মুদ্রনযন্ত্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি উনিশ শতকে ছাপাখানার ইতিহাস শুরু । প্রায় একই সঙ্গে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চারও সূচনা । বিজ্ঞানগ্রন্থ প্রকাশের পাশাপাশি বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা মুদ্রিত হতে দেখা যায় সাময়িকীগুলোতে । এক সময় দেখা যায় বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান পত্রিকারও আত্মপ্রকাশ । বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন তৎকালীন সময়ে অনেকেই । তাঁদের একটা বড় অংশ বিজ্ঞানী ছিলেন না , কিন্তু বিজ্ঞান চর্চা সাধারন মানুষের মনে প্রসারিত করেছিলেন বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা তৈরি করে । এই কাজে বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথও নিয়োজিত হয়েছিলেন এক সময় ।
কবিগুরুর কাছে বিজ্ঞান ছিল সংস্কৃতিরই একটা অঙ্গ । তাই বিজ্ঞানের মাঝে লুকিয়ে থাকা সেই রসকে বারংবার চিনে নিতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ । তাঁর জীবন দর্শনে বার বার প্রতিফলিত হয়েছে বিজ্ঞান মনস্কতা । রবীন্দ্রনাথের বাল্যকাল থেকেই শুরু করা যাক। মাত্র সাড়ে বারো বয়সে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ একটি অস্বাক্ষরিত বিজ্ঞানভিত্তিক প্রবন্ধ লেখেন; শিরোনাম- “গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি”। এটা কিন্তু এখন স্বীকৃত যে, ‘গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি’ ই রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত গদ্য রচনা ।
সাধনা , ভারতী , নবপর্যায় – বঙ্গদর্শন , ভান্ডার ও তত্ত্ববোধিনী মোট এই পাঁচটি পত্রিকা রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনে সম্পাদনা করেছেন । এছাড়া জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবার এর পারিবারিক মুখপত্র “বালক” পত্রিকার তিনি ছিলেন কর্মাধ্যক্ষ । ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত "বালক" পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের মেজ বৌদি জ্ঞানদাননন্দিনী দেবীর নাম ছাপা হলেও আসলে বালকের লেখা নির্বাচন ও সম্পাদনার যাবতীয় কাজ সামলাতেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ।
বালক পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয় নরেন্দ্রবালা দেবীর প্রবন্ধ 'সূর্যের কথা ' । নরেন্দ্রবালা দেবীর কথা বাঙালি মনে রাখে নি । তিনিই বাংলা ভাষার প্রথম ছোটদের জন্য বিজ্ঞান - লেখিকা । মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের বড়ো মেয়ে সৌদামিনীর পুত্র সত্যপ্রসাদ । সত্যপ্রসাদের স্ত্রী নরেন্দ্রবালা দেবী । ১৮৮৫ সালে একজন মহিলা ছোটদের কথা ভেবে বিজ্ঞানের লেখা লিখতে প্রয়াসী হয়েছেন এটা ভাবতেই তো মনে বিস্ময় জাগে । গল্পচ্ছলে তিনি সূর্যের কথা বর্ণনা করেছেন । সূর্য কত বড় বোঝাতে গ্রিক পণ্ডিতের কথাও এনেছেন । একই সালে বালক পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় ( বঙ্গাব্দ ১২৯২ এর জ্যৈষ্ঠ ) লিখেছিলেন "সূর্যকিরণের ঢেউ" ও তৃতীয় সংখ্যায় ( বঙ্গাব্দ ১২৯২ এর আষাঢ় ) "সূর্যকিরণের কার্য " । নরেন্দ্রবালার এই লেখাগুলোতে নিউটনের কথা এসেছে । আছে অনেক তথ্য ও পরিসংখ্যান । সহজভঙ্গিতে সেসব বোঝানো হয়েছে । প্রবন্ধগুলো নিয়ে পাঠক মনে যথেষ্ট আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল । পাঠকের চিঠি এসেছে পত্রিকা দপ্তরে ।
বালক পত্রিকার কার্তিক ১২৯২ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ নিজে লিখলেন "বৈজ্ঞানিক সংবাদ" । বিজ্ঞানের সাহিত্য কী করে রমণীয় সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে তারই নিদর্শন রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই লেখায় । পরিবেশিত একটি প্রসঙ্গঃ
"পণ্ডিতবর টাইলর সাহেব বলেন পরীক্ষা করিয়া দেখিলে উদ্ভিদের কার্যেও কতকটা যেন স্বাধীন বুদ্ধির আভাস দেখিতে পাওয়া যায় । বৃক্ষ নিতান্ত যে জড়যন্ত্রের মতো কাজ করে তাহা নহে , কতকটা যেন বিচার করিয়া চলে । টাইলর সাহেব এই বিষয় লইয়া অনেক বৎসর ধরিয়া পরীক্ষা করিয়া আসিতেছেন । তিনি বলেন কৃত্রিম বাধা স্থাপন করিলে গাছেরা তাহা নানা উপায়ে অতিক্রম করিবার চেষ্টা করে , এমনকি নিজের সুবিধা অনুসারে পল্লব সংস্থানের বন্দোবস্ত পরিবর্তন করিয়া থাকে । এ বিষয়ে তিনি অন্যান্য নানবিধ প্রমাণ প্রয়োগ করিয়া সম্প্রতি একটি বক্তৃতা দিয়াছেন। "
রবীন্দ্র-অগ্রজা স্বর্ণকুমারী দেবীর লেখা বড়ো প্রবন্ধ "ছায়াপথ" বালক পত্রিকার এর ফাল্গুন ১২৯২ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় । স্বর্ণকুমারী দেবীকে যেমন পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট করেছিলেন , তেমনই করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে । রবীন্দ্রনাথ কৈশোরেই চিনে ফেলেছিলেন আকাশ ভরা সূর্য তারা , গ্রহ - নক্ষত্র । রবীন্দ্র রচনায় রয়েছে সে বর্ণনা । রবীন্দ্র-অগ্রজা স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রবন্ধগুলোতে বার বার মূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর যুক্তিবাদী মন । "পৃথিবী" স্বর্ণকুমারীর লেখা বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক পুস্তক , ১২৮৯ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় । উনিশ শতকের শেষের দিকেও মেয়েরা ছিল পর্দানশিন । শিক্ষার আলো তখনো সে ভাবে পড়ে নি । সেই প্রেক্ষাপটে স্বর্ণকুমারী দেবীর বিজ্ঞানবোধ আমাদের অভিভূত করে ।
“সাধনা” পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ মুখ্যত নিজেই বিজ্ঞানের হাল ধরেছিলেন । পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই "বৈজ্ঞানিক সংবাদ" নামে বিভাগ চালু করেছিলেন - সেটা ১২৯৮ বঙ্গাব্দ অগ্রহায়ণ । এই বিভাগেই ছাপা হয় কবিগুরুর চারটি বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা । যথাক্রমে ১) গতিনির্ণয়ের ইন্দ্রিয় ২) ইচ্ছামৃত্যু ৩) মাকড়সা-সমাজে স্ত্রী জাতির গৌরব ৪) উটপক্ষীর লাথি । পরের সংখ্যাতে একই বিভাগে আরো তিনটি লেখা - ১) জীবনের শক্তি ২) ভূতের গল্পের প্রামাণিকতা ৩) মানবশরীর । পত্রিকার সূচনা থেকেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর পাঠকবর্গকে বিজ্ঞানসচেতন করে তোলার পরিকল্পনা নেন । তাই কাগজের প্রথম দুটি সংখ্যায় বিজ্ঞান নিয়ে নিজেই কলম ধরলেন । পরে এই বিভাগে অন্যদের দিয়ে বিজ্ঞানের নানা প্রবন্ধ লেখাতে লাগলেন । এই প্রসঙ্গে সাধনায় মুদ্রিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ ও তার রচয়িতার নাম জানাই । "জ্যোতির্বিজ্ঞান -স্পেকট্রোস্কোপ ও ফটোগ্রাফি " - সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১২৯৮ বঙ্গাব্দ মাঘ , "আকাশ তরঙ্গ" - রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ১২৯৯ বঙ্গাব্দ জ্যৈষ্ঠ , "প্রতীচ্য গণিত" - জগদানন্দ রায় ১৩০১ বঙ্গাব্দ আষাঢ় । রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখা স্বতন্ত্র বিজ্ঞান প্রবন্ধ "ভূগর্ভস্থ জল এবং বায়ুপ্রবাহ" ১৩০১ বঙ্গাব্দ আশ্বিন ।
১৩০৫ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় জগদানন্দ রায়ের লেখা "বৈজ্ঞানিক প্রসঙ্গ "।
১৩০৮ থেকে ১৩১২ বঙ্গাব্দ , এই সময়পর্বে কবিগুরুর সম্পাদনায় "বঙ্গদর্শন" পত্রিকায় বিজ্ঞান প্রচার এর ভূমিকা যথেষ্ট উজ্জ্বল। রবীন্দ্রনাথ এই পর্বে বিস্মৃত হননি যে উনিশ শতকের বঙ্গদর্শনে বঙ্কিমচন্দ্র বিজ্ঞানকে একটি বিশেষ স্থান ও মর্যাদা দিয়েছিলেন । বঙ্গসমাজে বিজ্ঞানকে প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র । নবপর্যায় - বঙ্গদর্শনে রবীন্দ্রনাথও সেখান থেকে সরে এলেন না । এই পত্রিকায় বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশ ও সম্পাদনায় রবীন্দ্রনাথের বিশেষ সহায়ক হলেন জগদানন্দ রায় । এই পত্রিকায় মুদ্রিত বিজ্ঞানবিষয়ক প্রধান- প্রধান রচনাগুলোর নামোল্লেখ করা গেলঃ "জীবকোষ" - জগদানন্দ রায়, ১৩০৮ বঙ্গাব্দ জ্যৈষ্ঠ , "আচার্য জগদীশের জয় বার্তা" - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , ১৩০৮ বঙ্গাব্দ আষাঢ় , "আবহ সমন্ধে" - যোগেশ চন্দ্র রায়্ ১৩০৮ বঙ্গাব্দ শ্রাবণ , "অধ্যাপক বসুর নব আবিষ্কার" - রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ১৩০৮ বঙ্গাব্দ আশ্বিন ও বঙ্গাব্দ ১৩০৮ থেকে ১৩১২ পর্যন্ত জগদানন্দ রায়ের প্রবন্ধ "মহাকর্ষণ" , "যুগল নক্ষত্র" , "পৃথিবী ও সূর্যের তাপ" , "ইলেকট্রন " , "আচার্য বসুর আর একটি আবিস্কার ফটোগ্রাফি" ।
এবার কবিগুরুর লেখা বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ "বিশ্ব পরিচয়" প্রসঙ্গে আসা যাক । বইটি যখন লেখা হয় কবির বয়স তখন ৭৬ বছর । এই বইটিতে ভূলোক , গ্রহলোক , সৌরজগৎ , নক্ষত্রলোক , পরমানুলোক, অতিক্ষুদ্র এবং অতিবৃহৎ বিশ্বের নানা তথ্য ও তত্ত্বের জটিল ও দুরূহ বিষয়ের সমাবেশ ঘটানো হয়েছে অত্যন্ত সাবলীল ভঙ্গিতে ও মাতৃভাষায় । বাংলা ভাষার এই শ্রেষ্ঠ রূপকার বিজ্ঞান প্রচারের ক্ষেত্রে যে অগ্রসর চেতনার পরিচয় দিয়েছেন তা সকল বাংলা ভাষাভাষীর জন্য গৌরবের সামগ্রী , বাংলা সাহিত্যে তা অনন্তকাল ধরে এক দিগদর্শনের কাজ করবে এতে কোন সন্দেহ নেই ।
References : 1 ) The physics of Tagore: Promoting the scientist in the poet . Dr. Rathindranath Sarkar The Journal of Jadavpur University , volume number 112 , page number 113-115
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৩২