লোকটার নাম আমি প্রথম শুনি অতি শৈশবে। আয়ুব বাচ্চুর একটা গান খুব বাজত তখন, জীবনানন্দের কবিতার উপমায়.. বড়দের জিজ্ঞেস করতাম, জীবনানন্দ মানুষটা কে? উত্তর আসতো, কবি। খুব বিখ্যাত একজন কবি। সেসময় কবি বলতে আমার কাছে পরিচিত তিনজন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আর সুকুমার রায়। তখনকার দিনে জীবনানন্দ আমার কাছে তেমন পাত্তা পেলেন না। হবে কেউ একজন, উপমা টুপমা মনে হয় ভাল দিতেন। উপমা সম্পর্কে তখন আমার আইডিয়া এমন, পটল চেরা চোখ, বাঁশির মত নাক, কিংবা মেঘের মত চুল। স্কুলে সুকুমার রায়ের চলে হনহনের সাথে বাসায় মা কিংবা নানাবাড়িতে খালারা পড়ে শুনাতো "বাপরে কি ডানপিটে ছেলে, কোনদিন ফাঁসি যাবে নয় যাবে জেলে" নাহয় "হাসছি মোরা আহ্লাদী..
এরপর একলাফে ২০০৪ সালে চলে এলাম। ক্লাস এইটের বাংলা বই সাহিত্যকণিকায় "বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি" কবিতাটা পাঠ্য ছিল। যদিও শিক্ষকরা ওটাকে তেমন গুরুত্ব দিতেন না। পরীক্ষায়ও ওটা থেকে খুব একটা প্রশ্ন আসতোনা। বন্ধুরা মজা করতো, দাঁত ভাইঙ্গে যায় পড়তি গেলি। ও কিরাম কবিতে? সুতরাং দাঁত ভাঙা কবিতা সবাই মিলে এড়িয়ে যেত।
মজার ব্যাপার, আমি পড়তাম। বোঝা যাবেনা মানে কি? যেতেই হবে। বাংলা বই আমার কাছে ছিল একটা আনন্দখনী। কত বিচিত্র সব লেখায় পূর্ণ। দেখা যেত, প্রথম সাময়িক পরীক্ষার আগেই বইয়ের সব লেখা গদ্য, পদ্য পড়ে ফেলেছি আমি। সেই ধারায় জীবনানন্দের বাংলার মুখ আমিও পড়তাম। খুব একটা ভাল লাগা নিয়ে পড়তাম, এমন না। তবু মনে হত, যাই হোক লাইনগুলি বড় আলাদা। কেমন এক অদ্ভুত বিষন্নতায় মোড়া। সবটা না বুঝলেও আঁচ করা যায়.. অতঃপর ওটুকুই। আর পড়তে ইচ্ছে গেলনা কিংবা সুযোগ হলনা। তখন তুমুল গতীতে পড়ছি রবীন্দ্রনাথ। ক্লাস সেভেনে ভাল রেজাল্ট হেতু স্কুল থেকে কিছু বই দিয়েছে। তার মাঝে গীতাঞ্জলী একটা। সেই গীতাঞ্জলির গানগুলো মুখস্থ করে ফেললাম পড়তে পড়তে।
পড়ছি-
আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধুলার তলে
সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে..
সত্যি সত্যি পানি এসে যেত চোখে। আর কারও তো তখন দরকার ছিলনা।
জীবনানন্দর সাথে আমার সত্যিকার দেখা হল ২০০৮ সালে।
খুলনার একটা নিতান্ত অচীন গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছি পড়তে। ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছি। মিরপুর থেকে কলেজে গিয়ে ক্লাস করাটা আমার কাছে তখন সমুদ্রপাড়ি দেবার মত কষ্টকর কাজ। সেইসব সামলে কলেজে যাই। একাউন্টিং আর ইংরেজীর ক্লাসের পর ম্যানেজমেন্টের ক্লাস থাকে। আমি সে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে চলে যাই দোতলায়, কলেজ লাইব্রেরীতে। গল্পের বই পড়ি। খাতা বের করে পিছন দিকে কবিতা কিংবা গল্প লিখতে চেষ্টা করি। কারণ তখন লেখালেখির ভূত পুরোপুরি মাথায় চেপে বসেছে। লজিং নামের একটা গল্প লিখে ফেলেছি। শুধু সাহস করে উঠতে পারছিনা সেটা কোন পত্রিকায় পাঠাবো কিনা।
ঢাকার দিনরাত্রি যত দিন যেতে লাগলো, শুকিয়ে যেতে লাগলো আমার স্বপ্ন। রৌদ্রদগ্ধ ট্র্যাফিক জ্যাম আমার ভাল লাগেনা। গাদাগাদি করে বাসে চড়তেও ভাল লাগেনা। বাসার বাইরে বেরুলে কাউকে চিনিনা কিংবা আমাকে কেউ, এটাও ভাললাগেনা। পথঘাট আমার কাছে তখন মরুভূমি। উঁচু উঁচু দালানগুলো যেন সেই মরুভূমিতে গাঁথা পেরেক। ঠিক এইসব ভয়াবহ দিনরাত্রিগুলোতেই জীবনানন্দ আমার জীবনে আসলেন।
রাত জেগে তার কবিতা পড়ি। ছুটির দিনে পড়ি। মাঝে মাঝে ছাদে উঠে যাই বই হাতে। বইয়ের নাম "জীবনানন্দ দাশঃ প্রকাশিত, অপ্রকাশিত কবিতাসমগ্র"।
আমার সামনে খুলে গেল আলো অন্ধকারের আলাদা একটা দরোজা। আরে, সকল লোকের ভিড়ে বসে আলাদা হচ্ছে কে নিজের মুদ্রাদোষে? আমাকে কেউ বুঝছেনা, সব কিছুতেই আমি দোষি, নতুন পরিবেশ, মানুষেরা আমাকে নিচ্ছেনা আমার মত করে, ওই দ্বিধা অলা লোকটা তো আমিই। আমার মাঝে যে এক বিষন্ন আমি, জীবনানন্দ করলেন কি ওই আমিটাকে নিজের করে নিলেন। আমি পড়তে লাগলাম পরস্পর-
মনে পড়ে গেল এক রুপকথা ঢের আগেকার
কহিলাম শোনো তবে, শুনিতে লাগিল সবে শুনিল কুমার..
কিংবা
মনে পড়ে আমি ছিলাম ব্যাবিলনের রাজা
তুমি ছিলে আমার কৃতদাসী..
যে চেনা জগত বদলে গিয়েছিলো, মুহুর্তেই মনে হলো এই অর্থহীনতাই তো জীবন। কিংবা আরও এক বিপন্ন বোধ, যা আমাদের রক্তে খেলা করে কিংবা আমাদের ক্লান্ত করে! তার সন্ধানে দিন পার করাও কি জীবন না? ওই তো শুরু। জীবনানন্দ এরপর কখনই আর আমার হাত ছেড়ে যাননি।
ঠিক এই ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, তার ১১৬তম জন্মবার্ষিকিতে এসে আমরা আবিষ্কার করি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর এই বিষণ্ণ কবিই হয়ে উঠেছেন বাংলা ভাষার সর্বপ্রধান আর জনপ্রিয়তম। আমি চোখ বন্ধকরে চলে যাই তার জীবৎকালে। কবিতার পর কবিতা লিখছেন, সেসব নানান যায়গায় ছাপাও হচ্ছে। কিন্তু তাকে কেউ চিনছে না। জনপ্রিয়তা বহু দুরের বাত। অশ্লীলতার অভিযোগে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে, আর একটা বিশুদ্ধ চাকুরীর খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছেন তিনি। তার পাশে এসে কেবল দাঁড়িয়েছেন বুদ্ধদেব বসু..
নাহ, এইসব লিখতে ভাললাগে না। পৃথিবীর একজন শুদ্ধতম কবিকে কেন ট্রামের নিচে চাপা পড়তে হয়েছিলো? সন্ধ্যার আবছা আঁধারেও বুঝি তাকে ডাক দিয়েছিল কারও নগ্ন নির্জন হাত?
জীবনানন্দ দাশ আমার জীবনের সাথে এমনভাবে মিশে আছেন, তাঁকে নিয়ে লিখতে বসলে প্রতিবার আমার কলম হয়ে যাবে লাগামছাড়া। অতো লিখে কাজ কি? বরং ডুব দেওয়া যাক তার কবিতায়-
আবার আকাশের অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে :
আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার।
যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে
অথচ যার মুখ আমি কোনদিন দেখিনি,
সেই নারীর মতো
ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়েছে উঠছে।
---O---
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ভোর ৪:৫৭