বইঃ একজন কমলালেবু
লেখকঃ শাহাদুজ্জামান
প্রকাশনীঃ প্রথমা
সালটা তখন ১৮৯৯, যখন একটা পুরোনো শতাব্দী ঘাট ছাড়ছে আর এগিয়ে আসছে নতুন এক শতাব্দী, বিংশ শতাব্দী..... তখুনি কুসুমকুমারী দাশ(মা) তাকে হাজির করলেন বিংশ শতাব্দীর তীব্র, তীক্ষ্ণ সব বিষয়ের মুখোমুখি করার জন্য।
মায়ের উৎসাহে কৌশোরে স্কুলের খাতায় ছেলেমানুষী ছড়া লিখলেও কবিতার আসল সিন্দবাদ জীবনানন্দের ভূত ঘাড়ে চেপেছে আরো পরে..... কুসুমকুমারীই হাঁস মায়ের মতো ঢেউয়ে ঢেউয়ে জীবনানন্দকে চিনিয়ে দিয়েছেন কবিতার হাঙর ভরা সমুদ্রের পথ। মায়ের উৎসাহে প্রথম কবিতা লেখা শুরু, তারপর দ্বিতীয় কবিতা লিখলেন দীর্ঘ ৬ বছর পর। কবিতা বিহীন এই দীর্ঘ সময়টায় কী ভাবছেন তিনি? তিনি কি এমন কোন আইকনোক্লাস্টের সন্ধান পেয়েছেন যা সম সাময়িক কবিদের চেনা ভূগোলের অনেকটা বাহিরে? তিনি যে এক নতুন সুর রিয়ালিস্টের সুচনা করবেন, তা কেউ বুঝতে পেরেছিলো?
জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যের জগতে সবচেয়ে অবহেলিত কিন্তু সর্বাপেক্ষা প্রহেলিকাময় পুরুষ। অথচ এই পৃথিবীর বুকে আজন্মকাল প্রচন্ড অন্তর্মুখী এই মানুষটি পেয়েছেন শুধুই অবহেলা। জীবদ্দশায় দেখেছেন যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ; নিজের জীবনে দেখেছেন প্রেম-অপ্রেম; পেয়েছেন উপেক্ষা। অনিশ্চয়তাবোধে আক্রান্ত, অন্তর্মুখী, একাকীত্ব পীড়িত, দ্বন্দ্বদীর্ণ। প্রেম,সংসার এসব তো তাঁর হাত ফসকে গেছেই,চেয়ে চেয়ে দেখছেন যে সাহিত্যের জন্য সবকিছু বাজি ধরেছেন,সেই সাহিত্যের পৃথিবীতেও তার কোন স্থান নেই তখন। তাঁর সমসাময়িক লেখকদের পাচ্ছেন অবজ্ঞা, উপেক্ষা। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে তেমন কোন সাহিত্যিকের কাছেই যতসামান্য সম্মান পাননি।পুরো সাহিত্য জীবনে পেয়েছেন দু'চারজন শুভাকাঙ্খী এদের কেউ ছিলেন ততকালীন অখ্যাত কবি নতুবা স্রেফ পাঠক।
জীবদ্দশায় কখনোই পায় নি কোন বিশাল সম্মাননা কিংবা তার কবিতার যথাযথ মূল্যায়ন। তিনি যেন টের পেয়ে গেছেন তাঁর লেখার যথার্থ পাঠক পাবার জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক প্রজন্ম। তিনি যেন আঁদ্রে জিদের সাথে সুর মিলিয়ে নিজের কথাই বলতে চেয়েছেন "I don't write for the coming generation but for the following one" তার মনে হয়েছে জীবন ভর দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম করে জীবন যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন । একটা চাকরির খোঁজে ঘুরেছেন মানুষের দ্বারে দ্বারে। বছরের পর বছর থেকেছেন বিনা চাকরিতে। তিনি যেন হাজার বছর ধরে পৃথিবীর নানা দিগন্ত চষে বেড়ানো ক্লান্ত এক পথিক,তিনি যেন দুদন্ড শান্তির তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন সিংহল সমুদ্র হতে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে....
শেষ পর্যন্ত তিনি কী পেয়েছিলেন শান্তির দেখা?জীবনের অন্তিম সময়ে এসেও তাঁর মনে গভীরভাবে জেগে ছিলো শোভনা,শোভনা কি তখন ভেবেছিলেন তার প্রথম প্রেমিককে?তার মিলুদাকে?আচ্ছা লাবন্যেরই বা প্রত্যাশার কতটুকু পুরন করতে পেরেছেন? লাবন্যই বা তার স্বামীকে কতটুকু বুঝতে পেরেছিলেন?
লেখালেখিকে আঁকড়ে ধরে উচ্চাকাঙ্খী জীবনানন্দ বাচঁতে চেয়েছিলেন বার বার.....সেটা আরেকবার প্রমানিত হয় তার শেষ প্রয়ানের পর। মাল্যবান সহ গোটা বিশেক উপন্যাস,একশোর বেশি গল্প,পঞ্চাশটির ওপর প্রবন্ধ,চার হাজার পৃষ্ঠার ডায়েরি লুকিয়ে রেখেছেন তারঁ প্রহেলিকাময় কালো ট্রাঙ্কে।সাহিত্যাঙ্গনে মোটামুটি পরিচিতি পাবার পরও কেন এতগুলো গল্প,উপন্যাস জনসমক্ষে আনেন নি? তিনি কী কোন ক্ষোভ হতেই চেয়েছিলেন মৃত্যুর পরেই এগুলো আসুক জনসমক্ষে?
১৯৫৪ সালের অক্টোবর মাস.....ট্রাম এগিয়ে আসছে,সেই লোকও এগিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম লাইনের দিকে,ট্রামের ড্রাইভার জোড়ে জোড়ে ঘন্টা বাজালেন,চিৎকার করে ডাকলেন, তবু সে লোক উঠে গেলেন ট্রাম লাইনের ওপর;আটকে গেলেন ট্রামের ক্যাচারে......শূন্যে ভেসে রইলো অমিমাংসিত সেই জিজ্ঞাসা, জীবনানন্দের এই মৃত্যু তাহলে কী-
দুর্ঘটনা?
আত্মহত্যা? নাকি
হত্যাকান্ড?
জীবন যে একটা অভিযাত্রা,মানুষ যে বস্তুত একজন পথিক,মৃত্যু যে সেই প্রবহমান যাত্রারই একটা অংশ, সেটাই কি আবারো মনে করে দিতেই এ আয়োজন? নাকি শঙ্খচিল, শালিক অথবা বুনোহাঁস হয়ে জন্মনেবার বীজ রোপন?
#পাঠ_প্রতিক্রিয়াঃ শাহাদুজ্জামান একজন নিরীক্ষা ধর্মী লেখক,তাঁর প্রতিটে গল্প, উপন্যাসে তিনি নিয়ে যান নিত্য নতুন প্লটে অভিনব সব কৌশলে। ক্রাচের কর্নেল কিংবা একজন কমলালেবু যেন পাঠককে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো। "একজন কমলালেবু " জীবনানন্দের জীবন কথন নিয়ে রচিত উপন্যাস যেখানে তিনি আমাদেরকে নিয়ে গেছেন জীবনানন্দের একেবারে গভীর হতে গভীরে। উন্মোচন করেছেন নানা অজানাকে........
#Home_Quarantine #Stay_home #Stay_safe
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০২০ রাত ২:৩০