গল্পটার শুরু হয় এই লাইন দিয়ে—নিখুঁত লেখা বলে কিছু নেই, যেমন নেই নিখুঁত হতাশা বলে কিছু। সুতরাং আপনি যখন তা শুরু করতে যাচ্ছেন—সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে একটা এলোমেলো আখ্যান সম্পর্কে—এবসলিউট সাহিত্য নিয়ে আপনি যদি খুঁতখুঁতে থাকেন এ বই আপনার জন্য নয় বরং এ গল্প তাদের জন্য যারা রাত তিনটায় ফ্রিজ খুলে দেখে খাওয়ার মত কিছু সেখানে আছে কিনা।
উপন্যাসের মূলচরিত্র এক নামহীন যুবক—ছুটি কাটাতে এসেছে নিজ শহরে—তার অল্প কিছু কাজ: ঘুমানো, খাওয়া আর 'জে' নামের এক বৃদ্ধের বারে বসে বিয়ার গেলা। এখানে তার সঙ্গী হচ্ছে র্যাট নামের প্রায় সমবয়সি আরও এক যুবক। র্যাটের সাথে গল্পের নায়ক নানান বিচিত্র গল্প করে। একটা উদাহরণ দেয়া যাক- জাহাজে করে কোথাও যাচ্ছি হঠাৎ জাহাজ ডুবে গেল। একটা কাঠের টুকরো ধরে আমি ভেসে আছি এমন সময় ভাসতে ভাসতে কাছে চলে এল এক রূপবতী নারী—এরপর এক কেস বিয়ারও চলে আসবে ভেসে ভেসে—আমি আর সেই সুন্দরি মেয়ে বিয়ারের ক্যান খালি করে যাব একের পর এক আর করবো গল্প। ভাসতে ভাসতে আমরা ডাঙ্গা পেয়ে যাব একসময়। বহুদিন বাদে আবার দেখা হবে আমাদের, তখন একসাথে আমরা বারে যাব ফের আর শুধু বিয়ারই গিলে যাব বোতলের পর বোতল।
মূলত পুরো গল্পটাই এই একের পর এক বিয়ারের বোতল খালি করার, র্যাটের বই পাঠ আর উপন্যাস লিখবার, ডেরেক হার্টফিল্ড নামের এক অজানা আমেরিকান লেখকের যে কিনা একদিন আত্মহত্যা করেছিল এম্পায়ার এস্টেট বিল্ডিং এর ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে—তার বুকে জড়ানো ছিল হিটলারের একটা পোর্ট্রেট আর হাতে একটা ছাতা! এর সাথে যোগ হবে উপন্যাসের যে ন্যারেটর তার বিচিত্র যৌনজীবনের স্মৃতি—অতঃপর এক নারীর প্রেমে পড়ে যাওয়া—এই এলোমেলো আখ্যানের মাঝ দিয়েই আদতে পাঠক পেয়ে যাবেন জীবনের এক দার্শনিক চেহারা। যেখানে আমাদের বলা হয় সব কিছু পূর্ব-নির্ধারিত অথচ আমরা কি পাচ্ছি আর হারাচ্ছি এ সম্পর্কে বুঝে উঠবার ক্ষমতা এক জীবনে আমাদের মেলেনা।
প্রখ্যাত জাপানি ঔপোন্যাসিক হারুকি মুরাকামির প্রথম বই এটি—প্রকাশিত হয় ১৯৭৯ সালে—বলা হয় এটি র্যাট ট্রিলোজির প্রথম বই। ১৯৮০'তে প্রকাশিত হয় 'পিনবল, ১৯৭৩' এবং ১৯৮১ সালে 'আ ওয়াইল্ড শিপ চেজ'—তিনটি উপন্যাসের মুখ্য চরিত্রে আছে র্যাট নামের উদাসিন যুবকটি, যে নিজেও একজন উপন্যাসিক হতে চায়। গুঞ্জো, জাপানের সবচে' নাম করা সাহিত্য পত্রিকাগুলোর একটা—বই হিসেবে বেরুবার আগে হিয়ার দা উইন্ড সিং এখানে তরুণ ঔপোন্যাসিকের পান্ডুলিপি হিসেবে ছাপা হলেই মূলত উপন্যাসটির বিচিত্র ন্যারেটিভ নিয়ে জাপানে হৈচৈ পড়ে যায় যদিও মুরাকামি পরবর্তিকালে এ বই সম্পর্কে বলেছেন, তারকাছে এটা এমেচারিশ কাজ—নিজের মত অনুসারে মুরাকামির গুরুত্বপূর্ণ কাজের শুরু হয় মূলত ট্রিলোজির শেষ বই 'আ ওয়াল্ডশিপ চেজ' থেকে। প্রথম বই সম্পর্কে জগৎবিখ্যাত লেখকদের অনেকেই ওই এমেচারিশ শব্দটা ব্যবহার করলেও জগতের তাবত পাঠকের কাছে তাদের প্রথম বইগুলোও একেকটা বিস্ময়। সেদিক থেকে 'হিয়ার দা উইন্ড সিং' পড়তে পড়তেও আমরা ওই বিস্ময় টের পাই—অবাক লাগেনা এ লেখকের হাতেই পরবর্তিতে বেরিয়েছে কাফকা অন দা শোর কিংবা দা উইন্ডাপ বার্ড ক্রনিকলস'র মত মহৎ উপন্যাস।
পাদটিকা: জিয়া হাশানের বাংলা ভাষান্তরে 'শোনো বাতাসের সুর' পড়ে এই হল আমার মতামত। লেখকের প্রথম উপন্যাস দিয়েই তাকে পাঠ শুরু করা গেল—এই ভেবেও আনন্দ পাওয়া যায়। অনুবাদ সাবলিল হলেও কিছু কিছু যায়গায় বিরক্ত হয়েছি শব্দের ব্যাবহারে, যেমন ফ্রেঞ্চ শব্দটা অনুবাদক কখনও ফ্রান্স লিখলেন, আবার লিখলেন ফ্রেন্স—কোথাও চলতি ঢাকাইয়া ট্রেন্ডের শব্দও থিমের গভীরতা হালকা করবার অপচেষ্টা করেছে, তবু সব মিলিয়ে ঝরঝরে লেগেছে ভাষান্তরিকের কাজ।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৪:২৮