রাশেদ ঘুমাচ্ছিল। ভর দুপুরবেলা এখন। জামিলা ছিল রান্নাঘরে। তরকারিটা আগেই হয়ে গিয়েছে। গ্যাসের তেজ কমে যাওয়ায় ভাত ফুটতে দেরি হচ্ছে। গ্যাস কমে যাবার সমস্যাটা বড়ো ভোগায়। দুপুরের রান্না শেষ হতে হতে সেজন্য সাড়ে তিনটা চারটা বেজে যায় রোজ! দুপুরের খাবার খেতে হয় বিকেলে। কোন মানে হয়? রাশেদের জন্য বড়ো খারাপ লাগে। ভাতের জন্য অপেক্ষা করতে করতে প্রতিদিন ঘুমিয়ে পড়ে মানুষটা।
ক্যাটারিং সার্ভিসে ফোন করলে ওরা এসে রোজ ঠিক সময়মতো রান্না করা খাবার দিয়ে যেতে পারে। কিন্তু বাইরের খাবার রাশেদের সহ্য হয়না। শরীর খারাপ করে। বাধ্য হয়েই তিনবেলা রান্নার কসরতটা করতে হয় জামিলাকে। বিকেল সাড়ে চারটা বাজতে না বাজতেই তার ছাত্র-ছাত্রিরা চলে আসে। নানান ক্লাসের বার-তেরো জন ছাত্র-ছাত্রি জামিলার কাছে পড়তে আসে। অংক আর ইংরেজী সে খুব ভাল পড়ায়। এলাকায় রিতিমতো সুনাম আছে তার! চাইলেই একটা কোচিং সেন্টার দিয়ে দিতে পারে জামিলা। কিন্তু ওতে কাজের প্রেশার বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে যাবে। বেশি হইচই কিংবা কাজ, কোনটাই আজকাল ভাল লাগেনা আর।
গ্যাসের চুলার আগুন নীলচে হয়ে জ্বলছে টিমটিম করে। হাঁড়ির ঢাকনা সরিয়ে দেখলো জামিলা। কিছুক্ষণের ভিতরেই বলক উঠবে। রাশেদ কে ডেকে তোলা যায়। ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে টেবিলে বসতে বসতে ভাত বেড়ে ফেলবে সে।
রাশেদ ঘুমের ভিতর স্বপ্ন দেখছিল।
সে বসে আছে একটা আসরের মাঝে। আসরের মধ্যমনি হয়ে বসে আছে বেঁটে মতো একজন বাউল। বাউল মাথা নেড়ে নেড়ে গান গাইছে। তার বাঁ হাত নেই। হাতের যায়গায় একগুচ্ছ চামড়া নুড়নুড় করে ঝুলছে শরীর নড়ার তালে। ডান হাতে ধরা একতারাটায় তীব্র শব্দ হচ্ছে। টং ডংডং টং.. টং ডংডং টং…
এত দরাজ গলা বাঁ হাতহীন লোকটার কন্ঠে! গানের কথা গুলো যেন ধাক্কা মারছে ভিতরে যেন..
আমি নালিশবন্দী হইলাম প্রভু তোর কাছে/হাকিম আর কে আছে?/ এই দেহের রাজা তুমি/সেই তালুকের প্রজা আমি/ চোর ধইরে দেও উচিত সাজা/ আইনমাফিক যা আছে/হাকিম আর কে আছে..
গান গাইতে গাইতে বাউল হঠাৎ থামলো। রাশেদের দিকে তাকিয়ে বলল- তুই কে? তুই? এখানে কেন এসেছিস?
রাশেদ টের পেল সে ঘামছে। আসলেইতো কে সে? কোথা থেকে এসেছে এই নালিশবন্দীর সভায়? কঠিন চোখে বেঁটে বাউল তার দিকে চেয়ে আছে। আগের মতোই গম্ভির স্বরে সে রাশেদ কে আদেশ করলো- ওঠ! উঠে দাঁড়া। তোর পরিচয় বয়ান কর এই সভায়।
রাশেদের কথা জড়িয়ে আসতে লাগলো। মুখ থেকে টু শব্দও বেরুচ্ছেনা কেন? মুহূর্তপর বেজে উঠলো বাউলের কন্ঠ। বল যেই হরি,সেই খোদা.. হরি মাওলা, হরি খোদা..
রাশেদ অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে শুরু করলো। চারপাশ থেকে অজস্র কন্ঠে বাজতে লাগলো মাওলা খোদা,হরি হরি.. হরি মাওলা,হরি খোদা..
জামিলা রাশেদকে দেখে ভড়কে গেল। এর আগেও সে দেখেছে এই অবস্থা। ঘুমের ঘোরেই মানুষটা কাঁপতে থাকে। ঘেমে ঝোল হয়ে যায়। মুখ দিয়ে বিজবিজ বিজবিজ শব্দ করে। ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয়েছে এই ব্যাপারটা নিয়ে। ঘুমের ওষুধ দিয়ে ডঃ বলেছেন- দুঃস্বপ্ন দেখছে বলে এমন হচ্ছে। ভালমতো ঘুম হলেই সমস্যাটা সেরে যাবে। কিন্তু ঘুমের ওষুধে কাজ হচ্ছে কই? যতদিন যাচ্ছে মানুষটা রোগা হয়ে যাচ্ছে। অথচ কি সুন্দর সাস্থ্য ছিল আগে!
জামিলা রাশেদের গায়ে হাত দিয়ে ঝাঁকি দিতে লাগলো। রাশেদ.. এই রাশেদ.. রাশেদ..
ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলো সে। জামিলা ব্যাকুল স্বরে জিজ্ঞেস করলো- স্বপ্ন দেখেছো? দুঃস্বপ্ন?
রাশেদ কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলোনা। তার খুব পানির তৃষ্ণা পেয়েছে। জামিলা সেটা বুঝতে পেরে পাশে রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে তার হাতে দিল। তুমি পানি খেয়ে বাথরুমে যাও। দুপুরে তো গোসল দিয়েছ। এখন হাতমুখটা ধুয়ে টেবিলে এসো। এর ভিতরে আমি ভাত বেড়ে ফেলি।
পানি খাওয়ার পর একটু শান্তি শান্তি লাগছে। রাশেদ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
বাথরুমে ঢুকে কি মনে করে শাওয়ার ছেড়ে দিল সে। শাওয়ারের পানি ঝিরঝির করে তার কৃষ্ণবরণ শরীর বেয়ে মেঝেতে পড়ছে। কানে এখনো সেই দরাজকন্ঠের গানটা বাজছে.. নালিশবন্দি হইলাম প্রভু তোর কাছে/হাকিম আর কে আছে.. ছাড়া ছাড়া ভাবে লাইনগুলি কানে আসছে। কিন্তু একদম স্পষ্ট সব। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে রাশেদ কাঁপতে লাগলো মৃদু তালে!
২
বছর তিনেক আগের এক শীতকালের গল্প বলা এ মুহুর্তে খুব জরুরী।
রাশেদ আর জামিলার ঘর আলো করে এসেছে তাদের প্রথম সন্তান। একটুকরো আলো যেন! রাশেদ ঘোষনা দিল আগামি একমাস সে ব্যাংকে যাবেনা। অফিস থেকে ছুটি দিল তো ভাল। নইলে চাকরি চলে যায় যাবে। জামিলা সারাক্ষণ অস্থির। এই লোকটা এত পাগল কেন! আর কারো বউয়ের বাচ্চা-কাচ্চা হয়না নাকি? সবাই কি তারা অফিস বাদ দিয়ে বউয়ের বিছানায় বসে থাকে বাচ্চাকে নিয়ে?
রাশেদ প্রায় সারাদিন জামিলার সাথে সাথে আছে কিংবা রাত জেগে বাচ্চার দেখাশোনা করছে। জামিলার মা রোশানারা দিনরাত বলতে লাগলেন- তুই দুনিয়ায় এসেছিস বিশাল কপাল নিয়ে জামিলা। আমার এখানে থাকা শুধু শুধু। তোর আর বাবুর সব কাজ তো জামাই একলাই করে ফেলছে!
সুখের দিনগুলোর মেয়াদ খুব কম হয়। সবার জানা কথা। যে বিপুল আনন্দ নিয়ে তাদের পুত্র সন্তান পৃথিবীতে এসেছিল, সবাইকে তারচেয়ে বেশি বিষাদে ডুবিয়ে হুট করেই সে চলে গেল। মাত্র একুশ দিনের মাথায়। নাভীতে কি নাকি ইনফেকশান হয়েছিল। চিকিৎসকেরা প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারলোনা শিশুটিকে!
জামিলার বয়স তখন উনিশ। শোকটা সামলে উঠতে পারলোনা সে। শারিরীক আর মানসিক দুরকম অসুস্থতাই গ্রাস করল তাকে। হাসপাতালে কিছুদিন কাটানোর পর সে চলে গেল মানিকগঞ্জ। তার বাবার বাড়ি। রাশেদের দিনরাত্রি কি পরিমাণ অন্ধকারে ডুবেছিল, সেটা কারো জানার কথা নয়। সবাই জামিলাকে নিয়ে ব্যাস্ত। সে অফিসে যায় কি যায়না,ওটার খেয়াল রাখারও কেউ ছিলনা।
চিরদিন সে ছিল একলা মানুষ। সেসব দিনে রাশেদের একমাত্র অনুভব ছিল- ভিতরটা বড়ো শুন্য লাগা। আর দিন রাতে হুট হাট হুহু করে উঠতো বুকের গভীরে! জামিলার সামনে গিয়েও দাঁড়াতে ভয় লাগত তার। কি সান্তনা দেবে সে? তার কাছে কোন ভাষা ছিলনা বলার মতো।
একদিন রোজকার মতো অফিস গিয়ে আর বাসায় ফিরলোনা রাশেদ!
জামিলা সুস্থ্য হয়ে উঠেছে যখন,রাশেদ ততোদিনে নিরুদ্দেশ। এমনি নিরুদ্দেশ,বৃদ্ধ চাচা-চাচি তার কোন সন্ধান পেলেন না। আর জামিলা? তার দশা তখন আবার পাগলের মতো! সংসার বড় মায়ার এক শেকল। সে মায়ার তীব্রতা শেকল ছেঁড়ার আগ পর্যন্ত মানুষ টের পাবে,অমন ক্ষমতা তাকে দেননি স্রষ্টা!
নিয়তি এই দুজন মানব মানবির সাথে খুব চমকপ্রদ এক খেলাই যেন খেলে চলেছিল,প্রতিনিয়ত! ঠিক বছর খানিকপর সিমান্তবর্তী এক গ্রাম থেকে রাশেদকে উদ্ধার করে পুলিশ। এমন এক গ্রাম,যার পুরোটাই ছিল বাউলদের একটা আখড়া। রাশেদ কিভাবে ওখানে গেল, কিভাবেই বা মিশে গিয়েছিল ওদের সাথে,সেটুকু জগতের অনিত্য রহস্য হয়েই থাক!
ভেবে বসার কারণ নেই,বাংলাদেশ পুলিশ হারানো মানুষ খুঁজে বের করায় খুব করিৎকর্মা। জামিলার মেজো মামা ঢাকা জেলা পুলিশ প্রধান হওয়ায় সন্ধান প্রক্রিয়াটা অলৌকিকভাবে কার্যকর হয়েছিল।
৩
রাশেদের সমস্যাটার শুরু এর পর থেকেই।
রাত-দিন ঘুমের ঘোরে সে স্বপ্ন দেখে। জাগরণেও সে থাকে একটা ঘোরের মাঝে। দিনমান কেমন বিড়বিড় করে। জামিলার বড়ো মায়া লাগে। ব্যাংকের চাকরিটা চলে গেছে সেই কবে। সংসারটা বলতে গেলে একাই সামলায় জামিলা।
সে তার ছোট্ট জগৎটা কি চমৎকারভাবেই না সাজিয়ে নিয়েছে! আজ থেকে তিনবছর আগে তাদের জীবনে যে অন্ধকার নেমেছিল, রাশেদ সে অন্ধকার সামলাতে পারেনি সেদিন। কিন্তু রাশেদের এই দুর্দিনে জামিলা ভেঙ্গে পড়েনি। ভেঙ্গে পড়লে চলবে কেন? একদিন তার মানুষটা সুস্থ্য হয়ে যাবে,আবার তাদের ঘর আলো করে আসবে সন্তান। এই শুন্য ঘরটায় যে দীর্ঘশ্বাসের ধুলো জমেছে তাদের,সেসব পরিস্কার করতে তো হবে!
রাশেদ খুব মনোযোগ দিয়ে ভাত খাচ্ছে। আহামরি কিছু রান্না নয়। সজনে ডাটা দিয়ে ঘন করে রাঁধা মসুরের ডাল। আর পোড়া মরিচ দিয়ে লাল করে ফেলা আলুভর্তা। জামিলা মুগ্ধ হয়ে দেখছে। মানুষের ভাত খাবার দৃশ্যও এত সুন্দর হয়? রাশেদ হঠাৎ খাওয়া থামিয়ে চোখ দুটো বড় করে বলল- সেকি,তোমার চোখে পানি কেন?
জামিলা জবাব দিলনা সেকথার। মনে মনে শুধু বলে উঠলো-
এ জল আমার শ্রাবণে শ্রাবণে
তবো বিস্মৃতি স্রোতের প্লাবনে-
ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে তরণি,
ওহি তবো সম্মান..
-----------------
অতঃপর এনামুল রেজা
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ভোর ৪:৫৮