ছোট বেলায় যখন আম্মু টম এন্ড জেরি দেখতে দিতো না, তখন মনে হতো টম এন্ড জেরি দেখাটাই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যেদিন বেস্ট ফ্রেন্ড ক্লাসের ফার্স্ট বয় হলো, সেদিন কোনো কথা বলি নি, রেজাল্ট জানানোর এক মিনিটের মধ্যেই মনে হতে লাগলো এটা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড না, অপরিচিত কেউ। সেদিন মনে হয়েছিলো ফার্স্ট বয় হওয়াটাই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেদিন বাসার বকাবকিতে রক ফেস্টিভ মিস করলাম, সেদিন মনে হলো জীবনের আর কোনো মানেই নেই।
অনেকের জন্যই গল্পটা পরিচিত। ঠিক, ইচ্ছে ঘুড়ির মত। রাইট ব্রাদারস এর গল্প পরে মনে হতো বিজ্ঞানী হবো। সব শিশুর মাঝেই এসময় একজন বিজ্ঞানী বাস করে হয়ত। সপ্তম পেরুনোর পর মনে হলো ফুটবলার হবো, মেসির মতো। ঝড়ের বেগে বল নিয়ে দৌঁড়াবো, বা পায়ের ম্যাজিক টাচে অসাধারণ এক গোল হবে। গ্যালারী ভেঙ্গে পরবে আমার ওপর। দশম পেরিয়ে যখন ফেসবুক একাউন্ট খুললাম, নিজেকে হ্যাকার এর থেকে কম কিছু মনে হচ্ছিলো না। আর যাই হোক, আমার এখন একটা ফেসবুক একাউন্ট আছে। আমি আর দশজনের থেকে আলাদা। চোখে গোল ফ্রেমের চশমা স্থান পেলো আর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, নাহ, কম্পিউটার প্রোগ্রামার ই হবো।
আবেগ, মানব জাতির ইচ্ছে-অনিচ্ছেয় অনেক বড় এক অংশীদার। বেশ কিছু দিন আগে ফিশ লাভ নামে একটি পোস্ট করেছিলাম, টাইমলাইনের একটু গভীর দর্শন দিলেই পেয়ে যাবেন। আমাদের ইচ্ছেয় তো পরিবর্তন হরহামেশাই আসে। অনেক সময় বন্ধুর আইফোন দেখে মনে হয় এরকম একটা আমার না হলেই নয়। একটি মেয়ের হাত ধরে মনে হয়, ওকে না পেলে আমি বাঁচবোই না। যখন একটু বয়স ভারী হতে থাকে, তখন সবাই বাস্তববাদী হয়ে পরে। ঠিক এই সময় এসে মনে হয়, বাবা তো কিছুদিন পর রিটায়ার্ড হয়ে যাবে, আমি তো ছোট থেকেই পড়ালেখায় ফাঁকি দিয়েছি, আমার তো সিজিপিয়ে ভালো না, ক্লাসের রহিম, ঐযে বোকা ছেলেটা একটা ভালো চাকরী পেয়েছে। হঠাত সবাই বড় হয়ে যায়, থাকে না আর সেই ক্ষুদে বিজ্ঞানী মন, যে রাইট ব্রাদারের আঙ্গিকে বড় হবে, রকেট বানিয়ে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ছুটে যাবে। থাকে না কিশোর ফুটবলার, উদ্দাম মাঠের তেজ। থাকে না যুবক রকস্টার, ঝাঁঝালো গিটারের ধ্বনি। কারণ সবাই তখন বড় হয়ে যায়। বাস্তববাদী হয়ে যায়। তারপর যেটা চলে সবাই সেটাকে জীবন যুদ্ধ বলে। “Life is a race, আগার তেজ নেহি ভাগা তো পিছে রে জায়োগে।” বাস, সবাই এই জীবন যুদ্ধের এক একজন অ্যাকিলিস হয়ে যায়। অনেক সিভি, ইন্টারভিউ, বিজনেস, মার্কেট, শেয়ার, টেকনোলজি ঘাটাঘাটি করে সবাই রাত দিন এক করে ফেলে। কেন? বন্ধু নতুন গাড়ি নিয়েছে, বাড়িটা বড় না করলে সমাজের স্ট্যাটাস ঠিক থাকছে না। রহিম অনেক সুন্দরী বউ পেয়ছে। চলতে থাকে অ্যাচিভমেন্ট এর লড়াই, বউ হয়ে যায় পণ্য। বন্ধুর বউ বা কাজিন এর থেকে সুন্দরী পেলাম তো। তারপর সন্তান আসে, চলে আসে দায়িত্ব। বাবা হবার মত কঠিন দায়িত্ব। জীবনের বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে দিতে কখন যে জীবন ফুরিয়ে যায়, অনেকে বুঝেই উঠতে পারে না। এবার বৃদ্ধ মনের লাগাম খোলার পালা। জীবনের হিসেব নিকেশ নিয়ে বসে এখন সবাই। কি পেলাম, কি পেলাম না। এটা হলে কি হতো, ওটা হলে কি হতো। ঠিক জীবনের শেষ প্রান্তে এসে হয়তো সবার মনে হয়, কি হতো, যদি বাস্তববাদী না হতাম? কি হতো যদি আবেগটাকে ধরে রাখতাম? কি হতো যদি সেই ক্ষুদে বিজ্ঞানী বেঁচে থাকতো মনে। কি হতো যদি গিটারের অবাধ ঝঙ্কার আমার দুবেলার খাবার জোগাড় করে দিতো। যে আবেগ কে সারাজীবন হেয় করে এসেছে, ‘এগুলো ইমম্যাচুয়র মানুষরা ভাবে, এগুলো ইমম্যাচুয়র মানুষরা করে’ বলে যেভাবে আবেগ কে অবহেলা করে আসে, এই বৃদ্ধ বয়েসে এসে সেই আবেগকেই বড় কাছের মনে হয়। মন যেনো আবার শিশু হয়ে যায়। কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মনে পরে, মৃত্যু হাতছানি দিচ্ছে, মনে পরে জীবন একটাই, মনে পরে দ্বিতীয় কোনো সুযোগ নেই, মনে পরে যে জীবন চলে গেছে তাকে আর ফিরে পাওয়া সম্ভব না। অসহায় মনে হয় না তখন নিজেকে? মনে হয়, অনেক অসহায় মনে হয়। তবে এখন আর কি করা, ফেলে আসা স্মৃতিই তখন বড় আপন হয়ে ওঠে। পুরোনো জিনিসপত্র ঘেটে পছন্দের অ্যালবাম টা খুজে বের করে তখন। গানটা ছেড়ে দিয়ে চেহার হেলান দিয়ে শুনতে থাকে। নিজের অজান্তে চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে, গলা বেয়ে নেমে আসে আফসোসের অশ্রু।
তখন নাতনি এসে বলে, দাদু, কাঁদছো কেনো। মোটা ফ্রেমের চশমাটা চোখ থেকে খুলে সেটা মুছতে মুছতে বলে, কাঁদছি না দাদুভাই, বয়স হয়েছে তো, চোখ থেকে পানি পরছে। একটা ম্লান হাসি দিয়ে নাতনিকে গল্প শোনানো শুরু করে।
শেষ !!!! চিন্তা করার পরিসর বন্ধ হয়ে যায় এখানে। থাকে না কিছুই। শূন্য।
এবার যদি আমি আপনাকে প্রশ্ন করি? আমার চোখে তাকান। দেখুন কোটি বছরের সুপ্ত আগ্নেয়গিরির লাভা হঠাত বিস্ফোরণের আশায় উঁকি দিচ্ছে এই চোখে। তাকান,,, বলুন, কি শিখলেন জীবন থেকে? কি মানে জীবনের? কেনো জন্মেছিলেন? যেটা ফেলে এসেছেন সেটা কি? সেটাই আপনি। আপনার আবেগ। আমরা বড় হই অন্যের ছাঁচে। আবেগ নামকরণ করে নিজেকে গলা টিপে হত্যা করে ফেলি আর লাশ গুম করে ফেলি বৃদ্ধ বয়সের আফসোস থেকে বাঁচতে। সবাই এক একজন খুনি, চোর, বাটপার। না, গালি দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ হচ্ছে না আমার। সভ্যতা আর সমাজের অভিনয় অনেক হয়েছে।
আবেগ।
পৃথিবীতে দু ধরণের মানুষকে আমি চিনি। একজন উপরের মত। ইলুমিনাতির কাল্পনিক বেড়াজালের মধ্যে জীবনকে না জেনে জীবন পার করে দেওয়া মানুষ। আর এক ধরণের মানুষকে আমি চিনি। যারা বড় হয় না। ম্যাচুয়র হয় না। বাস্তববাদী হয় না। যাদের মাঝের ক্ষুদে বিজ্ঞানীটা কখনো মারা যায় না। যারা গিটার হাতে ঘর ছাড়ে, দায়িত্ব অবহেলা করে। যাদের সমাজ ভালো চোখে দেখে না, মানুষ ভালো বলে না, যাদের নিয়ে চায়ের দোকান থেকে বাসার ছাদে সমালোচনা হয়। কেনো? কারণ তারা নিজেকে খুন করতে পারে না। তারা জানে জীবন একটাই। নিজের মত করে বাঁচতে চায়, হাসতে চায়, কাঁদতে চায়, ভুল করতে চায়। কিন্তু মৃত্যুর সময় এক নিষ্পাপ প্রশান্তি নিয়ে মরতে চায়, আফসোস নিয়ে নয়। যারা নিজেকে বার বার সমালোচনা আর গালমন্দের মধ্যে ফেলে কারণ তারা নিজের স্বকীয়তা নিয়ে বাঁচে। যারা পদে পদে পৃথিবীকে চ্যালেঞ্জ করে নিজের ইচ্ছেকে বাঁচিয়ে রাখতে। যারা নিজেকে আগুনে পুরিয়ে যাচাই করে নেয় খাঁটি আছে কিনা এটা দেখতে। নিজেকে নিজে বকে, চড় দেয়, শাসন করে। কিন্তু অন্যের জন্য বলি দেয় না।
যদি এটাই শেষ কথা হয়, আমি দ্বিতীয় দলে থাকতে বেশি পছন্দ করবো। হে সমাজ, আমি চাই না তোমার আশ্রয়, হে সমাজ, আমি হয়েছি আজ নির্ভয়।
--------------------------------
ডেডিকেশন: লেখাটা একটি প্রজাপতিকে ডেডিকেট করলাম, যে খোলা আকাশে উড়তো। যার ডানা কেটে দেওয়া হয়েছে।
-জোবায়ের হোসেন জিহাদ
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০২০ রাত ১:০৮