আমার একটা চোখ কানা হল কিভাবে, ঘটনাটা কি শুনবেন?
খুবই মজার ঘটনা। কিন্তু যাকেই বলি, আনন্দ পাওয়ার বদলে সে দুঃখ পায়। দুঃখিত হয়। বিষাদের তোপে তাদের চেহারা হয়ে যায় খানিকটা ওই রকম! মানে বুঝলেন না? ওই যে জবাই করার আগমুহুর্তে গরুর চেহারাটা যেমন দেখায় তেমন। অথচ ঘটনাটা মজার। সেটা সে কবে ঘটে গেছে। তারপরো তো দিব্যি আমার দিন চলে যাচ্ছে। আমাকে দেখে কি আপনার মনে হচ্ছেনা, আমি একজন সুখি মানুষ?
মিরপুর ১২ নম্বরের ত’ব্লকে আমার বসবাস। কিন্ত বিধাতার অমোঘ বিধান কে খন্ডাবে বলেন? নিজের বাসায় কখনো একটু শান্তি মতো থাকা হয়ে ওঠেনা! সেই স্বস্তার আমলে লাখটাকা দেনমোহর দিয়ে বিয়ে করা বউ আছে ঘরে। ভদ্রমহিলা তার দুচক্ষে আমায় দেখতে পারলে তো! অথচ আমি তাকে খুব মায়াভরা দৃষ্টি নিয়েই দেখবার চেষ্টা করি। দুচোখে তাকাতে পারিনা। এটা কি আমার অপরাধ? আমার একটা চোখ তো কানাই। এবং শুরুতেই বলেছি, সেই গল্পটা আপনাকে শুনানোর বড় ইচ্ছা রাখি আমি।
এই যে মহল্লার মাথায় কাউসারের চায়ের দোকানে বসে আছি এখন। অন্তত পাঁচবার বলেছি চা দিতে এক কাপ। চিনি কম দিয়ে। বেশি চিনি দিয়ে চা কি খাওয়া যায়? মানুষ চিনি বেশি দিয়ে খাবে শরবত। সেটাই তো নিয়ম। কাউসার ব্যাটার দিকে দেখেন? তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, এ তল্লাটে তার মত ব্যাস্ত চা’অলা আর দুটো নেই! আমার পরে এসেছে, এমন দুজন কাস্টমারকেও সে চা দিয়ে দিল। সিগারেট দিল। এমনকি জাতীয় বাজেটে সিগারেটের বাক্সপ্রতি কটাকা দাম বেড়েছে, তাই নিয়ে তর্কাতর্কিও করে ফেললো! অথচ শালার হাভাতে, আমার দিকে খেয়াল নাই। আবার কি বলল শুনেছেন?
-দাড়ান কাহা, আপনার সা’ডা আলাদা কইরা বানায়া দিতেসি..
গলা না চড়িয়ে উপায় আছে বলেন? -ওই বেটা, আলাদা কইরা মানে কি? বিশ মিনিট লাগায়া দিলি এক কাপ চা বানাতে!
কাউসার উদাস স্বরে বলল- বিশ মিনিট একখান সুমায় হইলো কানা’দা?
এ্যাঁ? মাথাটা চড়ে গেল মুহুর্তে। কানা দা? কাউসার কি আমাকে কানা দা বলল? একটু আগেই না কাহা কাহা বলে ডাকছিল?
-ওই হাইয়ার পো, তুই আমারে কি কয়া ডাকদিলি?
ভয় পেয়েছে দেখেছেন? কাউসার ব্যটা ভয় পেয়েছে। কেমন সিঁটিয়ে যাওয়া গলায় কথা বলছে দেখেন!
-কাহা রাইগা গেলেন হঠাৎ? এই যে আপনের সা রেডি হইয়া গেসে....
গলার কর্কশ ভাবটা কোত্থেকে আসলো কে জানে?
-তুই একটু আগে আমারে কি কইয়া ডাকদিলি কাউসার?
-আপনারে? আপনারে কাহা সাড়া আর কি কমু কন তো? ঠান্ডা হইয়া বইসা সা’ডা খান। হ্যারপর কন কেমন হইলো..
কাউসার অন্য কাস্টমারের দিকে মনোযোগ দিয়েছে আবার। আমারই মনে হয় শুনতে ভুলটুল হয়েছিল। সে আমাকে কাহা বলেই ডেকেছে। হঠাৎ এমন অদ্ভুত সম্বোধনটা ভুল কিভাবে শুনি বলেন দেখি? কানা দা!
কানা দা বলে কিন্তু একজন আমাকে ডাকতো। খুবই আদরের ছিল সে ডাকটা। রমা! আহা, কি চমৎকার সব দিনই না আমি কাটিয়েছি রমার সাথে। নরেণ দা’র নিঃসন্তান বউটার সময় কাটতো একটা সন্তানের আক্ষেপে আক্ষেপে! আমাদের শ্রীসদাস লেনের বাসাটার দু’ঘর পরেই থাকতো রমারা। একদিন ভর সন্ধ্যায় আমরা এলাকার সমস্ত লোক ওদের বাসায় হাজির হয়ে দৃশ্যটা দেখেছিলাম।
ঠিক কোন কারণ আমাদের তখন কি জানা ছিল? নরেণ দা’র বাসার দু-কামরার একটার সিলিংফ্যানের সাথে ঝুলছিল রমার লাশটা! আমরা হাহা করে উঠেছিলাম সবাই। রমার রুপের খ্যাতি সুগন্ধের মতো ভুরভুর করে বেড়াতো এলাকাজুড়ে। মৃত্যু এসে সেই খ্যাতিকে বদলে দিল আফসোসে। মহল্লার জলীল খাঁ থেকে ক্যান্টিনের শরিফ মিয়া কে না চাইতো রমাকে? আমরাও কি কম ভেবেছি তাকে সেসব দিনগুলোয়?
রমা কেন ঝুলে পড়েছিল? সন্তানহীনতার আক্ষেপে? নরেণ দা ততোদিনে নিয়মিত পাঁড় মাতাল। রাতগুলো তার কাটতে শুরু করেছিল বাজে পাড়ায়। রাস্তায় সে উলটে পড়ে থাকলে ভোর বেলা বমিসর্বস্ব দেহটার দিকে কেউ এগুতোনা। রমাকে কাছ থেকে একটু অনুভব করা যাবে, এই ভরসায় কতদিন ওই কাজ করেছি আমি! নরেন দা’কে তুলে ধরে ওর ঘরে নিয়ে তুলেছি। রমা ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে আসতো। কানা দা, কানা দা এই.. ওই মাতাল টার জন্য নিজের গা ময়লা কল্লে!
গলায় ফাঁস নেবার পরেই কিন্ত আমার সাথে রমার সম্পর্কটার শুরু হল। ভ্রু কুঁচকে উঠছে দেখি আপনার। উৎপাটাং কিছু কি আমি বলছি নাকি? সন্ধ্যাবেলা ছিল। তামাক সরিয়ে ফেলা সিগারেটের খোলসে সবে মাত্র গুড়ো করা গাঁজাটুকু ঢুকিয়েছি। গাঁজার নিওম জানেন তো? অর্ধেক পরিমাণ তামাকের সাথে অর্ধেক পরিমাণ গাঁজা। ভালমতো সেটা হাতের তালুতে নিয়ে ডলতে হয়। যাকগে, ওসব নিয়ম কানুন জেনে আপনার কাজ নেই। তো ধরেন, আগুন ধরিয়ে শুধু টানার অপেক্ষা। এমন সময় একটা করুণ মেয়েলি কন্ঠস্বর আমায় চমকে দিল। -কানা দা, ও কানা দা..
ভড়কে গিয়েছিলাম বুঝলেন। গাঁজা টেনে পারলাম না, তার আগেই নেশা চড়ে যাওয়া অতিপ্রাকৃত কিনা বলেন? ভড়কানো গলাতেই বললাম ক্কে, ডাকে কে?..
করুণ নারীকন্ঠটিকে এবার আমুদে শোনালো। সেকি ঠাকুর পো, আমারে চিনতে পাললে না? আমি রমা গো..
রমা বউদি?
হুঁ।
আমার শরীর ঠান্ডা হবার জন্যে এটুকুই যথেষ্ট ছিলো। কাঁপা হাতে আগুন জালিয়ে গাঁজা ভরা সিগারেটটা ধরালাম আমি। টান লাগালাম কষে একটা। প্রথম টান এতটা কষে দেওয়া তো ঠিক না। কাশির প্রচন্ড দমকে খানিক আগে শুনতে পাওয়া রমার কন্ঠ ভুলে যেতে না যেতেই ধোঁয়ার ওপাশে দেখতে পেলাম ছায়ামূর্তিটাকে। এবার আপনি নির্ঘাত ঠাওরাচ্ছেন গাঁজাখোরের গুলপট্টি শুরু হল তাইনা? নারে ভাই, গুলপট্টি মারার লোক আমি না। ওই ব্যাটা চা‘অলা কাউসারকেই জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।
ওটা রমাই দাড়িয়ে ছিল। আমি কাঁপা স্বরে বললাম- গতকালই যে ফাঁসি নিলে গলায় তুমি?
রমা বলল- নিলামই বা ফাঁসি। ওতেই কি মানুষ পর হয়ে যায় নাকি? সেই যে ওদিনের ওই দুপুরটার কথা ভুলে যাওনিতো ঠাকুরপো? ওদিনের পর আর তো এলেনা..তাই তোমার কাছে চলে এলাম!
এ্যাঁ? আমার কাছে এসেছ মানে কি? মরা মানুষ একটা জ্যান্ত মানুষের কাছে কিভাবে আসতে পারে?
রমা বলল- পারে। অন্তরের টান থাকলে পারে বুঝলেনা? সেসব দিনগুলোর কথা কি ভুলে যাওয়া যায় বলো? কি মায়া করেইনা নরেণটাকে তুমি ঘরে পৌছে দিতে..কিন্তু সেই যে সেই দুপুরটার পরে তুমি আসাই বন্ধ করে দিলে আমাদের বাসায়..কানা দা এত পাষান কেন তুমি?
হ্যাঁ, তা সে এক দুপুরই ছিল বটে। শহরের দুপুরগুলো কোনদিনই ঘুঘুডাকা ছিলনা, থাকেনা। তবু দুপুর হল দুপুরের মতই নিশ্চুপ আর মগ্ন একটা সময়। শুধু রমা বৌদি ঘরে একলা ছিল। কি এক অমোঘটানে নেশাগ্রস্থের মতোন ওদের ঘরে গিয়ে ঢুকেছিলাম আমি। বলেছিলাম -বৌদি পানি খাব।
আমাকে দেখে সেযে খুব অবাক হয়েছে, এমন কিন্তু মনে হলোনা জানেন? ওকি জানতো, এমন করেই আমি এক ভরদুপুরে তার দুয়ারে এসে দাঁড়াবো? তৃষ্ণা মেটাবার করুণ আর্তি জানাবো? রমা নিঃশ্বাস দুরত্বে ছিল। তার গায়ের ঘ্রাণের মাদকতা আমায় ডুবিয়ে দিচ্ছিল। কিংবা তার দেহের যে কম্পন আমি টের পাচ্ছিলাম, কিভাবে পাচ্ছিলাম? নাহ, রমার দিকে হাত বাড়ানোর সাহস সেদিন আমায় কেউ দেয়নি। তার দেয়া গ্লাসভর্তি পানিটা এক চুমুকে শেষ করে শুধু বলতে পেরেছিলাম -বৌদি আসি কেমন? খুব গলা কেঁপেছিল আমার ওটুকু বলতে গিয়ে!
রমা প্রতিরাতে আসতে লাগলো জানেন? ঠিক রাত দশটার দিকে। মহল্লায় তখনো চায়ের দোকানে হিন্দি গান বাজতো। দুরের মসজিদে বা রাস্তা জড়ো করে কোথাও ওয়াজ মাহফিল হত। এর মাঝেই আমাদের বাড়ির দোতলার ছাদে রমার সাথে এগিয়ে যাচ্ছিল আমার সম্পর্ক.. আহা রমা, আমার রমা বৌদি! আমি কিন্তু আর ভয়টয় পেতাম না। অন্তরের টানে এক অবলা রমণী তার কানা’দার কাছে আসবে রোজ রাতে। আর তার কানা’দার ভয় পেলে চলবে নাকি?
বাপের ঠিকাদারির ব্যবসাটা তখন জমজমাট। আমার তাই পেটের চিন্তা সে যুগে করতে হতনা। আজো হয় নাকি? এর মাঝে কত কি যে ঘটে গেল! শ্রীস দাস লেনের বাসাটা বেচে দিয়ে বাবা মিরপুরে বাড়ি কিনলেন। আমরা সবাই বলতে মা-বাবা আর আমি। উঠলাম গিয়ে এই এখনকার ত’ব্লকের বাসায়। দুঃখের ব্যপার জানেন, নতুন বাসায় আসার পর রমা আর আসেনি কোনদিন। কানা’দা বলেও আর কেউ কখনো আমাকে ডাকেনি। অথচ খুব জানতে ইচ্ছে হয় আজো, আত্মহত্যা কেন সে করেছিল? ওতো কখনো আমাকে বলেনি!
বাপ মরলে ব্যবসা আমার হাতে আসলো। আসাই স্বাভাবিক। বাপের মতোই খারাপ লোক হওয়ায় ব্যবসায় টিকে গেলাম। পুরান ঢাকার এক চকচকে মেয়ে দেখে বিয়ে করলাম, মায়ের এক দুঃসম্পর্কের বোনঝিকে। মরা হাতির দাম লাখটাকা বলে একটা কথা আছেনা? একচোখ কানা পুরুষেরো দাম মেলা। যদি তার হাতে অনেক টাকা থাকে। মায়ের ওই বোনঝি তখন ষোড়সী মাত্র। আর ওই যে বললাম- রিতিমতো চকচকে! বিয়ের দশ বছরের মাথায় দেখা গেল, তিনপুত্র আর দুই কন্যা আমাকে আব্বা আব্বা বলে ডাকছে হররোজ!
তবে জানেন, ছেলেমেয়েগুলো সবকটা তাদের মায়ের দলে চলে গেছে। একটু চোখ ফোটার পর থেকেই আমাকে তারা বিষ ভাবতে শিখে গিয়েছিল। চক্রান্ত বুঝলেন না? সব দোষ মায়ের ওই চকচকে বোনঝির। ছেলেমেয়েগুলো অকারণ খারাপ লোক আর উন্মাদ ভাবতো আমাকে, আজো ভাবে। তাদের সাথে খারাপেরটা কি করেছি আমি? দুহাতে আমার কামানো টাকা উড়িয়ে কি তাদের সোনার অঙ্গ ভরে ওঠেনি? কোন শখটা তাদের অপূর্ণ রেখেছি আমি? অবশ্য মায়ের ওই বোনঝি মানে বউটাকে মাঝেসাঝে বেধড়ক পিটাতাম। নইলে শান্তি লাগতোনা। ছেলেমেয়েগুলোকে বাপের কাছ ঘেঁষতে দিবিনা মারই তো খাবি মাগী! এইটা খারাপ কাজ হল?
এখন আবার খুব দেমাগ বেড়েছে বউয়ের! ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে না? আমি নিজের বাপের কেনা বাসায় থাকার যায়গা পাইনা, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হয়। বোঝেন অবস্থা!
আচ্ছা, আমার নামটা কি আপনাকে বলেছি?
লেখকের জবানীঃ
রমিজ আলীর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় মিরপুর বারোর সি ব্লকে। কাউসারের চায়ের টংএ। সে দীর্ঘক্ষণ ধরেই এক কাপ চায়ের জন্য ফরমায়েশ দিয়ে যাচ্ছিল! কিন্তু চাঅলা কাউসার ভ্রুক্ষেপও করছিলনা। রমিজ বারবার বলছিল, আমাকে দেখে কি পাগল ভাবছেন আপনি?
তার জীবনের অদ্ভুত গল্প সে সবাইকেই শুনিয়ে বেড়ায়। সেসব শোনার পর হতাশায় আমার চোয়াল ঝুলে পড়েছিল। হতাশ হবার মতোই গল্প!
৮০ সালের ডিসেম্বরের রাত ছিল। বাসায় ফেরার পথে কিছু দুর্বৃত্তের হাতে পড়ে রমিজ। ওরা তাকে একরকম ধরেই নিয়ে যায়। যায়গাটা ছিল একটা বিহারি ক্যাম্প। এবং সেখানে এক বেঁটেমতো লোক ধারালো এক চাকু দিয়ে তার বাম চোখটা উপড়ে নেয়। ব্যবসায়িক শত্রুতার কারণে ওসব ভাড়াটে খুনেগুলোকে লেলিয়ে দিয়েছিল রমিজের বাপের প্রতিপক্ষ। সে ঘটনার পর নাকি টানা ১৭ দিন হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল তাকে!
আজন্ম মমতার কাঙ্গাল রমিজ চিরদিন ছিল মমতার সন্ধ্যানে। কিন্তু এই মহাপৃথিবী কারো কারো কাছে আজীবন বড় বেশি কঠিন। রমিজ আলীর সাথে আর কখনো আমার দেখা হয়নি। এই বৃদ্ধের শেষ দিনগুলিতে চির মঙ্গলময় তারপ্রতি একটু করুণা বর্ষণ করুন, এটুকুই আমার প্রার্থনা!
---------------------------
অতঃপর এনামুল রেজা
দৈনিক ইনকিলাবের সাহিত্য সাময়িকি
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:১২