এরা ও তাঁরা
যখন তখন চা খাওয়ার বদস্বভাব আমার আছে। হ্যাঁ, বদস্বভাব। দিন রাতের ঠিক থাকেনা, যখন ইচ্ছে যায় তখনই চা গিলে ফেলি আমি। আমার বাসায় থার্মোক্স ভর্তি করে চা থাকে সবসময়।
সাংবাদিক হাসিমুখে বলল- একজন চিত্রকরের জন্য খুব রিডিকুলাস হয়ে গেলোনা ব্যাপারটা?
বোতলভরা শিভাস রিগাল নিয়ে বসে থাকলে কি ব্যাপারটা গুরুগম্ভির আর আর্টিস্টিক হতো? শিল্পি পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন সাংবাদিকের দিকে।
না, ঠিক সেটা আমি মিন করিনি।
চা খাই, শিভাস রিগাল গিলিনা। এইজন্য তুমি আবার আমাকে অতি উন্নত চরিত্রের ভেবে বসোনা। আদতে আমি কি খাচ্ছি, তার সাথে চরিত্রের সংশ্রব নেই।
আচ্ছা? আপনি নিজেকে দুশ্চরিত্র ভাবেন নাকি?
কি ভাবি ওটা পরে বলছি। তার আগে বলো- চরিত্র বলতে তুমি নিজে কি বোঝ?
সাংবাদিকের হঠাৎ মনে হলো- শিল্পিকে প্রশ্ন করে লাভ নেই। বরং তাঁর শিল্পকর্মে ডুব দেওয়া যাক। ওইযে ওই ছবিটা- চাঁদের আলতে নুয়ে পড়া এক পথচারি আর তার ছায়া। কালো পিচের উপর রুপালি জোছনার ধারা। ওই ধারায় ডুব দিয়েই অনেক প্রশ্নের জবাব মিলে যায়, সেটাই তো লাভজনক।
ঠিক সে রাত্রিতেই শিল্পি নতুন একটা ছবি আঁকলেন। একজন লোক দৌড়ুচ্ছে, তার আশে পাশে ভিঞ্চির মোনালিসা, দালি’র দ্যা লাস্ট চাইল্ড কিংবা ভ্যানগঘের স্ট্যারি নাইট কিংবা জয়নুলের ম্যাডোনা ৪৩। কিন্তু সেসবে লোকটার খেয়াল নেই। তার দৃষ্টি কিছু পদচিহ্নের দিকে...
সাংবাদিক পরদিন রিপোর্টে লিখলো- মহৎ শিল্পের পিছনে সবচেয়ে বড় ভুমিকা রাখে মহৎ শিল্প। শিল্পি নন। তিনি মাধ্যম মাত্র। অর্থাৎ আমরা স্মরণ করবো সুইস আলকেমিস্ট প্যারাসেলসুসের সেই অমোঘ বাণী- “যাদুকে বলা হয় মায়াবিদ্যা। মায়াবিদ্যা হচ্ছে বিশেষ ধরণের জ্ঞান। অথচ যাদুতে জ্ঞান বলে কিছু নেই।“
গল্পকার
গভীর অনুরাগ ব্যপারটা বুঝিস?
কবি সাহেবের কথা শুনে আমি হাসলাম। বললাম-
জ্বিনা জনাব। এসব অনুরাগ টনুরাগ তেমন বুঝিনা আমি। তবে আপনি যদি ব্যাখ্যা করার কসরত করেন, আমি বোঝার চেষ্টা করতে পারি।
আমার কবি বন্ধু রওশন গভীর অনুরাগের ব্যখ্যায় গেলনা। তার সকল চিন্তা ভাবনার ক্ষণস্থায়িত্বের মত অনুরাগের গভীরতাও সম্ভবত স্থায়িত্ব হারাল।
জিজ্ঞাস করলাম- আমার কথায় কিছু মনে করলি নাতো?
রওশন গম্ভীর স্বরে বলে উঠল- না, কিছু মনে করিনি..
আমি নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না। তার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল। আমি কিছু বলে ওঠার আগেই রওশন চায়ের দোকানের বেঞ্চটা থেকে উঠে রাস্তায় নেমে হাঁটতে শুরু করলো।
খুব একটা অবাক হলাম তা নয়। ও বেচারা একটু এরকমই। নির্ঘাত কোন বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে। কবিদের চেতনা যে কত দ্রুত গঙ্গা থেকে যমুনায় চলে যেতে পারে, সে বিষয় আমাদের আম আদমিদের বোধগম্য হবার কথা নয়।
রওশন আজ রাস্তার উল্টো পাশ ধরে হাঁটছে। আশ্চর্য্য বিপদের একটা গন্ধ পেলাম আমি! ফাঁকা রাস্তা বলেই কি? ওর গতীটা কেমন যেন এলোমেলো!
জামিল আকুল গলায় বলল- থামলেন কেন? কি হল তারপর? কি হল?
বহুলোকের কাছে বহুবার করে বলা আমার এই গল্পটির নতুন শ্রোতা জামিল। আমার নতুন মেসমেট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজির ছাত্র।
আমি বললাম- এত অস্থির কেন হে? মনোবিদ হবে তুমি একদিন, অথচ অস্থিরতা পকেটে নিয়ে হাঁটো?
জামিল মোটেও গায়ে মাখলোনা আমার কথা। উহ জাহান ভাই, বলেন না কি হল তারপর? গল্পটা শেষ করেন না!
বাকিটা শুনবেই তাহলে তুমি? কি আর করা তবে শোন...
কবি সাহেব যে বিপদে পড়বে আমি প্রায় নিশ্চিত। দৌড়ে গেলাম তাকে রাস্তা থেকে টেনে সরিয়ে আনবো। ওমা! তাকে টেনে সরালাম ঠিকই, এর মধ্যে একটা ছুটন্ত কাভার্ড ভ্যান কোত্থেকে এসে, কিভাবে আমায় ধরাশায়ী করে আমার বাঁ পা টার ওপর দিয়ে চলে গেলো কে যানে!
উদাসী কবি সাহেব কে বাঁচাতে গিয়ে আমি নিজেই বেঁচে গেলাম সব কাজ কর্ম থেকে। আজীবনের জন্য! হাহা হা.. হাহাহা..
হাসতে হাসতে দেখলাম জামিল আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ওর অবাক মুখ দেখে আমার এত আনন্দ হচ্ছে! অকারণ সুখ। আমি হাঁসির তোড়টা আরও উচ্চ মার্গ্যে তুলে দিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:২৪