কয়েকদিন যাবতই কথাগুলো বলব বলে ভাবছিলাম। মনে একটু দ্বিধা ছিল। ভেবেছিলাম অল্প যে কয়েকজনই পড়েন না কেন তারা হয়তো ‘শাহবাগ’ সম্পর্কে কোন ভুল ধারণা নিতে পারেন। এখন মনে হচ্ছে ‘শাহবাগ’এর স্বার্থেই কথাগুলো বলা প্রয়োজন।
১) ব্লগার রাজিব-কে হত্যা করা হয়েছে তা প্রায় দশদিন হলো। তার হত্যার সাতদিন পর ‘শাহবাগ’হত্যাকারীদের সাতদিনের মধ্যে গ্রেফতারের আলিটমেটাম দেয়। আমার কাছে এ আলিটমেটামটা অনেক দেরিতে এসেছে বলে মনে হয়। পুলিশ এ পর্যন্ত তার খুনের সাথে জড়িত কাউকেই গ্রেফতার করতে পারেনি। অর্থবহ কোন অগ্রগতি হয়েছে এমন কোন খবরও গণমাধ্যমে আসেনি। গণমাধ্যম, এমনকি ‘শাহবাগ’-কেও এ বিষয়ে উৎকন্ঠিত বলে মনে হচ্ছে না। এনিয়ে কোন কথা-বার্তাও হচ্ছে না। হত্যাকান্ডের প্রথমদিন ‘শাহবাগ’ এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এটিকে জামাত-শিবিরের কাজ বলে উল্লেখ করেন। জামাত-শিবিরের যা রেকর্ড তাতে এ দাবি অযৌক্তিক কোন কিছু নয়। এখন যদি ধরে নেই জামাত-শিবির না হয়ে অন্য কোন পক্ষ জড়িত তাহলে প্রথমে জামাত-শিবিরের দিকে আঙ্গুল তুলার কারণে এ বিষয়টা নিয়ে চুপসে যেতে হবে? হত্যাটি যেই করুক তার বিচার করতে হবে। একাত্তরের খুনীদের ফাসীর দাবিতে ‘শাহবাগ’ নিদ্রাহীন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এখন সেই আন্দোলনের একজন অগ্র সেনানীর হত্যার বিচার যদি ‘শাহবাগ’ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয় তবে এরচেয়ে দুঃখজনক আর কি হবে?
২) ব্লগার রাজিব নাস্তিক এটা প্রচার হওয়ার পর ‘শাহবাগ’ কেমন যেন আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে চলে গিয়েছে বলে মনে হয়। ‘শাহবাগ নাস্তিকদের মিলনমেলা’ সম্ভবতো এই অপবাদ (!!!) এড়াতেই গত শুক্রবারে বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রার্থনার কর্মসূচি দেয়। ‘শাহবাগ’ এর এ আচরণ আমার কাছে ১৯৯১ পরবর্তী আওয়ামী লীগ এর আচরণের মতো মনে হয়েছে। আওয়ামী লীগ যেমন সময়ে সময়ে ধর্মের কাছে মাথা নত করে ‘শাহবাগ’ এর কর্মসূচিটা আমার কাছে তেমনটাই ঠেকেছে। এই আত্মরক্ষামূলক অবস্থান যে কোন কাজেই আসেনি তা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পরের দিন মোনাজাত পরবর্তী ঘটনাগুলোই যথেষ্ট।
৩) নাস্তিক-আস্তিক বা ধর্মীয় বিষয়টা নিয়ে ‘শাহবাগ’ এতোটা উৎকন্ঠিত না হলেও পারত। এটা নাস্তিকদের মিলনমেলা নয় সেটা প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজন ‘শাহবাগ’ এর ছিলনা। আস্তিকতা-নাস্তিকতা যার যার ব্যক্তিগত বিষয়। রাজিব নাস্তিক ছিল (???) বা এ আন্দোলনের সাথে যারা জড়িত তাদের কেউ কেউ নাস্তিক এটা নিয়ে উৎকন্ঠিত হওয়ার কোন কারণ ‘শাহবাগ’ এর ছিলনা বা এখনও নেই।
৪) সরকারের বক্তব্যে পরিস্কার যে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ হচ্ছেনা, নিষিদ্ধ হচ্ছে জামাতের রাজনীতি। আমার কাছে এটা কোন সমাধানই নয়। ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ না হলে জামাত নিষিদ্ধ হওয়ার পরদিনই আরেকটা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গড়ে তুলবে। আমি জানিনা ‘শাহবাগ’ এর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তটা কি। তবে ‘শাহবাগ’ যদি এ বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নেয় তবে ‘শাহবাগ’ পরবর্তী যে প্রগতিশীল সমাজের স্বপ্ন মানুষ দেখছে তা অনেকটাই স্থিমিত হবে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বা রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন নিষিদ্ধ না হলে দেখা যাবে এখন জামাত যেটা করছে পরবর্তীতে ওলামা লীগ সেটাই করছে।
৫) বাবু সুরঞ্জিত, নাসিম সাহেব, মহীউদ্দীন আলমগীর, শামীম ওসমানরা শাহবাগের আন্দোলন বা নতুন প্রজন্মের আশা-আকাংখার বিষয়ে একটু কম ভাবলেই ভাল। বেশি ভাবলে হিতে-বিপরিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কারণ এদের সম্পর্কে নতুন অথবা পুরাতন প্রজন্মের অধিকাংশের তেমন ইতিবাচক অনুভুতি নেই।
৬) অনেক ভারতীয় হিতাকাংখী শাহবাগ এর প্রতি একাত্ম হচ্ছেন। সেদিন এক ভারতীয় ফেসবুক বন্ধুর স্ট্যাটাস এ দেখলাম ‘শাহবাগ’ এর প্রতি একাত্মতা দেখাতে ত্রিপুরার মানুষ নো-ম্যানস ল্যান্ডে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। ‘শাহবাগ’ এর প্রতি, গণজাগরণের প্রতি ভারতীয়দের এমন স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে কারণে-অকারণে ভারত-বিরোধীতা আমাদের রাজনীতির অন্যতম উপজীব্য বিষয় । কখনও রাজনীতির বাক-নির্ধারণেও এ বিরোধীতা ভূমিকা রাখে। নো-ম্যানস ল্যান্ডে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন যারা করেন তারা সীমান্ত হত্যা বন্ধের বিষয়ে কি ভূমিকা রাখছেন সে বিতর্কটা প্রতিক্রিয়াশীলরা তুলতেই পারে। কাজেই আমার মনে হয় ‘শাহবাগ’ যতোটা ভারতীয় স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন (সেটা যতোটাই যৌক্তিক হোক) এড়িয়ে চলতে পারে ততোটাই তার জন্য ভাল। রাজনীতির একজন ছাত্র হিসেবে আবেগের চেয়ে টেনিক্যাল পয়েন্টগুলোই আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
৭) বইমেলার সাথে ‘শাহবাগ’ এর যোগসূত্রটা অব্যাহত রাখার স্বার্থে এবারের মেলাটি যথাসম্ভব দীর্ঘায়িত করা যেতে পারে।
উল্লেখিত বক্তব্যগুলো কোন সমালোচনা নয়। বস্তুত ‘শাহবাগ’এতোটাই অসাধ্য সাধন করেছে যে, তার সমালোচনা করলে পাপ হবে। ‘শাহবাগ’ এর অসাধ্য সাধনে উৎসাহিত হয়ে কেউ যদি তার কাছ থেকে আরো বেশি কিছু আশা করে তবে এটা নিশ্চয়ই অযাচিত বা অন্যায় হবেনা।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১:০৮