১
লোকটি সাংবাদিক। কাজের ব্যাস্ততায় পরিবারকে ঠিক মতো সময় দিতে পারেননা কখনও। আজ সেই ঘাটতি পুষিয়ে দিতেই মেক্সিকো সিটি থেকে আকা-পুলকা যাচ্ছেন বেড়াতে। সাথে বউ আর বাচ্চাকাচ্চা। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। চারপাশের অজস্র কোলাহল পিছনে ফেলে সাংবাদিক আর তার পরিবারও চলছেন সে গাড়িতে। হঠাৎ একটা ব্যাপার লোকটির মাথায় খেলে গেলো।
বলে রাখা ভালো, সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি লেখালেখিও করেন। দীর্ঘদিন ধরেই একটি উপন্যাস তার মাথার ভিতর ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সেটি লিখতে পারছিলেন না। কারণ উপন্যাসটি লেখার জন্য একটি মনঃপুত বর্ণনাভঙ্গি দরকার। সেটাই তিনি ঠিক করতে পারছিলেন না।
তো আমরা আবার গাড়ির ভিতরে চলে যাই। চলতে চলতে লেখকের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেলো। উপন্যাস এবার তার মাথা থেকে কাগজের পৃষ্ঠায় নেমে যাবে। কারণ তিনি যা খুঁজছিলেন তা মিলে গিয়েছে। গল্পটা তিনি বলে যাবেন তার নানীমা’র মতো করে। তার নানীমা লেখক ছিলেন না। কিন্তু বিস্ময়কর এক গল্পবলিয়ে ছিলেন।
ছোটোখাটো একটা নমুনা না দিলে ব্যাপারটা ঠিক পরিষ্কার হবেনা। এই বৃদ্ধার কাছে আজন্ম মৃত আর জীবিত মানুষে তেমন কোন ভেদাভেদ ছিলনা। তার ধারণা ছিল মানুষ মারা যাবার পরেও তাদের জীবিত পরিজনের আশেপাশেই ঘুরে বেড়ায়। যত বয়স বেড়েছে, তার কাছে এই ব্যাপার আরও প্রকট সত্য হয়ে ধরা দিয়েছে। এমনকি জীবনের শেষের দিকে এসে মহিলাকে মৃত মানুষজনের সাথে কথা বলতেও শোনা যেত হরহামেশা। গল্প বলায় তার জুড়ি মেলা ভার ছিল। অদ্ভুত আর অলৌকিক সব গল্প তিনি এমন ভাবে করতেন, যেন সেসব খুব সাধারণ আর বাস্তব ঘটনা। এবং বস্তুত ওসব গল্পগুলো তার কাছে সত্যই ছিলো। আর ছোটো বেলায় নানীমার মুখ থেকেই ওসব বিচিত্র গল্প শুনে অভ্যস্থ সাংবাদিক কাম লেখক ঠিক করে ফেললেন, তার উপন্যাসটিও তিনি ওভাবে বলে যাবেন।
আকা-পুলকায় বেড়াতে যাওয়া লাটে উঠলো। গাড়ি ঘুরিয়ে বাসার দিকে রওনা করলেন তিনি। স্ত্রী কিংবা বাচ্চারা মন খারাপ করলো কিনা, এ নিয়ে তার বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা নেই। কারণ তখন মাথায় পুরোপুরি ভর করেছে বুয়েন্দিয়া পরিবার আর যাদুর শহর মাকোন্দোর অলৌকিক গাথা। বাসায় ফিরেই তিনি লিখতে শুরু করলেন। কিন্তু লেখায় বুঁদ হয়ে থাকলে সংসার চলবে কিভাবে? কদিন আগে কেনা যে গাড়িটায় চড়ে স্ব-পরিবারে বেড়াতে যাচ্ছিলেন, সেটা বন্ধক রেখে স্ত্রীর হাতে সব টাকা গুঁজে দিলেন! শুরু হতে লাগলো বিশ্বসাহিত্যে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাসটির। উপন্যাসের নাম “নিঃসঙ্গতার একশো বছর।“
গ্যাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। আর কোন লাতিন আমেরিকান ঔপন্যাসিকের সাথে আমাদের তেমন পরিচয় নেই, যতটা তিনি আমাদের আপন হয়ে উঠেছেন গত ৪০ বছরে। তার প্রায় সবকটি বইয়ের অনুবাদ হয়েছে আমাদের ভাষায়। এবং মজার ব্যাপার অন্য কোনো বিদেশি লেখকের তুলনায় তিনি আমাদের মাঝে সবচেয়ে আলোচিত ছিলেন। ছিলেন লিখতে হচ্ছে খুব সামান্য একটি কারণে। কারণটি অনুধাবনযোগ্য। তার শারিরিক অবস্থানের শেষ হয়েছে এ পৃথিবিতে। তবু তিনি ছিলেন এমনি বা কিভাবে লিখি? এইযে ভর দুপুরে বসে তাকে ভেবে ভেবে আমার কলম চলছে, এটুকুতেই তো বোঝা যায় কি বিপুল বিক্রমেই না তিনি বহাল আছেন!
২
শুরুতেই তো বলেছি তিনি সাংবাদিক ছিলেন। এ ব্যাপারটি তার লেখালেখিতে কতোটা প্রভাব ফেলেছে, তার একটি কথা থেকে আমরা সহজে বুঝে নিতে পারি। “কি করে গল্পের সত্য সৃষ্টি করতে হয়, সাংবাদিকতা আমাকে সেটাই শিখিয়েছে।“
তবে সাংবাদিকতা আর সাহিত্যের মাঝে সীমারেখাটা নেহাত কম সাস্থ্যবান নয়। একজন সাংবাদিক ঘটনার ডালপালা ছেঁটে সারাংশটা আমাদের সামনে তুলে ধরেন। ওতে ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিফ হওয়া যায় বটে, কিন্তু সেই সারাংশ ঠিক আমাদের মনের তৃষ্ণা মেটায়না। তৃষ্ণার কথাটা একারণেই আসছে যে, মানুষ বিচিত্র জীব। প্রতিটি ঘটনার মাঝেই সে নিজেকে খুঁজে বেড়াবার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। মার্কেজের মতে, তার সমস্ত লেখার মূল ভিত্তি ছিল বাস্তবতা, অর্থাৎ সত্য ঘটনা। সাহিত্যিক হিসেবে তিনি সেসব ঘটনার শেকড়ে আমাদের নিয়ে গিয়েছেন প্রতিবার। অর্থাৎ সাংবাদিকতা যখন নিরেট একটা চিত্র, সাহিত্য সেক্ষেত্রে হয়ে যায় চলচ্চিত্র।
বন্ধু প্লিনিও এপুলেইয়ো মেন্দোজার সাথে এক সাক্ষাতকারে মার্কেজ বলেছিলেন- আমি লিখতে শুরু করি একদম হঠাৎ করেই। সম্ভবত একজন বন্ধুকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে আমার যুগও একজন লেখক সৃষ্টিতে সক্ষম।
তবে তার লেখালেখির মূল প্রভাবক ছিলেন তার নানীমা ড্রোনা ট্রাংকুইলিনা। শৈশবে এই বৃদ্ধাই মার্কেজের মনোজগতে রোপন করে দিয়েছিলেন এক আশ্চর্য্য মায়াবি জগতের বীজ। অথচ এ জগতকে তিনি কখনই ভ্রান্তি বা কল্পনার বলে মনে করেননি। সম্ভবত আজ আমরা তার লেখার যে পদ্ধতিকে যাদু বাস্তবতা বলে স্বস্তি পাই, মার্কেজ সেটিকে চিরদিন বলে এসেছেন ক্যারিবিয়ান জীবন বাস্তবতা। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের মানুষেরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে, তাদের চিন্তা ধারায় যাদু আর অলৌকিকতাকে এমনভাবে ধারণ করে আছেন, যে সেটি তাদের জন্য খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গিয়েছে। সুতরাং তার লেখাকে পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে হলে এই ক্যারিবিয়ান জীবন বাস্তবতার স্বরুপ সম্পর্কেও আমাদের ধারণা রাখা জরুরি। সেটি বুঝতে আমাদের অন্য কোথাও যাবার দরকার নেই। “পেয়ারার সুবাস” গ্রন্থে বলা তার কিছু কথা আমি সরাসরি তুলে দিচ্ছি-
নিঃসঙ্গতার একশো বছর উপন্যাসের মরিসিনো ব্যাবিলনিয়ার কথা ধরুন। আমার বয়স তখন পাঁচ। একদিন এক ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি এলেন আরাকাতাকায়, আমাদের বাড়ির মিটার পাল্টাতে.. মনে পড়ে, একবার নানীমা ঝাঁটা দিয়ে একটা প্রজাপতি তাড়াতে তাড়াতে বলেছিলেন, “এই লোক যখনই বাড়িতে আসে, একটা হলুদ প্রজাপতিও পিছে পিছে এসে ঢোকে। এই ঘটনার উপর ভিত্তি করেই মিরিসিনোর আশপাশে আমি অজস্র প্রজাপতি জুড়ে দেই। সে যখনই কোথাও যায়, তার আশেপাশে উড়তে থাকে অজস্র হলুদ প্রজাপতি!..
আরেক যায়গায় তিনি এমন এক ঘটনার উল্লেখ করেছেন, যা সত্যি বিস্ময়কর।
“আমেরিকান অভিযাত্রি এফ, ডব্লিউ আপ দ্যা গ্রাফ এর জবানী থেকে জানা যায়, গত শতাব্দীর শেষভাবে আমাজন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে তিনি এক অবিশ্বাস্য যাত্রা শুরু করেন। অনেক কিছুর মাঝে তিনি এমন একটা যায়গা দেখতে পান, যেখানে মানুষের কন্ঠস্বর মুষল্ধারে বৃষ্টি নিয়ে আসে।“
৩
মার্কেজের অধিকাংশ সাহিত্যকর্মে আমরা দেখতে কাল্পনিক শহর মাকোন্দোকে। এই মাকোন্দোর সৃষ্টিতে তার উপর ভর করেছিলো শৈশব। যে শৈশবের দীর্ঘাংশ কেটেছিলো আরাকাতাকায়। তার নানাবাড়িতে।
বাস্তবিক এক অলৌকিক শহরের মতোই ছিল আরাকাতাকা। মাইলের পর মাইল জুড়ে কলাক্ষেত। সেসবের পাশ দিয়ে রোজ সকাল এগারোটায় এক হলুদ রঙ্গা ট্রেন প্রবেশ করত শহরে। রেললাইনের পাশেই ধুলো ওড়া মেঠো রাস্তা। তার উপর দিয়ে বিচিত্র আওয়াজ তুলে ধুঁকে ধুঁকে চলত সবুজ কলার কাঁদিবোঝাই সব গরুর গাড়ি। ট্রেনটি শহরে প্রবেশের সাথে সাথেই চারিদিকে এক হল্লা পড়ে যেতো।
এই দৃশ্য কিন্তু আমরা তার নিঃসঙ্গতার একশো বছর উপন্যাসেই পাই। কলাকোম্পানীর প্রতি মাকোন্দোর যে বিদ্বেষ তা যেন আরাকাতাকাবাসির দীর্ঘশ্বাসের প্রতিচিত্র। কারণ ওরা, অর্থাৎ কোম্পানীর সায়েব সুবোরা ছিলো অন্য অঞ্চলের, নতুন লোক। মার্কেজের কর্ণেল নানা বিদ্রুপের সুরে ওদের বলতেন- আমেরিকান!
তার পুরো সাহিত্যকর্মের মূল থিমটিও আমাদের খুব চেনা। একাকিত্ব। চেনা হবারই কথা। আমাদের সকলের চেতনার খুব গভীর রুপটি তো নিঃসঙ্গতায় পূর্ণ। নিজের আপন আঁধারে আমরা সকলেই সঙ্গিহীন। বুয়েন্দিয়া পরিবারের নিঃসঙ্গতা সম্পর্কে মার্কেজ একটা মোক্ষম কথা বলেছিলেন। “আমার মনে হয়, তাদের একাকিত্বের মূল কারণ ভালবাসাহীনতায়!” আপনি দেখবেন, পুরো একশো বছরে একমাত্র টিকিদার অরেলিয়ানোই একমাত্র বুয়েন্দিয়া যার মধ্যে ভালবাসার সঞ্চার হয়েছে। অর্থাৎ বংশের সর্বশেষ এবং পিঁপড়ের পেটে চলে যাওয়া শিশুটি! মা-বাবার বিপুল ভালবাসার ফলেই যার জন্ম হয়! এছাড়া বুয়েন্দিয়ারা ভালবাসতে অক্ষম। এবং এটাই তাদের একাকিত্ব এবং হতাশার মূল কারণ। “
এ মুহুর্তে আমরা মনে করতে পারি দস্তভয়েস্কির ব্রাদার্স কারামাজোভের একটি দৃশ্য। ফাদার যোশিমাকে যখন প্রশ্ন করা হল, “নরক বলতে আপনি কি বোঝেন?” যোশিমা উত্তর দিলেন- ভালবাসতে না পারার যে অক্ষমতা এবং যন্ত্রনা আমরা অনুভব করি, সেটিই নরক। বিশ্বসাহিত্যের মূল সুরটি সবসময়েই এক। মানবাত্মার স্বরুপ উন্মোচন। নিজেকে খুজে পাওয়ার পথ আবিষ্কার। এই মহান যাত্রায় মার্কেজ আমাদের সামনে আমাদের চেনা পৃথিবীকেই এঁকেছেন, নতুনভাবে। এই নতুনত্বেই সৃষ্টি হয়েছে তার যাদুর শহর মাকোন্দো।
কিংবা আমরা বারবার ফিরে যাবো গৃহযুদ্ধের অবসানের পর বেকার হয়ে যাওয়া তার সেই নিসঙ্গ কর্ণেলের কাছে। যে বৃদ্ধ কর্ণেল লঞ্চঘাটে বসে থাকে একটি সরকারি চিঠির অপেক্ষায়। পরবর্তিকালে মার্কেজ এ উপন্যাসের পটভূমি বর্ণনা করেছেন। তখন তিনি প্যারিসে বসবাস করছেন পেশাগত কারণে। এবং অর্থাভাবে অপেক্ষা করছেন- একটি মানি অর্ডারের জন্য। নিজের এ দুরাবস্থাই তার মনে বুনে দেয় এ ভুবন বিখ্যাত গল্পের বীজ। প্যারিসে বসে তিনি লিখে ফেলেন “কর্ণেল কে কেউ চিঠি লেখেনা”।
মোটকথা, আপন জগতের নির্যাস থেকেই তার সাহিত্যকর্মগুলি সৃষ্টি হয়েছে। কল্পনার মিশেল সম্পর্কেও বারবার তিনি বলছেন, এ কল্পনার ভিত্তিও সেই বাস্তবতা। অথচ নিঃসঙ্গতার একশো বছর উপন্যাসে আমরা দেখি সুন্দরী রেমেদিওস দিন দুপুরে কিভাবে সবার চোখের সামনে থেকে শুন্যে উঠে গেলো। যাকে মার্কেজ বলেছেন, সুন্দরী রেমেদিওসের স্বর্গারোহণ!
অথচ এ ব্যাপারটিও নাকি বাস্তব। কিভাবে? উত্তর দিতে মার্কেজ আবার ফিরে গিয়েছেন তার শৈশবে। একদিন সকালে এক মহিলার সুন্দরী এবং যুবতি নাতনী বাসা থেকে পালায়। সে ঘটোনাটিকে চাপা দেবার উদ্দেশ্যে মহিলা বলে বেড়াতে থাকেন, তার নাতনী সর্গারোহণ করেছেন।
লেখক হিসেবে মার্কেজ খ্যাতি পেতে শুরু করেন “নিঃসঙ্গতার একশো বছর” প্রকাশিত হবার পরপরই। খ্যাতির সাথে অর্থেরও বিপুল সমাগম ঘটে। মজার ব্যপার উপন্যাসটি যখন তিনি লিখছেন, তার পরিবার কিন্তু তখন দিনকে দিন ডুবে যাচ্ছে প্রবল অর্থকষ্টে। ব্যক্তিগত গাড়িটি বন্ধক দিয়ে যে টাকা পাওয়া গিয়েছিলো, তা দিয়ে ছমাসের উপরে চলল। তারপর? সংসারের সমস্ত ব্যাপার চুপচাপ সামাল দিয়ে গিয়েছেন স্ত্রী মার্সেদেস। উপন্যাস যতদিনে শেষ হয়েছে, তখন নমাসের বাড়িভাড়া বাকি। মুদি দোকানে বাকির পাহাড়, মাংসের দোকানেও। কোথায় যেন একটা বিশ্বাস ছিলো তার জীবন সঙ্গিনীর। স্বামীর বইটি প্রকাশিত হলেই যাবতীয় অর্থসমস্যা কেটে যাবে। এমনকি বইটার পান্ডুলিপী প্রস্তুত হবার পর সেটি এদিটোরিয়াল সাউথআমেরিকানা প্রকাশকের কাছে ডাকযোগে পাঠিয়ে দেন মার্সেদেস নিজেই।
এক বিচিত্র জীবন পাড়ি দেওয়া গ্যাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকে আমরা পাই তার উপন্যাস কিংবা গল্পগুলোয়। প্রতিনিয়তই যার লেখক স্বত্তাকে আঘাত করেছে সমাজ, পারিপার্শ্বিকতা। আর হ্যাঁ, রাজনীতি। তার সমকালিন লাতিন আমেরিকায় এমন লেখক খুজে পাওয়া দুঃষ্কর ছিলো, যিনি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নন। তুলনামূলকভাবে মার্কেজ একটু বেশিই সম্পৃক্ত ছিলেন। মার্কসীয় মতবাদপন্থি হলেও গভীরভাবে তিনি প্রতিটি লাতিন আমেরিকান একনায়কের শাষন আর ব্যাক্তিত্ব পর্যবেক্ষণ করেছেন। খেয়াল করেছেন তাদের দুঃশ্বাসন কিংবা তাদের খামখেয়ালিপনা। সেই অভিজ্ঞতার ফলস্বরুপ তিনি লেখেন এক খামখেয়ালি একনায়কের একাকিত্বের গল্প- গোত্রপিতার হেমন্ত।
৪
কাফকার “মেটামরফোসিস” পড়ে একদিন মার্কেজ ভেবেছিলেন, তিনি কি অমন একটি গল্প লিখতে পারেন না? যদি পারেন, অবশ্যই তিনি লেখক হতে পারবেন। সেটি তার কলেজ জীবনের কথা। অর্থাৎ, লেখালেখির বীজ বহুদিন ধরেই তার মনোভূমিতে লালিত হতো, হয়েছে।
পরবর্তিকালে মার্কেজ বলেছেন- জার্মান ভাষায় কাফকা যেভাবে তার গল্পগুলো লিখেছেন, তার নানীমার গল্প বলার ধরনও তেমনি ছিলো। অতি অলৌকিক সব ঘটনার বাস্তবযোগ্য বয়ান। এবং তিনি অবশেষে এই ভঙ্গিটিকেই বিংশশতাব্দীর সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যভঙ্গি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন।
এবং ১৯৮২ সালে সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার আগেই তাকে বিখ্যাত হিসেবে আমরা দেখতে পাই। বস্তুত সাহিত্যে মার্কেজের যাত্রাটিও তার লেখার মতোই অলৌকিক এক যাত্রা। তবে শুধু সাহিত্যিক হিসেবে নয়, একজন সাংবাদিক হিসেবেও মার্কেজ কিন্তু আমাদের অনেক নতুনত্ব উপহার দিয়েছেন।
তার “অপহরণ সংবাদ” কিংবা “এক বিপন্ন জাহাজের নাবিকের গল্প” প্রতিবেদমূলক সাংবাদিকতায় এক নতুন মাত্রাই যোগ করেছিল। আজও এ বইদুটি তার অভিনব বিষয়বস্তুর কারণেই বিশ্বের প্রায় সবকটি প্রধান ভাষায় অনুদিত এবং বহুল পঠিত। আজ এতোদিনপর আমাদের প্রজন্ম তাকে একজন মহান সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবেই বেশি চিনছে। কিন্তু একথাও অস্বিকার করবার উপায় নেই, সাংবাদিক হিসেবেও তিনি কিংবদন্তির মতোই ছিলেন!
৫
শুরুর কথাগুলিতে ফিরে যাচ্ছি। আপাতঃ দৃষ্টিতে তা অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও মূল লেখার সাথে কিছুটা যোগসুত্র তো অবশ্যই আছে। আমাদের দেশে মার্কেজ চর্চা গত তিন দশক ধরেই চলছে। তুমুল গতীতে বলবোনা। কারণ এ দেশের সাধারণ পাঠক কিন্তু যাদুবাস্তবতাকে গ্রহণ করার সক্ষমতা আজও অর্জন করেনি। সেটির কতোটা প্রয়োজনিয়তা আছে কিংবা আদৌ এদেশের সাহিত্যে যাদুবাস্তবতার প্রবেশ ও প্রভাব উপকারি কিনা, এ নিয়ে বলার আমি কেউ নই। তবু বারবার মনে হয়, বিশ্বসাহিত্যের অগ্রযাত্রায় সামিল হতে হলে তার মূল সুরটি আমাদের ছুঁতে পারার ক্ষমতা লাভ করা দরকারি।
আজকে আমাদের মাঝে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যতোটা আলোচিত, কিংবা জীবদ্দশায় যতোটা আলোচিত ছিলো তার কর্ম, সাধারণ পাঠক কিন্তু বরাবর তার থেকে দুরেই থেকে গিয়েছে। একই অবস্থা বাংলা সাহিত্যে যাদুবাস্তবতার আরেক সারথী শহিদুল জহির সম্পর্কেও প্রযোয্য। বারবার বলা হয়, দুর্বোধ্যতার কারণে সাধারণ পাঠক তাদের সাহিত্যকর্ম থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করে। এই ব্যপারটিই আমাদের ভূলে যাওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, সাহিত্যে নিরীক্ষা জরুরি।
পাঠক কখনই নির্ধারণ করবেনা লেখক কোন ধরণে লিখবেন। যুগে যুগে এমনই হয়ে এসেছে, লেখকই তার পাঠক তৈরী করেছে। শুনতে কটু শুনালেও এ কথা বলতে হচ্ছে বাধ্য হয়েই, আমাদের লেখকেরা নিরীক্ষা করতে ভয় পান। পাছে, তার লেখা কেউ না পড়েন! ভীতিটি অমূলক না। যা লেখা হলো, তা যদি কেউ নাই পড়লো, লিখে কি লাভ? গত কয়েক যুগ ধরে এই ধারণা আমাদের সাহিত্যে রাহুর মত ভর করে আছে। এ অভিযোগ একতরফা নয়। কিন্তু ব্যতিক্রম কখনই উদাহরণ হতে পারেনা। সুতরাং উওযুক্ত পাঠক তৈরী করার দ্বায়িত্বটি লেখকদেরকেই নিতে হবে।
শেষ
কথার সমস্যা হল এটি নদীর মতো। এক খাত থেকে হুট করেই অন্যখাতে প্রবাহিত হয়। তবে আজকের কথাবার্তার এখানেই ক্ষান্তি দেব। আজ মার্কেজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার যাদুর শহর মাকোন্দের পথেঘাটে আমরা যখন হারিয়ে যাবো, সে গোলকধাঁধায় চিরদিন তিনি আমাদের সঙ্গি হবেন। তারঁ মত লেখকের জন্য মৃত্যু খুব বড় বিষয় নয়, কিংবা অন্যভাবে বলা যায় মৃত্যুর মাঝ দিয়েই হয়তো তার সাহিত্যকর্ম আরও দীর্ঘযাত্রার শুরু করলো। জীবিত কিংবদন্তি ছিলেন তিনি, পাঠকের ভালবাসায় দিনকে দিন সে কিংবদন্তি আরও বিপুল হয়ে দাঁড়াবে হয়তোবা!
মার্কেজের সমগ্র জীবনটিও আমাদের জন্য চমকপ্রদ বস্তু। বিশ্বের নানা প্রান্তের পাঠক তো বটেও লেখকেরাও তার জীবন থেকে বিচিত্র সব উপাদান আহরণ করতে থাকেন প্রতি মুহুর্তেই। তার সাহিত্যের মূল ব্যাপার এটিই, আমাদের বহমান জীবন বাস্তবতাই সমগ্র বিশ্বসাহিত্যের মূল বৃক্ষ। সেটির শাখা প্রশাখা নির্মাণ করতে বারবার আমাদের ফিরে আসতে হবে জীবনের কাছেই!
---------------------------
ত্রৈমাসিক তীরন্দাজের ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যায় প্রকাশিত
অতঃপর এনামুল রেজা
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:১৫