অদ্য বিকালে বেশ সাজুগুজু করিয়া বাহির হইলাম, গন্তব্য শ্যামলী। উদ্দেশ্য সম্প্রর্কিত ফুফাত ভ্রাতার ‘ফাইল ট্রান্সফার’ , ইয়ের নিমিত্ত। তাই উক্ত ফুফাত ভ্রাতার পুনঃপুনঃ মুঠোফোনে সনির্বন্ধ অনুরোধ , খ্যাত সাজিয়া যাইস না প্লীজ। কারণ আমার অফিসিয়াল মিটিং এ ও খ্যাত সাজিয়া যাইবার খ্যাতি সর্বজনবিদিত। তাই উনার ইয়ে মানে বিয়ে রক্ষাকল্পে আমার সাজুগুজুর প্রচেষ্টা।
যাইহোক , অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করিয়া ভ্রাতের ভবিষ্য শ্বশুরের গরিলাসদৃশ দৈহিক পরিমন্ডল চিন্তা করিতে করিতে মিচকি হাসি দিয়া সিটি হাসপাতালের সন্নিকটে আসিতেই মুঠোফোনে আরেকটি অনুরোধ আসিয়া হাজির হইল। মানব-মানবীসেবায়ই আমার জীবনটা শেষ হইয়া যাইবে কিনা এইরুপ আশংকা ভাবিতে ভাবিতে অতঃপর ধানমন্ডির পিৎজা-হাটের কাছে আসিয়াই বালিকার নিকট ধরা পড়িলাম।
বালিকা কিন্নরী, উর্বশী ও বটে। দ্বাবিংশ বৎসর সবে অতিক্রম করিয়াছে, প্রফুস্টয়মান কল্লোলিনী। চলিত ভাষায় যাহাকে বলে ‘ন্যাকামি’ তাহার যথাযথ প্রয়োগ ঘটাইতেও পারঙ্গম। বৈকালের সোনাঝরা রৌদ্র মরিয়া আসিয়াছে , বালিকা ত্রিচক্রযান সহযোগে পরিভ্রমণের প্রস্তাব উত্থাপন করিল। ঘর্মাক্ত কলেবর হইয়া সুন্দরী রুপসী বালিকাকে লইয়া আড়ষ্ট হইয়া হাঁটিবার চাইতে প্রস্তাব শ্রেয় মনে হওয়ায় সম্মতিদানপূর্বক অনির্দিষ্ট গন্তব্যের ঠিকানা দিয়া একখানা বৃদ্ধচালিত ত্রিচক্রযানে চড়িয়া বসিলাম।
বালিকা হাস্যকলরোলে চারদিক চমকিত করিয়ে ধ্রুপদী ভঙ্গি রপ্ত করা প্রক্রিয়ার হস্তচালনা করিয়া নানা কিছু বলিতে লাগিল, আমিও অগত্যা
তাল মিলাইবার নিমিত্ত আগডম-বাগডম বকিতে লাগিলাম। বালিকা কিয়ৎক্ষণ পরপরই ‘কি সুইট’, ‘হাউ ফানি’, ‘আল্লা আপ্নের ভাঙ্গা দাঁতের হাসিটা কি কিউট’ ইত্যাদি বিশেষণ যোগ করিতে লাগিলো; কিন্তু অনুধাবন করিলাম যে , আমার বৃদ্ধকাল সন্নিকটবর্তী, কারণ যথোপযুক্ত চমকিত আবেশিত আপ্লুত হইতে পারিতেছিলাম না। রাইফেলস পার হইয়া স্টার কাবাবের সন্নিকটবর্তী হইবার পর চালক জানাইলো , অনির্দিষ্ট যাত্রা এইখানেই সমাপ্ত করিতে হইবে, এর চাইতে অগ্রসর হইবার অনুমতি এই ব্রাত্য ত্রিচক্রযানের নাই।
বালিকা তাহার ক্ষুদ্র পুঁটুলিখানা আমার হস্তে অর্পণ করিয়া কেশরাজির যত্ন করিতে লাগিলো, কয়েকটি বাপে-তাড়ানো-মায়ে-খেদানো ধরণের যুবক সিঁড়িতে বসিয়া আমাদিগকে নিবিষ্টচিত্তে পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিলো। অনভ্যাসবসত প্রবল অস্বস্তিযোগে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, আমাদের আর কি কি করিতে হইবে। বালিকা অভিজ্ঞ, আমার মত নবীস নহে, খিলখিল হাসিয়া কহিলো,’কি করিতে হইবে তাহা বুঝি জানেন না?’
ইহার আগে অনাত্নীয় রমনীকূলের মধ্যে কেবলমাত্র রিমা’পুর সাথে ব্যাপক ভ্রমণ করিয়াছি, কিন্তু সে তো আপু, আমার অভিভাবকসম। ইহার মত উর্বশী মনোহরণী নহে। ইত্যকার সংক্ষিপ্ত ভ্রমণের পর দুইটি ব্যাবহারিক জ্ঞান লাভ করিলাম। একঃ কোনো রুপসী বালিকা সহযোগে ভ্রমণে বের হইলে জনগন আপনাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করিবে, ক্ষেত্রবিশেষে ত্রিচক্রযান হইতে ঘাড় ২৭০ ডিগ্রী ঘুরাইয়া হইলেও দেখিবে। দুইঃ আপনার ত্রিচক্রযান চালককে কোন কারণে সামান্য দূর যাইতে বা ঘুরিয়া আসিতে বলিলে সে অতিরিক্ত নায্য দুইটি মুদ্রার বদলে দশটি মুদ্রা দাবী করিবে।
অতঃপর আবার তাহাকে লইয়া ত্রিচক্রযানে চড়িয়া বসিলাম, এইবার বিপরীতমুখী এবং যাত্রা নির্দিষ্ট। বালিকা যথাযথ ন্যাকামির সাথে জানাইলো যে তাহার সন্ধানে এবং অভিজ্ঞতায় একটি উৎকৃষ্ট আইসক্রীম বিক্রয়কেন্দ্র আছে, স্বাদে অমৃত। অবাধ্য হইয়া নিজের ক্ষীয়মান মানে টান লাগাইতে ইচ্ছাপোষণ করিলাম না, আবারও ঘুরিয়া পিৎজা হাটের নিকটবর্তী সেই অমৃত বিক্রয়কেন্দ্রে আসিয়া উপনীত হইলাম। বালিকা চারটি ‘অমৃতের’ নির্দেশ প্রদান করিল, তারপর আবার তাহার কিন্নরী কণ্ঠের সুধায় আমায় ভাসাইতে লাগিল। বালিকা বিভিন্ন ব্যাপারে পুনঃপুনঃ আমার প্রশংসাবাচন উচ্চারণ করিয়া ( সম্পূর্নই শ্রবণকৃত, জ্ঞানলব্ধ নয়) আমাকে
পুলক অনুধাবনের সুযোগ দিলো। আমিও ইত্যবসরে আড়ষ্টতা কাটাইয়া উঠিয়া নিজমধ্যে অকারণ গর্ব টের পাইতে লাগিলাম , আড়চোখে অন্যান্য যুগল অযুগলদের দৃষ্টিপাত নেত্রপাত দেখিয়া।
আইসক্রীম নামক বস্তুটি আসিবার পর মূল্য তুলনাপূর্বক আমি আতশী কাঁচ নামক বস্তুটির অভাব ব্যাপক অনুধাবন করিলাম। পান্থপথের ডেরার সম্মুখে আমরা মাঝে মাঝে দুইমুদ্রা প্রদানপূর্বক চা পান করিয়া থাকি, ইহার পাত্রের আকার তদীয় সদৃশ।
আধুনিক পরিমাপে একটি ঘন্টা ছায়াআলোতে কাটাইয়া, অর্ধসহস্রাধিকেরও বেশী মুদ্রা বালিকা কথিত অমৃতের মূল্য হিসাবে পরিশোধ করিয়া
প্রস্থান করিলাম। ভাবিলাম, আমার নিবাসের বুয়া নামক ‘কাজের যন্ত্রটির’ এই মুদ্রা উপার্জন করিতে প্রায় ত্রয়োদশটি দিন ব্যয় করিতে হয়।
আবারও ত্রিচক্রযানে আরোহণপূর্বক রাপা প্লাজার নিকটে আসিয়া আমার প্রাণপ্রতীম বন্ধুবর, যাহার অনুরোধে আমি এই অগ্রে নিবাস হইতে নির্গমিতা তাহার প্রেমাস্পদ বালিকাকে সঙ্গ দিয়াছি, তাহাকে অর্পন করিলাম এবং বন্ধুবরের পুনঃপুনঃ অপরিসীম কৃতজ্ঞতা ও প্রশস্তি ( আমি এই অপরিণামদর্শী কাজে এখনো মগ্ন হই নাই এই জাতীয়) লাভ করিয়া বিদায় লইলাম। বালিকা সুমিষ্ট হাসি এবং ধন্যবাদ প্রদানপূর্বক ‘বাব্বাই’ বলিয়া বন্ধুবরের পশ্চাতচারিণী হইলো।
অতঃপর শুক্রাবাদ হইতে ইচ্ছামত দরদাম করিয়া পান্থপথের নিবাস পর্যন্ত আরেকটি যান ( ইহার নাম হয় রিকশা) ভাড়া করিলাম, পঞ্চাশমুদ্রা ব্যায়পূর্বক কোন আইসক্রীম নামক ইগলু কোম্পানির দুইটি বস্তু কিনিয়া একটি চালককে দিলাম আর খাইতে লাগিলাম। সমবয়সী চালক ইহাতে ব্যাপক বিস্মিত, কারণ দরদামের সময় আমি সম্পূর্ণ শক্তি, অর্থনীতির তুলনামূলক তত্ত্ব ইত্যাদির প্রয়োগ করিয়াছিলাম এবং কন্ঠশক্তির ব্যাবহারেও পিছপা হই নাই।
এইরুপ অভিজ্ঞতার পর নিজেকে কি সৌভাগ্যবান না দুর্ভাগ্যবান ভাবিবো (কারণ আমাকে নিত্য চিন্তিত হইতে হইবে এইরুপ কোন বালিকা নাই) তাহাই ভাবিয়া কূল পাইতেছি না, তাই ব্লগার ভ্রাত-ভগ্নীগণের দ্বারস্থ হইলাম।
আশা করিতেছি আপনারা নিরাশ করিবেন না, চিত্তদোদুল্যমনতা হইতে সহৃদয়তার সাথে আমাকে উদ্ধার করিবেন।
(নিবাসে আসিয়া কিছুটা এলোমেলো অনুভূত হইতেছে , তাই এই গুরুচন্ডালী কথন রচনা করিলাম ব্লগীয় সমাজের কাছে। এই গুরুচন্ডালী অপরাধে সজ্ঞানে মাইনাস প্রদান করা জায়েজ বলিয়া অনুমতি দান করিলাম।)