আজকের দুপুরটা অনেক দীর্ঘ, শেষ হচ্ছে না। যেন এ দুপুরের শেষ হবার কথা ছিল না কখনো। আবু রায়হান হাঁটছে। নদী পার হয়ে শহরে যাওয়া দরকার। বাসা থেকে বেরিয়ে মাইল খানেক পথ সে হেঁটে এসেছে, ভ্যান মেলেনি এই ভরদুপুরে অথচ কাজটা জরুরি, বিকাল হবে রোদ পড়বে এতটা অপেক্ষা করার উপায় ছিল না। এ বছর মরুভূমির উষ্ণতা নেমেছে দক্ষিণাঞ্চলে। দিনের বেলা বাইরে বেরুলে গায়ের রক্তগুলো ঘামে বদলে যায়, এমন অবস্থা! খেয়াঘাটের কাছাকাছি এসে ধপাস করে সে পড়ে গেল। চৌদ্দফিট চওড়া রাস্তাটি সম্প্রতি পিচঢালা হয়েছে। সেই রাস্তার একেবারে মাঝখানে চিতিয়ে পড়ল আবু রায়হান!
চন্দনীমহল খেয়াঘাট কখনোই লোকারণ্য থাকে না। এইসব দীর্ঘ দুপুরে একজন পুরুষ মানুষ এভাবে যখন রাস্তায় উল্টে পড়ে যায়, দৃশ্যটি সহজেই আশপাশে থাকা সকলের নজর কাড়ে। তাকে ঘিরে ভিড় জমে গেল। ঘাটের ইজারাদারদের ঠিক করা দুজন চাকর, ছাউনির নিচে বসে থাকা কয়েকজন যাত্রী, ঘাটে ভেড়া শেষ ট্রলারটি থেকে নেমে আসা লোকজন সকলেই এগিয়ে যায়।
দীর্ঘাঙ্গ এক লোক মাটিতে চিৎ হয়ে পড়ে আছে (আমরা আবু রায়হানের কথাই বলছি)। পতনের সময় কোন একভাবে পিচঢালা রাস্তায় তার মাথাটা বাড়ি খেয়েছিল। কতটা জোরে বাড়ি খেয়েছে তা অনুমানের কী দরকার? তার মাথার নিচ দিয়ে মোটা রক্তধারা রাস্তা গড়িয়ে মাটিতে মিশেছে, সেই রক্তধারা জমা হচ্ছে একটি কচাগাছের গোড়ায়। গ্রামের সকলেই বিশ্বাস করে কচাগাছে কোনোদিন পানি দেবার দরকার হয় না, যতবেশি অবহেলা একটি কচাগাছ পাবে, সে ঠিক তত বিপুলাকায় হবে, এই হলো ব্যাপার। অথচ এমুহূর্তে দেখা যাচ্ছে কচাগাছটির গোড়ায় সরাসরি মানুষের রক্ত! এই কচাগাছের ভবিষ্যৎ কী?
চন্দনীমহল খেয়াঘাটে সব সময় বহাল খবিরুল্লা গিয়েছিল পায়খানায়। ফিরে এসে বদনাটি ছাউনির নিচে পাতা এক বেঞ্চের তলায় রাখতে গিয়ে সে দেখল ঘাটের অদূরেই বিশাল ভিড় লেগেছে। গলা চড়িয়ে সে অনির্দিষ্ট কাউকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল “ওরে, হলোটা কী? কী হইসে রাস্তার মধ্যি?” অবশ্য জবাবের অপেক্ষা না করেই তাকে ভিড়ের দিকে ছুটে যেতে দেখা যায়। ভিড় ঠেলে সে দেখে প্রায় ছ’ফুট লম্বা ইয়া এক মানুষ চিতিয়ে পড়ে আছে, চোখ দুটো বন্ধ, মাথার নিচ থেকে বয়ে গেছে একটা রক্তধারা। খবিরুল্লা আবার অনির্দিষ্ট কাউকে প্রশ্ন করে “বাইচে আছে নাকি? শাউয়ো লোকটা মরে গিসে না বাইচে আছে?” ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলল, “ডাক্তার ডেকে আনা দরকার। আহা বেচারা গরমে সহ্য করতে না পেরে এইতো আমাদের চোখের সামনেই পড়ে গেল!” স্থানীয় হাইস্কুল কমিটির সভাপতি নবি সাহেব তার সুন্দর করে ছাঁটা চাঁপদাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, “আর বলবেন না! এই গরমে বাঁচা যায়? ছেলেডা কী সুন্দর হেলেদুলে আসতেছিল খেয়া ঘাটের দিকে। হুট কইরে কেমন পড়ে গেল! কিন্তু কাইগে সুয়াল এ? চিন্তি পাত্তিসিনে। আহা রোদ্দুরে মরতি বসল নাকি? ওই কিডা আছো, এগোই আসো”... আবু রায়হান বেগতিক ভঙ্গিতেই রাস্তার ওপর চিতিয়ে হয়ে পড়ে থাকে। তার জরুরি কাজটি আমাদের না জানলেও ক্ষতি নেই তবে তাকে ঘিরে শোরগোলটা বাড়ে, এটা জানা দরকার।
একদল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়ে ঠিক ওই মুহূর্তে জটলাটিতে মিশে যায়। তারা এ গ্রামে এসেছে স্টার জুটমিলের তাঁত সেকশনের ওপর অ্যাসাইনমেন্ট করতে। নৌকা থেকে নেমেই ভিড়টি তারা দেখেছিল। ভিড় ঠেলে অবাক হয়ে আবিষ্কার করা গেল—ছাইরঙ্গা ফতুয়া আর কালো প্যান্ট পরা এক লম্বা লোক চিৎ হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। তার মাথার নিচটা ভেসে যাচ্ছে রক্তে। সেই রক্তধারা গিয়ে জমা হয়েছে একটি কচাগাছের নিচে। এই ভরদুপুরে পানির বদলে মানুষের টাটকা রক্ত পেয়ে কচাগাছটি খুশি কিনা জানার উপায় নেই।
ছাত্রদলের কো-অর্ডিনেটর শিক্ষকটি মধ্যবয়সী। তার মাথাভর্তি চুল। এই গরমেও গায়ে সার্টিনের নিল শার্ট। প্রখর রৌদ্রে সেটি সমানে উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে যাচ্ছে। লোকটা অসম্ভব বেঁটে এবং তার গলার স্বরটি খনখনে। সেই খনখনে স্বরে শিক্ষকটি বলল, “হিটস্ট্রোকের প্রাথমিক চিকিৎসা কী দিলরুবা?” স্বাস্থ্যবতী লম্বা চওড়া এক ছাত্রী এগিয়ে এসে বলল, “লোকটার মাথায় পানি ঢালব স্যার?” পঁচিশজন ছাত্রের দলটি পানির সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল। আশেপাশে নিশ্চয়ই কোথাও সুপেয় পানি পাওয়া যাবে, তৃষ্ণায় একেকজনের বুক ফেটে যাচ্ছে। সে মুহূর্তেই নদীতে বিশাল একটি জাহাজী ট্রলারের আগমন টের পাওয়া যায়, দু’তীরে বিপুল জলরাশিময় ঢেউ তুলে সেটি দৃষ্টিসীমা ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। এ ধরনের ট্রলার সচরাচর ভৈরবের এই শেষ মাথায় দেখা যায় না, ন’মাসে ছ’মাসে দু একটা চলে আসে আর এসেই সে ট্রলার নদীর পানিতে একটা হুলুস্থুল ফেলে দেয়। ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকা অল্প বয়সীরা সেই পানির হুলুস্থুলে পা ভেজায়, বয়স্করা নিরাপদ দূরত্বে সরে আসে। ওই পঁচিশজন ছাত্র-ছাত্রী তবু পানির সন্ধান করতে গ্রামের ভিতরের দিকে হাঁটতে শুরু করে। হিটস্ট্রোকের প্রধান চিকিৎসা পানি, রাস্তায় যে লোকটি চিৎ হয়ে পড়ে আছে পানি ছাড়া সে বাঁচবে কিভাবে?
হঠাৎ কে যেন আবু রায়হানকে চিনতে পারে। “আরে এতো জহুর ব্যাপারির ছেলে। স্টারগেট বাজারে না জহুর ব্যপারির দুটো শাড়ির দোকান আছে? আহা কী দবদবা দোকান রে ভাই। আর জহুর আলী লোকটা কত যে ভালো! এমন ভালো লোক সচরাচর কি দেখা যায়?” ভিড়ের মাঝে অনেকেই আবিষ্কার করে, জহুর ব্যাপারি শুধু তাদের চেনা না, বেশ রকমের চেনা। তার শাড়ির দোকান থেকে এ গ্রামের অধিকাংশ লোক শাড়ি কেনে তাদের নতুন কিংবা পুরানো বউয়ের জন্য, মায়ের জন্য, স্কুল পড়ুয়া ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী কন্যাদের জন্য, যেসব কন্যারা তাদের স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠানে শাড়ি পরবে এমন স্বপ্ন ক্লাস এইটে উঠেই দেখতে শুরু করে। কিন্তু জহুর আলীর এমন লম্বা চওড়া একটা ছেলে আছে, এমন ব্যাপার তারা কিভাবে না জেনে থাকতে পারে?
ধীরে ধীরে আবিষ্কার হয়, আবু রায়হান যে সে ছেলে নয়। রীতিমতো সে নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে এককালে। এ গ্রামে অমন মেধাবী কি দুটো ছিল কোনোদিন? ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে স্কুল কমিটির সভাপতি নবি সাহেব আফসোস করেন। এমন হিরের টুকরো ছেলেটিকে চিনতে তাদের এত দেরি হলো? আবু রায়হান তো তাদের সামনেই বড় হলো। তারপর স্কুল, কলেজ শেষ করে ঢাকায় চলে গেল পড়তে। এই কিছুদিন আগেই ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছিল ছেলেটার। শহুরে মেয়ের সাথে বিয়ে, সেই মেয়ে গ্রামে পড়ে থাকবে কোন দুঃখে? আবু রায়হান তাই শহরেই স্থায়ী নিবাস গড়েছিল নিজের শহুরে স্ত্রীকে নিয়ে। তাহলে এই পচা গরমে জহুর ব্যাপারির সুপুত্রটি কিভাবে এই নৌকাঘাটের রাস্তায় চিতিয়ে পড়ে আছে?
ওকি, ভিড়ের ফাঁকে একটা কুকুরের মুখও তো দেখা যাচ্ছে। মড়া মনে করে আবু রায়হানকে ওরা কামড়ে নেবে না তো? গরমে গ্রামের কুকুরগুলো পাগল প্রায় হয়েছে। এরা এসময় খাওয়ার অভাবেও থাকে। নবি সাহেবের মনে পড়ে গতকালের দৃশ্যটি। কী দ্রুতই না ঘটেছিল ব্যাপারটা। তার বউয়ের কেটে কুটে পরিষ্কার করে রাখা আস্ত মুরগীটি মুখে নিয়ে এক কুকুর দৌড় দিল! কুকুরেও এমন করে আজকাল! বলা যায় না রাস্তায় চিতিয়ে পড়া আবু রায়হানকে নিয়েও ওই ভ্রু কুঁচকে অপলক তাকিয়ে থাকা কুকুরটি সেরকম একটি পরিকল্পনা কষছে কিনা!
তীব্র গরমের ভরদুপুরটা যেন এক স্থির সময়বিন্দুতে দাঁড়িয়ে যায়, গাছের পাতা নড়ে না, ওপারে যাত্রী নেই বলে এপারে ট্রলার পৌঁছুতে দেরি হয়। শহরের দিকে যেসব লোক যাবে, তারা খেয়াঘাটের অদূরে মূর্তিবত দাঁড়িয়ে থাকে। বৈশাখের মাঝামাঝি অথচ ঝড়ঝাপ্টার নাম নিশানা কোথায় মিলছে? ঘাটের চিরকালীন বাসিন্দা খবিরুল্লা বেঞ্চের তলা থেকে বদনাটা উঠিয়ে নদীর দিকে নেমে যায়। ওতে পানি ভরে আবার তাকে গোপন ঘরে যেতে হবে। দু'দিন হলো পেট খারাপ করেছে। মজনু মিয়ার মেয়ের বিয়েতে চিতল মাছ খেয়েছিল সে দুই পিস। এত দামি মাছটা পেটে সইবে একথা কোথাও লেখা ছিল না, তার গরীবের পেট। বদনায় নদীর ঘোলা পানি ভরতে ভরতে সে দেখে ঘাটে ট্রলার ভিড়ছে, সাকুল্যে দশ বারোজন যাত্রী।
ট্রলার চলে আসায় আবু রায়হানকে ঘিরে জমে থাকা ভিড় পাতলা হতে শুরু করে কিন্তু এত এত মানুষ, কারো মনে মুহূর্তের জন্যেও এ চিন্তা আসে না, দীর্ঘকায় মানুষটিকে ধরে ছায়াতে নিয়ে যাওয়া উচিত, তার মাথায় পানি ঢাললে কেউ রাগ করবে না। হোক দুপুর, চন্দনীমহল বাজারে দুএকটা ডিসপেনসারি কি খোলা পাওয়া যাবে না এখন? সবাই ট্রলারে উঠবার কিংবা বাসায় ফেরার চিন্তায় ব্যাকুল হতে শুরু করে বলেই পাতলা হতে থাকে ভিড়। ঠিক তখনই ব্যাপারটা দৃশ্যমান হয়। সদ্য ভেড়া ট্রলার থেকে ঘাটে নামে দীর্ঘাঙ্গ লোকটি, গায়ে ছাইরঙ্গা ফতুয়া, পরনে কালো সূতি প্যান্ট। হ্যাঁ, সকলের বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও মেনে নিতে হয় এ লোকটিও আবু রায়হান। আশপাশে দাঁড়ানো মানুষেরা বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকে, তবে এতক্ষণ যাকে ঘিরে তারা দাঁড়িয়েছিল সে কে?
দিন দুপুরে ভৌতিক এক আতঙ্ক গ্রামবাসিকে ঘিরে ধরলে খবিরুল্লাই সর্বপ্রথম আবিষ্কার করে আসল ঘটনা। হিটস্ট্রোকে মৃত একটি কাককে ঘিরে তারা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল! গ্রামবাসিরা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখে আবু রায়হান ঘাটের ইজারাদারদের টেবিলে এক টাকার একটি কয়েন রাখে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে সকলের দৃষ্টি থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করে। খানিক আগের ঘটনাটি তাদের আয়না দেখিয়েছে। এই আয়নায়, নিজেদের বিচিত্র প্রতিবিম্ব দেখার ব্যবস্থা কে করে দিল তাদের?
___________________________________
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৫:২০