গত রোববার আশুলিয়ায় অগ্নুৎপাতে নির্মমভাবে নিহত পোশাক শ্রমিকদের জন্য ঘোষিত রাষ্ট্রীয় শোকের দিনটি না ফুরোতেই আমাদের মিডিয়ায় আরেক মাতম শুরু হয়েছে। কর্পোরেট মালিকদের টাকায় পরিচালিত মিডিয়ার এ মাতম অবশ্য অনাকাংখিত বা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অবশ্য মাতমের এ ধারাটির উদ্বোধন করেছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। গত সোমবার জাতীয় সংসদে অগ্নিকান্ডে নিহত শ্রমিকদের জন্য গৃহীত শোক প্রস্তাবের উপর বক্তব্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তার সারমর্ম করলে যা দাঁড়ায় তাহলো, পোশাক শিল্পে বৈদেশিক বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করার জন্য ষড়যন্ত্র করে এমনটি ঘটানো হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যটি লুফে নিতে ব্যবসায়ীদের মালিকানাধীন মিডিয়া এক মুহূর্তও দেরি করেনি। সত্যি বলতে তারা এমন একটি সুযোগের জন্য ওৎপেতে ছিল।
জাতীয় সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার ব্রিগেড ও পুলিশ পাঠানো হয়। সেনাবাহিনী ও র্যাবও পাঠানো হয়। আমি বিষয়টি শুরু থেকে পর্যবেক্ষণ করেছি। রাত দেড়টা থেকে আড়াইটার মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে যে কাজগুলোর ফিরিস্তি দিয়েছেন তা দুর্যোগ মুহূর্তে একজন সরকার প্রধানের সাধারণ দায়িত্ব। এরপরেও তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু এর পর মুহূর্তে তিনি যা বলেছেন, সেটা ঠিক রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর বক্তব্য নয়। এমন বক্তব্য আশা করা যায় গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজেএমই এর সভাপতি বা ঐ সংগঠনের কর্তাদের মুখ হতে। বকেয়া বেতন, বোনাস, বেতন বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকেরা যখন যৌক্তিক আন্দোলন করে তখনই বিজেএমই এর কর্তাব্যক্তিরা এগুলোকে পোশাক শিল্পের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করেন। এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে তাঁদের ভূমিকায় দেখতে পেয়ে মালিকপক্ষ নিঃসন্দেহে খুশিতে আটখানা হবে।
ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। তবে এটা এমনটা প্রতিষ্ঠিত করেনা যে, সেই কারখানাটি শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ ছিল বা নিরাপত্তা ব্যবস্থায় মালিকের কোন গাফিলতি ছিল না। কিন্তু আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে এ বিষয়টি পুরোপুরি অনুপস্থিত ছিল। তিনি শুধু ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’টি প্রতিষ্ঠিত করতেই একাগ্র ছিলেন। তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে তিনি হতাহতের ঘটনার পরের দিনের একটি ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে টেনেছেন। বলেছেন তিনি নিজে নাকি সিসি ক্যামেরায় দেখতে পেয়েছেন কোন এক কারখানায় জনৈক শ্রমিক টাকার বিনিময়ে আগুন লাগাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সর্বোচ্চ সন্মান রেখে বলব এসব ষড়যন্ত্রের সম্ভাব্য সবগুলো দিকই বিবেচনায় আনতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে উচ্চরিত ষড়যন্ত্রটি কোন তৃতীয় পক্ষের ষড়যন্ত্র হতে পারে আবার মালিকদের সাজানোও হতে পারে। ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’-কে প্রতিষ্ঠার জন্য মালিক পক্ষ মর্মান্তিক ঘটনাটির পর থেকে নিজেরা সংগঠিত হয়েও এমন আগুন লাগানোর অভিনয়ে নামতে পারেন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কেবল মুদ্রার একটি পিঠই দেখতে পাচ্ছেন।
বিবেচনার যোগ্য আরেকটি বিষয় হচ্ছে ঘটনার কারণ এখনো তদন্তাধীন। ঘটনার পর ০৫টি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতাধর কোন ব্যক্তি যখন একটি বিষয়ে সুস্পষ্ট মতামত দিয়ে দেন তখন তদন্ত কমিটির এমন সাহস নেই যে তারা ওনার মতামতের বিরুদ্ধ কোন প্রতিবেদন দিবেন। এক্ষেত্রে ওনার মতামত একটি নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। অবশ্য এমন মতামত তিনি তদন্তাধীন অনেক বিষয়েই দিয়ে থাকেন। ওনার প্রতি সন্মান দেখাতে অন্তত এ মুহূর্তে আমি এটা বলছিনা যে, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই এমনটা করেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তাঁর মন্ত্রীসভা, মিডিয়া, বিজেএমই যে পোশাক শিল্পকে দেশের গর্ব বলে প্রচার করেন, যার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সচেতন থাকার জন্য সবাই-কে সোচ্চার থাকতে বলেন সেই পোশাক শিল্পকে কারা গড়ে তুলেছেন? গড়ে তুলেছেন আমাদের পোশাক শ্রমিকরা। এ খাতে বিদেশী বিনিয়োগের একমাত্র কারণ সস্তা শ্রম। এখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তার গুণধর শিল্পমন্ত্রী বা ব্যবসায়ীদের কোন কারিশমা নেই। সস্তা শ্রমই এ কারিশমার একমাত্র নিয়ামক। কিন্তু সেই শ্রমিকদের জীবনের মান উন্নয়ন না করে, তাদের জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি চিন্তায় না এনে বিদেশ বিনিয়োগের দোহাই দিয়ে দোষীদের আড়াল করতে চাইবেন এমনটা কোন অবস্থায়ই মেনে নেয়া যায় না। ১২৬ জন মানুষ আগুনে পুড়ে কয়লা হয়েছে। বিদেশী বিনিয়োগের ধুয়া তুলে এ নির্মমতার জন্য দায়ীদের আড়াল করার চেষ্টা কোনো অবস্থায়ই মঙ্গলজনক হবে না।
এখানে যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি আক্ষেপের তাহলো ঘটনা ঘটার পরই সরকার ষড়যন্ত্রের সন্ধান পায়। এনএসআই, ডিজিএফআই, র্যাব, এসবি, ডিবি সহ সরকারের কতো বাহিনী, কতো সংস্থা। এতো এতো বাহিনী, এতো এতো সংস্থা থাকতে এসব ষড়যন্ত্রে ঘটনা কিভাবে ঘটে? সরকারের এই বাহিনীগুলোর কাজ কি? শুধু ভিআইপি আর এলিট শ্রেনীর মানুষদের জীবন, মান, সম্পদ রক্ষা করা?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যতোই ষড়যন্ত্রের কথা বলে মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের নিরাপদে রাখার প্রয়াস নেন না কেন বা তাঁর প্রশাসনের ব্যর্থতাকে আড়াল করার চেষ্টা করেন না কেন এটা চরম সত্য যে শাক দিয়ে কখনই মাছ ঢেকে রাখা যায়না। কাজেই এক্ষেত্রে ওনার উচিত হবে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক ও মানবিক সাহায্যের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের সংস্থাসমূহকে প্রণোদিত করার পাশাপাশি ঘটনার জন্য দায়ীদের উপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনা। সাথে সাথে মালিকপক্ষ যাতে শ্রমিকদের কাজের স্থানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে বাধ্য হন তার ব্যবস্থা করা। যদি তিনি এমনটা করতে পারেন তবে গত চার বছরে ওনার যে পরিমান ক্ষতি উনি নিজে করেছেন তার অতি ক্ষুদ্র অংশের হলেও ক্ষয়পূরণ সম্ভব হবে।