ছবি:-বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল (১৯৪৭-১৯৭১)
মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসীকতার জন্য যে ৭ জন শহীদকে বাংলাদেশ সরকার বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করেছেন তাদের নিয়ে আমার ৭ পর্বের ধারাবাহিক পোষ্টের আজ ৪র্থ পর্ব বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামালকে নিয়ে।
বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের পরিচিতি ও স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর ভূমিকাঃ-
বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন৷ পিতা হাবিবুর রহমান সেনাবাহিনীর একজন হাবিলদার৷ মাতা মালেকা বেগম৷ স্বপরিবারে থাকেন কুমিল্লা সেনানিবাসে৷ গ্রামে হাবিবুর রহমান, হাফিজ মিলিটারি নামে পরিচিত৷ সরকারি ছুটিছাটায় হাবিবুর রহমান যখন গ্রামে আসেন তখন তাঁর সাথে নিয়ে আসেন স্ত্রী মালেকা বেগম ও দুই সন্তান মোস্তফা কামাল এবং মোস্তাফিজুর রহমানকে৷ ছেলেবেলায় ছিলেন খুব ডানপিটে স্বভাবের৷ তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে কুমিল্লা সেনানিবাসে পিতার সরকারি আবাসে৷ সেনানিবাসের সাজানো গুছানো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর দিন কেটে যায়৷ স্কুল ফাঁকি দিয়ে মোস্তফা কামাল ঘুরে বেড়ান সৈনিকদের ছাউনিতে৷ স্কুলের পড়াশোনার চেয়ে মোস্তফা কামালের ভালো লাগে সৈনিকদের কুচকাওয়াজ, মার্চপাস্ট৷ আর অন্য সৈনিকদের মতো একজন দীপ্ত সৈনিক হওয়ার জন্য নিজে নিজে তৈরি হতে থাকেন ৷ কিন্তু পুত্রের এই ইচ্ছেয় বাধ সাধেন পিতা৷ পিতা চাননি তাঁর ছেলে সেনাবাহিনীতে যোগ দিক৷ ফলে ২০ বছর বয়সে মোস্তফা কামাল একদিন কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যান৷ কোথাও তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ এই নিরুদ্দেশের দিনগুলোতে তিনি চুপিচুপি যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে৷ ১৯৬৮ সালে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে তাঁর চাকুরি চূড়ান্ত হওয়ার পর পিতা-মাতা তাঁর সন্ধান পান৷
১৯৭১ সালের মার্চের মাঝামাঝি সময়ে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পাঠানো হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৷ তখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে স্বাধীনতা যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ৷ স্বাধীনতার দাবিতে সারাদেশ উত্তাল৷ প্রতিটি সেনানিবাসে থমথমে অবস্থা৷ বাঙালি সামরিক অফিসারদের চেয়েও অধিক ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ, উদ্বেলিত উত্তেজিত ছিল বাঙালি সিপাহীরা৷
সামরিক নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখার জন্য সশস্ত্র বাহিনীর অবাঙালি অধিনায়কেরা বিভিন্ন বাঙালি রেজিমেন্টকে একস্থান থেকে আরেকস্থানে স্থানান্তর করছিল৷ এই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা শক্তিশালী করার উদ্দ্যেশেই কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্থানান্তর করা হয়েছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে৷ কিন্তু উদ্দেশ্য শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়৷ মেজর শাফায়েত জামিল (পরবর্তীতে কর্নেল ও অবসরপ্রাপ্ত) কিছুসংখ্যক বাঙালি অফিসারের সহায়তায় ২৭ মার্চের সকালবেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সে'সময়ের অবাঙালি অধিনায়ক লে. কর্নেল খিজির হায়াত খান এবং সমস্ত পাকিস্তানি অফিসার ও জওয়ানদের নিরস্ত্র করে বন্দি করে ফেলেন৷ অপরদিকে মেজর খালেদ মোশাররফ অন্য একটি কোম্পানি নিয়ে সিলেটের শমসেরনগর থেকে বিদ্রোহে যোগ দেন এবং নেতৃত্ব গ্রহণ করেন৷
স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান নেয় চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট৷ মোস্তফা তখন চব্বিশ বছরের দীপ্ত তরুণ৷ চার বছর যাবৎ কাজ করছেন সেনাবাহিনীতে৷ তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন বাঙালিদের উপর পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুর আচরণ৷ রেডিওতে শুনেছেন ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর জ্বালাময়ী ভাষণ৷ স্বাধীনতার স্বপ্নে তাঁর দু'চোখ জ্বলে ওঠে৷ ঘরে ছিল তাঁর তরুণী বধূ, সদ্যজাত শিশুপুত্র৷ ছিল ভাই-বোন, মা-বাবা, পিতামহী৷ সকলের মায়া ত্যাগ করে দেশ ও স্বাধীনতার এক বিপুল প্রেমে যোগ দেন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের সঙ্গে৷
ছবি:- বাংলাদেশের গৌরব ৭ বীরশ্রেষ্ঠ।
আশুগঞ্জের ঘাঁটির পেছনেই হেলিকপ্টার দিয়ে অসংখ্য পাকিস্তানি সৈন্য নামানো হলো৷ মুক্তিবাহিনী কৌশলে পশ্চাদপসরণ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আখাউড়া রেলপথ ধরে চলে এল আখাউড়ায়৷ এই আখাউড়াকে কেন্দ্র করে নতুনভাবে মোট তিনটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলা হলো৷ তিতাস নদীর ব্রিজে, আখাউড়ার দক্ষিণে গঙ্গাসাগরে এবং তার উত্তরে দরুইন গ্রামে৷ ইতিমধ্যেই মোস্তফা কামালের সাহস, বুদ্ধি ও কর্মতৎপরতা মুগ্ধ করে মেজর সাফায়াত জামিলকে ৷ তিনি তাঁকে ২নং প্লাটুনের ল্যান্সনায়েক নির্বাচিত করেন৷ সে অনুসারে মোস্তফা কামাল দশজন সৈন্যের সেকশন কমান্ডার হন৷ এই ২নং প্লাটুনকেই দরুইন গ্রামের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির দায়িত্ব দেওয়া হলো৷
১৮ এপ্রিল ভোরবেলা৷ আকাশে উড়ে এল কালো মেঘের সারি৷ ঈশাণ কোণ থেকে আসতে লাগল শীতল বাতাস৷ মুক্তিযোদ্ধারা মনে মনে ভাবল, আসুক মেঘ, বৃষ্টিতে ভাসিয়ে দিক সব৷ তাহলে হয়ত শত্রুরা একটু দমে যাবে৷ সকালটা একরকম নির্বিঘ্নেই কাটল৷ পাকিস্তানি বাহিনী কোনোরকম গোলাবর্ষণই করল না৷ শুধু কয়েকটা হেলিকপ্টার উড়ে গেল উজানীস্বর পুলের দিকে৷ খাবার এলেও মোস্তফা পরিখা থেকে উঠে এলেন না ৷ প্লাটুনের সবাই একে একে খাবার নিয়ে গেল৷ তিনি এলএমজি হাতে নিজের ট্রেঞ্জে অতন্দ্র, অনড়৷
বেলা এগারোটা৷ পাকিস্তানি বাহিনী আবার গোলাবর্ষণ শুরু করল৷ আর সাথে সাথেই শুরু হলো প্রচণ্ড বৃষ্টি৷ কিন্তু বৃষ্টিকে অবজ্ঞা করেই এগিয়ে এলো শত্রু৷ আধঘন্টার মাঝে অবস্থান নিল মোগরা বাজার ও গঙ্গাসাগরে৷ সাড়ে এগারোটায় এ দুটো অবস্থান থেকে আসতে লাগল অনবরত গুলির ধারা৷ মোগরা বাজারের একটি উঁচু দালানের ছাদে শত্রুরা বসাল একটি মেশিনগান৷ আর এ থেকেই মারাত্মকভাবে দরুইনের ঘাঁটিতে গোলাবর্ষণ করে যাচ্ছিল৷
বেলা বারোটায় আক্রমণ হলো তীব্রতরভাবে৷ পশ্চিম দিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনী এবার সরাসরি আক্রমণ করে বসল৷ মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা গুলি তার সামনে কিছুই ছিল না৷ তার উপর আবার একটা গুলি এসে বিদ্ধ করল মেশিনম্যানকে৷ সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল মেশিনগান৷ মোস্তফা মুহুর্ত দেরি না করে মেশিনগানটি হাতে তুলে নিয়ে গুলি চালাতে লাগলেন৷
দুপুরের পর পাক হানাদারের আক্রমণ আরও তীব্রতর আকার ধারণ করল৷ প্রবল বৃষ্টির কারণে তাদের তীব্রতা হ্রাস পেতে পারে এমনটি ধারণা করছিল মুক্তিযোদ্ধারা৷ ফল উল্টো হওয়ায় তাঁরা সামান্য হতবিহ্বল হয়ে পড়েন৷ তবে সেকশন কমান্ডার মোস্তফার অবিচলিত মনোভাব ফের তাঁদের আত্নবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে৷
পাকিস্তানি সৈন্যরা সংখ্যায় অনেক বেশি৷ সঙ্গে তাদের বিপুল অস্ত্রের ভাণ্ডার৷ তারা দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর দিক থেকে দরুইনকে প্রায় ঘিরে ফেলল৷ তাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় একেবারে নগণ্য৷ ভারী অস্ত্র নেই বললেই চলে৷ এই অবস্থায় কৌশল গ্রহণ করতে হলো- প্রথমত সামনা-সামনি যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করা দ্বিতীয়ত পূর্বদিকে পশ্চাদপসরণ করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়া৷ পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্তই অধিক যুক্তিযুক্ত মনে হলো তাঁদের কাছে৷ কিন্তু পিছু হটতে হলেও তো কিছুটা সময় প্রয়োজন৷ পিছু হটার সময় কাভার দেবে কে? কিন্তু পিছু না হটলে সবার মৃত্যু অবধারিত৷ মোস্তফা কামাল স্থির করলেন তিনিই কাভারিং ফায়ার দেবেন৷ এই উদ্দীপ্ত, তারুণ্যের প্রতীক, তেজি সংগ্রামী মানুষটি নিজে পরিখার মধ্যে দাঁড়িয়ে গেলেন৷ একাই গুলি চালাতে লাগলেন উত্তরে, দক্ষিণে, পশ্চিমে৷ মোস্তফা নির্দেশ দিলেন সবাইকে পিছু হটার জন্য৷ কিন্তু তাঁকে রেখে অন্যরা যেতে চায় না৷ মোস্তফা বললেন, কেউ একজন কাভারিং ফায়ারের দায়িত্ব না নিলে বাকি সবাইকে মরতে হবে৷ সেকশন কমান্ডার হিসেবে এটা আমারই দায়িত্ব৷
মোস্তফা কামালকে দুর্গের মধ্যে রেখেই বাকিরা খুব সাবধানে পিছু হটতে লাগলেন৷ মোস্তফা অনবরত গুলি চালাতে লাগলেন শত্রুদের ওপর৷ তাঁর গুলির তোড়ে হানাদার বাহিনী এগোতে গিয়ে থামতে বাধ্য হলো৷ এবার অন্য মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে সরে আসার জন্য অনুরোধ জানান৷ কিন্তু মোস্তফা মনস্থির করে ফেলেছেন৷ তিনি অনড়, অদম্য, নিজেই এক বিশাল দুর্গম দুর্গ৷ তাঁকে ভেদ করবে একমাত্র মৃত্যু৷ ক্রমাগত গুলি চালাতে লাগলেন শত্রুর ওপর৷ কিন্তু বিধি বাম, একসময় তাঁর গুলি ফুরিয়ে গেল৷ হানাদার বাহিনী ত্রিমুখী আক্রমণে তাঁকে ঘিরে গুলি চালাতে লাগল৷ গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল মোস্তফার শরীর৷ নিজের পরিখাতেই ঢলে পড়েন তিনি৷ তাঁর এমন বীরত্বের কারণেই অন্য সহযোদ্ধারা বেঁচে রইলেন আগামী সময়ে যুদ্ধ করার জন্য৷
দরুইন গ্রাম থেকে পশ্চাদপসরণ করে মুক্তিযোদ্ধারা আখাউড়া চলে যান৷ গঙ্গাসাগর ও দরুইন অধিকার করে একসময় পাকবাহিনী এলাকা ছেড়ে যায়৷ পরবর্তীতে দরুইনের স্থানীয় লোকেরা বুলেটে ঝাঁঝরা, বেয়নেটবিদ্ধ মোস্তফা কামালের লাশ খুঁজে পান৷ হানাদার বাহিনী যখন ট্রেঞ্জে প্রবেশ করে তখনও হয়ত মোস্তফার দেহে প্রাণ ছিল৷ বর্বর হানাদাররা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়েই হয়তো তাঁকে হত্যা করেছে৷ দরুইনের মাটিতে শায়িত আছেন এই বীর৷ তাঁর অদমনীয় মানসিক দৃঢ়তা ও নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে অন্যদের বাঁচিয়ে দেয়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অমর গৌরবগাথা৷ আর এ জন্যই তিনি পেয়েছেন বীরশ্রেষ্ঠের মর্যাদা৷
ছবি:- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার দরুইন গ্রামের এই কবরে মহান এই বীর চিরশায়িত আছেন৷
সংক্ষিপ্ত জীবনী
জন্ম : ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৪৭ সাল।
জন্মস্থান : ভোলা জেলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজিপুর গ্রামে৷
পিতা : হাবিবুর রহমান মণ্ডল ৷
মা : মোসাম্মৎ মালেকা বেগম ৷
কর্মস্থল : সেনাবাহিনী৷
যোগদান : ১৯৬৮ সাল৷
পদবী : সিপাহী৷
মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টর : ৮ নং সেক্টর৷
মৃত্যু : ১৮ এপ্রিল, ১৯৭১ সাল৷
সমাধি স্থল : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার দরুইন গ্রামে৷
ছবি ও তথ্য সূত্র:- মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর, ইন্টারনেট, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বিভিন্ন গবেষনাপত্র।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: গবেষক এহসান হাবীবকে।