স্বপ্নটা দীর্ঘ, তার কাছে রীতিমতো সেটা মহাকাব্যিক। যে রাতে স্বপ্নটা দেখে ঘুম ভাঙ্গে, মনে হয় কতশত যুগ পেরিয়ে আসা হলো! শরীর থেকে কেমন গরম ভাপ বের হয়। অথচ খানিকপরেই শীত শীত লাগে, এই অনুভূতি ধোঁয়াটে। আজও মুকুল আঁৎকা ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসলো, ক’টা বাজে দেখতে হলে সেলফোনটা খুঁজে বের করতে হবে, তার ঘরের দেয়ালে কিংবা হাতের কব্জিতে কোন ঘড়ি নেই। স্বপ্নটা কী? হাবিজাবি ব্যাপার মনে হওয়া ছাড়া উপায় নাও থাকতে পারে। গরুগাড়ি করে কোথায় যাচ্ছে মুকুল, ছাউনীর দু’মুখেই পর্দা টানা। ভেতরে সে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে, ভিষণ দুলছে গাড়ি, মাটির রাস্তায় চাকা গড়ানোর বিষণ্ন আর্তনাদ টের পাওয়া যাচ্ছে। মুহূর্তে মনে হলো গাড়ির ভিতর অন্ধকার এবং ছোট্ট জায়গাটিতে তার সাথে আছে আরও একজন, খুব কাছেই, তার গা থেকে আসছে নতুন কাপড়ের ঘ্রাণ। ‘ঘুম ভাল হয়নি?’ একটা রিনরিনে নারীকণ্ঠ, কী গভীর মমতা ঝরে পড়ছে ওই ছোট্ট প্রশ্নটায়, গরুর গাড়ির ছইয়ের নিচে যেন খুব শ্রান্তির ঘুম দেবার কথা মুকুলের, ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় নারীকণ্ঠটি যেন খুব দুঃশ্চিন্তায় পড়েছে!
স্বপ্ন দীর্ঘ। অন্তত তার কাছে সেটাই মনে হয়, একেকদিন একেকভাবে স্বপ্নটা আসে। প্রথমবার খুব অবাক হয়েছিল সে। স্বপ্ন শুরু হয়েছিলো চলন্ত বাসে, পাশের সিটে বসেছিলো এক দুর্দান্ত বৃদ্ধ, একটাও দাঁত অবশিষ্ট না থাকার ফলে যার গালের চামড়া ভেতরে ঢুকে গেছে, চোখ দু’টোর চারপাশ কুঞ্চিত এবং জায়গাটা ভেতরে সেঁটিয়ে যাওয়া ফলে অক্ষিগোলকের ভেতর চোখ ছিলো কিনা আন্দাজ হচ্ছিলো না। স্বপ্নের মাঝেই ভিড় বাসটি হঠাৎ গরুর গাড়ি হয়ে গেলো। সে দেখলো গরুর গাড়িটা মাটির রাস্তা ছুটছে না, উড়ছে রীতিমতো উঁচু আকাশে। তার উচ্চতাভীতি ছোটবেলা থেকেই বড় প্রবল, ওদিন চিৎকার করেই ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠেছিলো সে, দেখেছিল পিঠের নিচে বিছানা, মাথার নিচে বালিশ ভিজে গেছে ঘামে। আজ অবশ্য তেমন ভয়ের কোন ব্যাপার ঘটেনি, শুধু প্রচণ্ড শীতে তার শরীরটা বারবার কেমন কেঁপে উঠছে অথচ এটা শীতকাল তো না, বর্ষার শুরু এখন। বিছানায় বসে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে, খুব বৃষ্টি হচ্ছিল সেসময়। সেটাই কি শীত করবার কারণ? হতে পারে।
বিছানা থেকে নেমে সে তার রুমের সাথে লাগোয়া বাথরুমে ঢুকলো। নিম্নচাপের কারণে ব্লাডার ফেটে যাবার দশা হয়েছে! বাথরুমে ঢুকবার আগে তো এতটা তীব্র ছিলো না চাপটা। ব্লাডারের প্রেশার কমাতে কমাতে মুকুল দেখল, ভেন্টিলেটরের পাশের দেয়ালে ঝুলে থাকা বস্তুটাকে। কী ওটা?
অনেক আগের কথাই তো হবে, তার শৈশবের কথা। যদিও তাদের পরিবারের সে আমলে কারো প্লেনে চড়ার মতো ঘটনা ঘটেনি, বাসায় কীভাবে একটা এয়ার ম্যাগাজিন চলে এসেছিলো। আগ্রাসী পাঠক মুকুলের কাছে সেটা ছিল সোনার খনি। আয়না আবিষ্কারের দুর্দান্ত গল্পটা জীবনে প্রথম ওই এয়ার ম্যাগাজিনেই পড়েছিলো সে। সেই যে এক চাষী ধানক্ষেতের মধ্যে এক টুকরো কাঁচ কুড়িয়ে পেলো, যাতে অবিকল একটা মানুষের মুখ দেখা যাচ্ছে। আনন্দে আটখানা, বিস্মিত চাষী ভাবলো কোন এক অলৌকিক উপায়ে স্বর্গপ্রাপ্ত বাপজান ফিরে এসেছে তার কাছে, নইলে কাঁচের টুকরোটিতে ওই মুখ কারই বা হবে? আবার দেখো কেমন অবাক হয়ে বাপজান চেয়ে আছে তার দিকেই। অন্যদিকে তো তাকাচ্ছে না, যেমন মুগ্ধ হয়ে সে নিজেও তাকিয়ে আছে! মাঝে মাঝে চাষী সেই কাঁচখণ্ডটা বের করে, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সেটির দিকে। কখনও হাসে, আবার কখনও আবেগে তার চোখে পানি চলে আসে। তবে নিজের বউয়ের থেকে ব্যপারটা সে লুকিয়ে রাখে, লুকিয়ে রাখে আয়নাটাও। আড়াল থেকে ব্যাপারটা খেয়াল করে চাষীর বউ। রোজ পানি রাখার বড় জালাটার ভিতর থেকে কী বের করে তার মিনসে? ভারি রহস্য তো! একদিন চুপি চুপি লুকিয়ে রাখা কাঁচখণ্ডটা বের করে চাষীর বউ দেখতে পায়, খুব রূপবতী এক নারীকে। হিংসায় নারীটি জ্বলে খাক হতে থাকে। ‘ও এই ব্যাপার? মিনসেটা তাহলে গোপনে গোপনে সতীন এনেছে ঘরে?’
এতসব মজার গল্পের ভিড়ে ম্যাগাজিনের একটা পাতায় সরিসৃপ নিয়ে রঙিন কিছু ছবি ছিলো। মুকুলের মনে পড়লো, সেই পাতাতেই এমন বড়সড় এক টিকটিকির ছবি ছিলো, নিচে নাম লেখা— তক্ষক। ভেন্টিলেটরের পাশের দেয়ালে ঝুলে থাকা প্রায় আধহাত লম্বা, বেশ পুরুষ্টু প্রাণীটি কি সেই তক্ষক? তার ধারণার প্রমাণ দিতেই হয়তো তক্ষকটি ডেকে উঠলো— টক্কটক্কটক.. তক্কতকতক। মনে হল, প্রাণীটা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকেই।
কী অদ্ভুত দেখতে ওটা! ফ্যাকাশে শরীর এতটাই স্বচ্ছ যে দেহের বিভিন্ন জায়গায় ফুলে ওঠা কালচে, নীলচে শীরাগুলোও দেখা যাচ্ছে, পেটটা বেঢপ ফোলা। আবার দেখো, কেমন কাঁপছে জায়গাটা! পাকস্থলিটা হঠাৎ উলটে আসছে, এমন অনুভূতি হল, দু’এক সেকেন্ড বাদেই বাথরুম ভাসিয়ে বমি করলো মুকুল। আহামরি কোন পদার্থে বাথরুম ভাসলো না। কিছু হলুদাভ তরলের সাথে অর্ধগলিত সবজি, মাংশকণা! ভাতগুলো হজম হবার ফুরসত না পেয়ে কেমন গলা গলা হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দুর্গন্ধের তোড়টা সহ্য করতে না পেরে মুকুল আরো কিছুক্ষণ ওয়াক ওয়াক শব্দ করলো, পেটে খানিকটা ঘোলা তরল ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট ছিলো না, বেরিয়ে পড়লো সেটুকুও।
তার কল্পনায় জহুর কাকার কথা ঘুরতে লাগলো, গ্রামে থাকতো তারা তখন। সে বছর কী এক গুজব উঠেছিল দেশময়, কেজিখানিক ওজনের একটা তক্ষক নাকি কোটি টাকায় বিক্রি হচ্ছিলো, গ্রামের লোকজন বলতো তক্কসাপ। জীবিকার খোঁজে হন্যে হয়ে ফিরতে থাকা জহুর কাকা, একটা বড়-সড় তক্ষকের খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে উন্মাদের পর্যায়ে পৌছে গেছিলেন। কারা বা সেসব ধরছে, কারাই বা কিনছে এর কোন হদিস কেউ জানতো না। কেউ বলতো পথের বাজারে এক গুড়বিক্রেতা পেয়েছে একটা খুঁজে, বেচেও দিয়েছে মেলা টাকায়, কেউ বলতো দুর্জনীমহলে কেজিখানিক ওজনেরই একটা ধরেছে শনু মণ্ডলের ভাইপো! অবশ্য সেসব ব্যাপার যাচাই করা দুরূহ ছিল। তাই গল্প বলেই সান্ত্বনা খুঁজতো গ্রামের প্রতিটা সন্ধ্যা, বাজারে জড়ো হওয়া শ্রমীকের দল কিংবা খেলার শেষে নদীতে ঝাঁপাতে থাকা বালকের পাল। আর বিকেলে ঘরের দাওয়ায় গোল হয়ে বসে গ্রাম্য গৃহিনীরা নতুন এক গুজবের খনি নিয়েই তো নাড়াচাড়া করতো সেসব দিনগুলোতে! কে কবে কোথায় একটা তক্ক দেখেছে কিংবা আরেকটু হলে প্রায় ধরেই ফেলেছিলো! জহুর কাকার কথাগুলো তার কানে বাজতে থাকে মহার মশার গুঞ্জন হয়ে— ‘বুজদি পাইল্লে বাপ, ইবারা তুমার জহুর কাকু ধরো বকশাই যাবে নে। পানিগাতির ভাঙ্গা মন্দিরির ভিতর আমি নিজি ডাকতি শুনিসি গত রাত্তিরি.. ’ মুকুল অবাক হত। ‘কী বলেন কাকা? রাত দুপুরে পানিগাতির ভাঙ্গা মন্দিরে চলে গেছিলেন?’ গলায় একরাশ উৎসাহ নিয়ে ছন্নছাড়া মানুষটা বলতো, ‘আরে কোটি টাহা কামাতি হলি সাধনা করা লাগবেনা?’
মুখে পানির ঝাপ্টা দিতে দিতে মুকুল ভাবল খানিক আগে দেখা বিদঘুটে জীবটা কি কেজি খানিক ওজনের হবে? এই ইট-রড-চিলেকোঠার নগরে এমন প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীটা আসলো কিভাবে কে জানে?
তক্ষকটি দেওয়ালে লেগে রইলো, মুকুল আর আগ্রহ পেলো না সেদিকে তাকাবার। বিছানায় বসতে বসতে তার মনে হল— কিছু একটা সে ভুলে যাচ্ছে। কোন ব্যাপারটা? হঠাৎ খুব অস্থির লাগতে শুরু করলো। কোন ব্যাপারটা সে ভুলে গেলো, কেন মনে পড়ছে না কিছু? যতোসব আজেবাজে স্মৃতি হুটহাট তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে অথচ দরকারগুলো সে ভুলে যাবে? আজকাল তার এমন হচ্ছে। যেকোন বিষয়ে অস্থির বোধ করা। হঠাৎ মনে পড়লো— রফিককে ফোন করে দরকারি একটা কথা বলার ছিলো। কী কথা? রফিকের সাথে দেখা হবার আগপর্যন্ত সেই কথাটা আর মনে পড়বে না, সে নিশ্চিত বুঝতে পারছে অথচ রফিকের সাথে তার কীভাবে দেখা হবে?
এমন সময় দরজার ওপাশে করাঘাত শোনা গেলো। ঠক ঠক কেন করছে লোকটা? বেল বাজালেই পারে। তখন খেয়াল হলো, কলিংবেলটা দু’দিন ধরে অঁকেজো হয়ে আছে, সারানো হয়নি। কিসব উল্টা-পাল্টা সে ভাবছে? কলিংবেল তো বাইরে থেকে ড্রয়িংরুমে ঢোকার জন্য। তার রুমে ঢুকতে হলে কাউকে দরজাতেই নক করতে হবে। ওপাশ থেকে করাঘাতটা ক্রমাগত চলছে। কারো কণ্ঠস্বর পাওয়া গেলো। ‘মুকুল, ও মুকুল দরজাটা খোল!’
বড় ভাইজান এত রাতে ডাকছে ব্যাপার কী? বিছানায় শুয়ে শুয়েই সে জবাব দিলো— কী ব্যাপার ভাইজান? তার বড় ভাইয়ের কণ্ঠে অস্থিরতা বেজে উঠলো। ‘খোল দরজাটা! জলদি কর… দরজা ভেঙ্গে চাবকাতে হবে নাকি তোকে? এই অবস্থায় কীভাবে ঘুমিয়ে পড়লি তুই? উহ!’
দরজা খুলে মুকুল অবাক হলো। তার বড়ভাই কামরুলের গোলগাল মতোন চেহারাটা মোটামুটি বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। চোখের নিচে শুকিয়ে যাওয়া কাজলের মতো কালো দাগ, মুখটা কেমন আমসি মেরে গেছে। এমন কী হয়ে গেলো এর ভেতর! রাতে ঘুম হয় না নাকি বড় ভাইজানের? ভাইয়ের মুখমণ্ডলের না-কামানো খোঁচাখোঁচা দাড়িগুলো তার মনে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া তৈরী করে, এমন মুখভর্তি শলা কেন তার বড় ভাইজানের বদনে? আবার দেখো কেমন করে ঠোঁট নাড়ছে। বলেটা কী ও?
– মুকুল, চল জলদি চল.. কী হল?
কামরুল খানিকটা চিৎকার করে উঠেছে, চমকে তাকালো মুকুল। ‘এ্যাঁ? কী ব্যাপার ভাইজান? ও আচ্ছা, চলো শিগগীর…’
তিনতলার উপরে তাদের ফ্ল্যাট বাসাটা। সিঁড়ি ভেঙ্গে বড় ভাইয়ের পেছনে তরতরিয়ে নামতে নামতে ব্যাপারগুলো পরিষ্কার হতে শুরু করে মুকুলের কাছে। মনে পড়ে ঘন্টা দুয়েক আগে তীব্র প্রসব যন্ত্রণায় কাতর হয়ে তার ভাবি হাসপাতালের দিকে রওনা করেছে। ভাবির সাথে তার রক্তের গ্রুপ ম্যাচড, ও পজিটিভ। ঠিক করা ছিলো রক্ত লাগলে মুকুল দেবে, দুঃশ্চিন্তার কোন ব্যাপার ছিলো না কিন্তু বাস্তবে রক্তক্ষরণ কতটা দুঃশ্চিন্তার,কামরুলের চেহারার বিবরণ সেটার প্রমাণ। ‘প্রচুর রক্ত যাচ্ছে বুঝলি? ডাক্তাররাও ভয় পাচ্ছে, তোর একার রক্তে কুলাবে না মনে হয়। আরো লাগবে.. ’
কী বলবে সে, তা ভেবে পাওয়া দুষ্কর। মুকুল তার অগ্রজের পিছে পিছে সিঁড়ি ভাঙতে লাগলো চুপচাপ। অন্ধকার সিঁড়ি ঠিক না, চারদিকে ঘোলাটে একটা লাল আলো। লাইটটা কোথায় লাগানো মুকুল খুঁজে পায় না, কামরুলের অস্থির কণ্ঠস্বর আবার তার মনযোগ কাড়ে। ‘বুঝলি না? খুব রক্ত যাচ্ছে! আমার বড় ভয় লাগছেরে ছোট…’
ছোট? তার মনে পড়লো আদর করে মা এই নামে তাকে ডাকতো আগে, আজকাল আর ডাকে না। আদর-টাদর মনে হয় তার কপাল থেকে উঠে গেছে। মা? ও আচ্ছা, মা হাসপাতালেই তো গেলেন, সাথে রুপু আর বাবাও গেল। বিন্দুকে ফোন দিলে হয় না? বিন্দুর কথা মনে পড়তেই খানিকটা লালচে আভা এসে ভর করলো তার শ্যামলা মুখে, সেটা কারো দেখতে পাবার কথা না। এখনও মুকুলের অবস্থা এমন না যে, মেয়েটাকে বাসায় ডেকে টেকে আনা যায়, সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া যায়।
– ছোট? সিএনজিতে উঠে যা..
– হুঁ? ও আচ্ছা।
সে দেখলো বড় ভাইজান সিএনজি ঠিক করে রেখেছিলেন। কিছু না জিজ্ঞেস করেই টুক করে সে ভেতরে উঠে বসলো।
‘সোজা চৌদ্দ নম্বরে বর্ণালী নার্সিং হোম চলে যাবি। দোতলায় অপারেশন থিয়েটার, ওখানে পাবি সবাইকে। আমি শফিক চাচাকে খবর দিয়েছি, উনি এতক্ষণে মনে হয় পৌঁছে গেছেন। তারপরেও বাড়তি ব্যবস্থা দেখতে হবে। সন্ধানীতে রুপুর কোন ফ্রেন্ড নাকি আছে, ওখানে যাচ্ছি আমি, তুই সোজা ক্লিনিকে চলে যা!’ দীর্ঘক্ষণ কথা বলায় একটু হাঁফ ধরে গেল কামরুলের। খানিক জিরিয়ে সে মুকুলের কাঁধে একটা হাত রাখে। ‘খুব অস্থির লাগছে রে ছোট, বড় চিন্তা হচ্ছে! দোয়া করিস একটু তোর ভাবির জন্য…’
মুকুল মাথা নাড়ে, সাথে ঠোঁটজোড়া। ‘আল্লাহ ভরসা ভাইজান। তুমি এত ভেঙ্গে পড়লে হবে? আমি তো যাচ্ছিই। অন্য ব্যবস্থাও হয়ে যাবে, ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু দেখো।’
– নারে ছোট, আমার বড় ভয় করে।
বড় ভাইকে অভয় দেবার চেষ্টায় মুকুল একটু হাসে। ভাইজান তুমি বরং মিষ্টির দোকানে খবর দিয়ে রাখো তো, অযথাই এমন দুঃশ্চিন্তা করছো।
কামরুলের হাঁফধরা ভাবটা কাটে না। তাকে ছাড়িয়ে সিএনজিটা আগে বাড়তে শুরু করে। মুকুলের হঠাৎ মনে পড়ে, আসমানিও ঠিক এভাবে হাঁফিয়ে উঠতো কথা বলতে বলতে। সেসব কত আগের কথা। অথচ আসমানির বলের মতোন গোল মুখটা অদ্ভুত জীবন্ত হয়ে তার চোখে ভাসতে থাকে। এলাকা ছাড়িয়ে মূল রাস্তায় পড়ে সিএনজি, ওটার ইঞ্জিনের একটানা ভ্রুম ভ্রুম শব্দটা হঠাৎ ব্যহত হয়। কারণ পেছন থেকে আঁৎকা এবং তীব্র ধাক্কা মারে একটা বেরসিক ট্রাক! খানিক আগেই যে চিকন গ্রিলের ফাঁকা দেয়াল চালক আর তার মাঝে বাধা হয়ে ছিলো, মুকুল টের পায় ওটা তার মুখের সাথে একদম লেপ্টে গেছে। এত রাতে কোত্থেকে আসলো ট্রাকটা কেউ বলতে পারবে না। তবে মুহূর্তপর সেটি গতি বাড়িয়ে চারপাশের ল্যাম্পপোস্টগুলোর দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়।
উল্টে রাস্তার এক পাশে পড়ে আছে সবুজ রঙ্গা সিএনজিটা। বেচারা চালকের অর্ধেকটা দেহ ফ্রন্টগ্লাস ভেঙ্গে বেরিয়ে কালো পিচের উপর থেঁতলে আছে। আর মুকুল কী করছে? তাকে কেন দেখা যাচ্ছে না? আচ্ছা, উল্টে পড়া গাড়িটি থেকে ওইতো তার পা দুটো বেরিয়ে এসেছে, শরীরের আর কোন অংশ দেখা যাচ্ছে না। অনুমান করে নিতে হবে, চারপাশ ভেসে গেছে যেই রক্তধারায়, ওতে তারও সমান অংশ আছে। যেমনটা আছে সিএনজি-চালকটিরও।
মুকুল ভাবছেটা কী এখন? জীবনে কার কোন্ কথাটা সে রাখতে পেরেছে? আহা, সে যদি ঈদের আগের সে রাতটায় কথামতো আসমানিকে বাসা থেকে বেরুতে সাহায্য করতে পারতো! অথচ রফিক আর আসমানিকে দেওয়া কথা মুকুল রাখতে পারেনি সেদিন। এমন কী কঠিন ছিল পাশের বাসার কলেজ পড়ুয়া মেয়েটিকে পার করিয়ে দেওয়া? ওকে ছোটবোনের মতোই তো দেখতো সে, তার বাসায় এসে পড়ে যেত ইংরেজী গ্রামার, কেউ সন্দেহ করতো না। ঈদের আগের সারা রাতটা হয়তো রফিক তিনমণির মোড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দিয়েছিল! তার অপেক্ষার অবসান ঘটাতে পারেনি মুকুল। ঈদের পরদিন যখন আসমানির বিয়ে হয়ে গেল, রফিকের আত্মহত্যার খবরটা সে পেয়েছিল ঠিক রাত্তির বেলায়।
নিজের রক্তের বিছানায় জেগে উঠতে গিয়ে তার মনে পড়ে বিন্দুর কথা। তাকে কি সে কোন কথা দেয়নি? এমন অদ্ভুত সুন্দর মেয়েটা! ভাবি কী করছে এখন? অনাগত সন্তানটি এত কেন যন্ত্রণা দিচ্ছে তার জননীকে? অবশ্য যন্ত্রনাই তো দেবে। জগতের বেশির ভাগ সন্তান তো যন্ত্রণা দিতেই জগতে আসে। ভাবিকে রক্ত দেবার কথা ছিল, এ কথাটাও সে রাখতে পারবে না আজ? অথচ তার চারপাশে কত রক্ত! অন্ধকারের কালো আর রক্তের লাল মিলিয়ে জব্বর একটা রঙই তো দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু অন্ধকারের কালোতে লাল রঙটা তেমন ফুটে উঠছে না কেন? মুকুলের মগজে ঢোকে না কিছুই, সে টের পায় চারপাশে কেমন যেন অচেনা এক কোলাহল জেগে উঠেছে। কিসের এত হল্লা এসব? এই যে তার চারপাশে এতসব ছায়ামূর্তিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউবা দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চুপ, ওরা কারা? ভাবতে গিয়ে তার বড় অস্থির লাগে, বড় বেশি অস্থির লাগে।
_________________________________________
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৫:৪৫