন এবং তাদের সরাসরি সহযোগিতা করেন। ১৯৭১ সালে তিনি সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা ছিলেন না, তবে তথাকথিত মওলানা হিসেবে তিনি তার স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতা পরিচালনা করেছেন। তার এলাকায় হানাদারদের সহযোগী বাহিনী গঠন করে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে লুটতরাজ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, হত্যা ইত্যাদি তৎপরতা পরিচালনা করেছেন বলে তার বির"দ্ধে অভিযোগ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি তার এলাকায় অপর চারজন সহযোগী নিয়ে ‘পাঁচ তহবিল’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন, যাদের প্রধান কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী বাঙালি হিন্দুদের বাড়িঘর জোরপূর্বক দখল করা এবং তাদের সম্পত্তি লুণ্ঠন করা। লুণ্ঠনকৃত এ সমস্ত সম্পদকে দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ‘গনিমতের মাল’ আখ্যায়িত করে নিজে ভোগ করতেন এবং পাড়েরহাট বন্দরে এসব বিক্রি করে ব্যবসা পরিচালনা করতেন।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পাড়েরহাট ইউনিয়নের সাবেক কমান্ডার মিজান তালুকদার একাত্তরে সাঈদীর তৎপরতার কথা উল্লেখ করে জানিয়েছেন, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় লিপ্ত ছিলেন। তিনি ধর্মের দোহাই দিয়ে পাড়েরহাট বন্দরের হিন্দু স¤প্রদায়ের ঘরবাড়ি লুট করেছেন ও নিজে মাথায় বহন করেছেন এবং মদন নামে এক হিন্দু ব্যবসায়ীর বাজারের দোকানঘর ভেঙে তার নিজ বাড়ি নিয়ে গেছেন। দেলোয়ার হোসেন সাঈদী সাহেববাজারের বিভিন্ন মনোহারি ও মুদি দোকান লুট করে লঞ্চঘাটে দোকান দিয়েছিলেন। দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর অপকর্ম ও দেশদ্রোহিতার কথা এলাকায় হাজার হাজার হিন্দু-মুসলিম আজো ভুলতে পারেনি। (মাসিক নিপুণ, আগস্ট ১৯৮৭)।
মিজান তালুকদার আরো বলেন, একাত্তর সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে দেলোয়ার হোসেন সাঈদী তার বড়ো ভাই আব্দুল মান্নান তালুকদারকে ধরে পাড়েরহাটে শান্তি কমিটির অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে আব্দুল মান্নান তালুকদারের ওপর সাঈদী অকথ্য নির্যাতন চালায় এবং তার ভাই মুক্তিযোদ্ধা মিজান তালুকদার কোথায় আছে জানতে চায় ও তার সন্ধান দিতে বলে।
গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা (বর্তমানে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়) পিরোজপুরের এডভোকেট আলী হায়দার খানও সাঈদীর বির"দ্ধে অনুরূপ অভিযোগ এনেছেন। তিনি জানিয়েছেন, সাঈদীর সহযোগিতায় তাদের এলাকার হিমাংশু বাবুর ভাই ও আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করা হয়েছে। পিরোজপুরের মেধাবী ছাত্র গণপতি হালদারকেও সাঈদী ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছেন বলে তিনি জানিয়েছেন। তৎকালীন মহকুমা পুলিশ প্রশাসক (এসডিপিও) ফয়জুর রহমান আহমেদ ( ঔপন্যাসিক হূমায়ূন আহমেদের পিতা), ভারপ্রাপ্ত মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) আবদুর রাজ্জাক এবং সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মিজানুর রহমান, স্কুল হেডমাস্টার আব্দুল গাফফার মিয়া, সমাজসেবী শামসুল হক ফরাজী, অতুল কর্মকার প্রমুখ সরকারি কর্মকর্তা ও বুদ্ধিজীবীদের সাঈদীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় হত্যা করা হয় বলে তিনি জানিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তথ্য সরবরাহকারী ভগীরথীকে তার নির্দেশেই মোটরসাইকেলের পিছনে বেঁধে পাঁচ মাইল পথ টেনে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
পাড়েরহাট ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোঃ আলাউদ্দিন খান জানিয়েছেন, সাঈদীর পরামর্শ, পরিকল্পনা এবং প্রণীত তালিকা অনুযায়ী এলাকার বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রদের পাইকারি হারে নিধন করা হয়। পাড়েরহাটের আনোয়ার হোসেন, আবু মিয়া, নূর"ল ইসলাম খান, বেনীমাধব সাহা, বিপদ সাহা, মদন সাহা প্রমুখের বসতবাড়ি, গদিঘর, সম্পত্তি এই দেলোয়ার হোসেন সাঈদী লুট করে নেন বলে তিনি গণতদন্ত কমিশনকে জানিয়েছেন।
পাড়ের হাট বন্দরের মুক্তিযোদ্ধা র"হুল আমীন নবীন জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় সাঈদী এবং তার সহযোগীরা পিরোজপুরের নিখিল পালের বাড়ি তুলে এনে পাড়ের হাট জামে মসজিদের গনিমতের মাল হিসেবে ব্যবহার করে। মদন বাবুর বাড়ি উঠিয়ে নিয়ে সাঈদী তার শ্বশুরবাড়িতে স্থাপন করেন। র"হুল আমীন জানান, ১৯৭১ সালের জুন মাসের শেষের দিকে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রেশন সংগ্রহ করতে পাড়েরহাটে গেলে দেখেন স্থানীয় শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৬০/৭০ জনের একটি দল পাড়ের হাট বন্দরে লুটপাট করছিল। পিরোজপুরের শান্তি কমিটি ও রাজাকার নেতাদের মধ্যে সেদিন পাকিস্তানি সেনা দলটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, সেকান্দার শিকদার, মওলানা মোসলেহ উদ্দিন, দানেশ মোল্লা প্রমুখ। এ ছাড়াও সাঈদীকে একটি ঘরের আসবাবপত্র লুট করে নিয়ে যেতে দেখেছিলেন র"হুল আমীন।
র"হুল আমীন নবীন আরো জানান, সাঈদী এবং তার সহযোগীরা তদানীন্তন ইপিআর সুবেদার আব্দুল আজিজ, পাড়েরহাট বন্দরের কৃষ্ণকান্ত সাহা, বাণীকান্ত সিকদার, তর"ণীকান্ত সিকদার এবং আরো অনেককে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছেন। সাঈদী হরি সাধু ও বিপদ সাহার মেয়েদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছেন। বিখ্যাত তালুকদার বাড়িতে লুটতরাজ করেছেন। ওই বাড়ি থেকে ২০/২৫ জন মহিলাকে ধরে এনে পাকসেনাদের ক্যাম্পে পাঠিয়েছেন।
ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের পিতা ফয়জুর রহমান আহমেদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে দেলোয়ার হোসেন সাঈদী জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শহীদের অপর পুত্র কথাশিল্পী মুহম্মদ জাফর ইকবাল জানিয়েছেন, দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর সহযোগিতায় ফয়জুর রহমান আহমেদকে পাকিস্তানি সৈন্যরা হত্যা করে এবং হত্যার পরদিন সাঈদীর বাহিনী পিরোজপুরের ফয়জুর রহমান আহমেদের বাড়ি সম্পূর্ণ লুট করে নিয়ে যায়।
(তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র)
রাজাকার সাঈদীনামা। (ভোরের কাগজের সৌজন্যে)
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
আগে তো পানি দিতনা মারার আগে। এখন ভাত পানি খাওয়াইয়া মারে।
আগে তো পানি দিতনা শেষ নিস্বাশের আগে। এখন ভাত পানি খাওয়াইয়া মারে। আর শামীম মোল্লা ভাইয়ের কপালে অবশ্য অত্যাচার ছাড়া কিছু জোটে নাই। “ভাই আমারে আর মাইরেন না বলে অনুনয়... ...বাকিটুকু পড়ুন
শেখ হাসিনাকে থাকতে দেয়ায়, আপনি ভারতের উপর কতটুকু রেগেছেন?
"শেখ হাসিনা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের নো-ম্যানসল্যান্ডে ঘোরাফিরা করেছে; আশা করছে, যদি কোন বিএসএফ ধাক্কা দিয়ে বাংলাদেশ সীমান্ত প্রবেশ করার ব্যবস্হা করে;" ইহা ছিলো ১ জন "নতুন মুক্তিযোদ্ধা"... ...বাকিটুকু পড়ুন
১৯৭১ এবং ২০২৪ এর হানাদার ও রাজাকারকে সমর্থন করা যায় না
১৯৭১ সালের হানাদার আমাদের দেশের সম্পদ তাদের দেশে নিয়েগেছে। ২০২৪ এর হানাদার আমাদের দেশের সম্পদ বিভিন্ন দেশে নিয়েগেছে। কারণ আমাদের দেশই এদের দেশ। ১৯৭১ সালের হানাদার ছিলো ভিনদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন
ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যা আর আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া বিবেক
একটা গল্প প্রচলিত আছে এমন: রমজান মাসে বাংলাদেশে বেড়াতে এলেন উত্তর কোরিয়ার এক নাগরিক। কোনো এক রোজাদারকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা সারাদিন না খেয়ে থাকেন কেন?
উত্তরে রোজাদার বললেন, আমরা স্র্রষ্টার... ...বাকিটুকু পড়ুন
এ বর্বরতার দায় কি শুধু ছাত্রলীগের
ঘটনার সাথে দুজন ছাত্রলীগ নেতার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।
কিন্তু এতে সকল পক্ষের দায় মোচন হয়ে যায় না। এরা যদি ছাত্রলীগ নেতাই হয় তবে তারা বিচারের আগে হলে পুনর্বাসিত হলো কি... ...বাকিটুকু পড়ুন