ইভ্যালির বিজনেস মডেল নিয়ে কম বেশি সবাই বিস্মিত। এত টাকা ছাড়ে কিভাবে বিজনেজ করা যায়? তাও একবার দুইবার দিলে একটা কথা ছিল, এক বছরের বেশি সময় ধরে তারা এভাবেই চলছে, তাও কম দামী এফএমসিজি পন্য না শুধু, গাড়ি বাইক এসি টিভি ফ্রিজের মত দামী দামী জিনিসপত্রও। তো এই বিজনেস মডেলকে জাস্টিফাই করার জন্য অনেকেই নিজের মত করে ব্যখ্যা দার করানোর চেস্টা করেছেন যে কিভাবে এত ছাড় দিয়েও ব্যবসায় টিকে থাকা সম্ভব! বহুল প্রচলিত সেইসব ব্যখ্যা গুলোকেই একটু কাটাছেড়া করা যাক।
১। ইভালি টাকা ইনভেস্ট করেঃ ইভ্যালি কাস্টোমারদের থেকে এডভান্স টাকা নেয়, কিন্ত পন্য ডেলিভারি দেয় ১ মাস থেকে ৩ মাসেরও বেশি সময় পর! এই সময়টা তারা সেই টাকা অন্য কোথাও ইনভেস্ট করে 'লাভ করে' তারপর সেই টাকা দিয়ে গ্রাহকদের পন্য ডেলিভারি দিয়ে থাকে। এই থিওরি যারা বিশ্বাস করে আমি নিশ্চিত তারা ইনভেস্ট সেক্টর সম্পর্কে একদমই জানেন না। একটা নরমাল বিজনেসে আপনি নিজে টাকা বিনিয়োগ করে নিজে খেটে ব্যবসা করে সব খরচ দিয়ে হয়ত বছর শেষে ১০%-৪০/৪৫% লাভ করা সম্ভব ব্যবসায়ের ধরন অনুযায়ী। ধরে নেই এভারেজে ২০%। এখন এই বিজনেসে যদি বাইরের কেউ বিনিয়গ করে মালিক তাকে কত পার্সেন্ট রিটার্ন দিবে বলে আপনার ধারনা? অবশ্যই সেটা বছর শেষে ২০% এর কম হবে।
এবার আসি বাংলাদেশে বসে যেসব ইনভেস্টমেন্টের সুযোগ আছে সেখানে কত পার্সেন্ট রিটার্ন দেয়। সবচেয়ে সেইফ রিটার্ন ব্যংক আর সরকারি সঞ্চয়পত্র ৬% আর ১১%! মানে আপনি আজকে এক লাখ টাকা জমা রাখলে ঠিক বছর পর দিয়ে সেটা এক লাখ ৬ হাজার ও এক লাখ ১১ হাজার হবে। আর যদি ৩ মাস পর টাকা তুলে ফেলেন? তাহলে দের হাজার আর আড়াই হাজারের মত কিছু রিটার্ন পাবেন! যদিও বাস্তবে আরো কম পাবেন টাকা আগে ভাগে তুলে ফেলার জন্য। ইভেন লোকাল এনজিও/মহজানেরাও সুদ যে চার্জ করে সেটা ২৪-৫০% পর্যন্ত। বাকি থাকে শেয়ার বাজার! এখানে কিছু ক্ষেত্রে অনেক বেশি রিটার্ন জেনারেট করা সম্ভব, কিছুক্ষেত্রে সব খুইয়ে পথেও বসে যেতে পারেন। আর ইভ্যালি যখন থেকে ব্যবসা করে তখন আমাদের শেয়ার মার্কেট একদম কলাপ্স অবস্থায় ছিল। পৃথিবীর কোন লিগ্যল ইনভেস্ট আপনাকে ১০-১৫% এর বেশি ইয়ারলি রিটার্ন দেয়া ক্ষমতা রাখে না, এমনকি এই ইউরোপ আমেরিকায়ও না। ওদের ইনভেস্টমেন্ট রিটার্ন আরো কম কারন ইনফ্লেশন রেট আমাদের চাইতে কম।
২। কালো টাকা সাদা করছেঃ আরেকটা পপুলার বিশ্বাস হচ্ছে ইভ্যালিকে ফ্রন্ট বানিয়ে বিশাল একটা গোষ্ঠির কালো টাকা সাদা করা হচ্ছে! আমার বিশ্বাস এই থিওরিও যারা বিশ্বাস করে তাদের বাস্তবে মালি লন্ডারিং প্রসিডিওর সম্পর্কে আইডিয়া খুব কম। আগে কয়েকটা প্রশ্নের উওর দিবেন। বাংলাদেশে ইভ্যালি আসার আগে কি মানি লন্ডারিং হয়নি? দেশ থেকে টাকা পাচার হয়নি? সবই হয়েছে। তাহলে এত বছর পরে কেনো ইভ্যালির মত প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন পরল? যারা অলমোস্ট ফ্রিতে পন্য বিক্রি করে বেরাচ্ছে? টাকা অবৈধ হোক বা বৈধ, ফ্রিতে কেউ দুনিয়ায় কাউকে কিছু দেয়না এটা বুঝতে হবে আপনাকে।
টাকা পাচারঃ দেশ থেকে টাকা পাচারের সবচেয়ে কমন মাধ্যম হচ্ছে লিগ্যাল এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট বিজনেস! এলসিতে পন্য মুল্যের ওভার ইনভয়েসিং/আন্ডার ইনভয়েসিং করে ,পন্য কম/বেশি এনে বা কখোনো পন্য না এনেই টাকা পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর আছে বিদেশী রেমিটেন্সের টাকা লিগ্যালি না এনে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়া। আর গোল্ড স্মাগলিং তো আছেই।
মানি লন্ডারিংঃএর জন্য ৩ টা স্টেপ ফলো করা হয়।
I. প্লেসমেন্টঃ অবৈধ টাকা দেশের লিগ্যাল কোন বিজনেসে ইঞ্জেক্ট করা বা ব্যাংকের মাধ্যমে ফরমাল ইকোনোমিতে প্লেস করা। (ধরে নেই এটা ইভ্যালি)
II. লেয়ারিংঃ অবৈধ টাকা লিগ্যাল বিজনেসে ইনভেস্ট করলেই সেটা লিগ্যাল হয়ে যায়না, বৈধ উৎস দেখাতে না পারলে সেটা অবৈধই থেকে যায়। এজন্য এই পর্যায়ে একই টাকা একের পর এক হাত বদল হতে থাকে যাতে একটা পর্যায়ে টাকার অবৈধ উৎস খুজে বের করা অলমোস্ট অসম্ভব হয়ে পরে। এই পর্যায়টা মানি লন্ডারিং এর সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট পার্ট। আপনি এমন কোন কাজ করতে পারবেন না যেটাতে সরকারি আইন শৃংখলা বাহিনীর কারো নজর কারে। সো ইভ্যালির মত শুধু একটা বিজনেস দিয়ে লেয়ারিং করা সম্ভব না। আর এত বড় ব্রান্ড ক্রিয়েট করলে সাভাবিকভাবেই সবার নজর এই দিকে থাকে। সেক্ষেত্রেও ইভ্যালি কোন সুইটেবল প্লেস না।
III. শেষ পার্ট ইণ্টিগ্রেশনঃ যে পর্যায়ে গেলে টাকার অবৈধ উৎস খুজে পাওয়া যাবে না সেই পর্যায়ে এসে টাকার মালিক সেই টাকা তুলে নিয়ে সে তার মত করে খরচ করবেন। আমাদের সরকার প্রায়ই কালো টাকা সাদা করার অপশন দেয়। গত দশ বছরে অন্তত ৬/৭ বার এই সুযোগ দেয়া হয়েছে। ২০-২১ বাজেটেও মাত্র ১০% ট্যাক্স দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে। তাহলে কেনো ইভ্যালি গ্রাহকদের ১০০% ডিসকাউন্ট দিয়ে কালো টাকা সাদা করতে যাবে??
৩। বিদেশী কোম্পানির কাছে বেচে দিবেঃ অনেকের ধারনা এত টাকা খরচ করে বিশাল কাস্টোমার বেজ তৈরি করে ইভ্যালি বিদেশী ইনভেস্টরদের কাছে বিক্রি করে দেবে। শুনতে আপনাদের যত সহজ লাগে, ফরেন মাল্টি মিলিয়ন ডলার ইনভেস্টমেন্ট এত সহজ কাজ না। আর যারা এসব করেন তারাও এলাকার লোকাল কোন ফার্ম না মনে চাইল কিছু না দেখেই ইনভেস্ট করে দিল। ইভ্যালি যদি সব হিসাব ঠিক মত রেখে থাকে, তাদের এক একজন কাস্টমার একুইজিশন খরচ যত পরে সেটাকে কভার করে সেই কাস্টমারের কাছ থেকে রেগুলার প্রডাক্ট বিক্রি করে লাভ বের করে আনা অন্তত পাচ দশ বছরের বেপার। সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট বেপার ইভ্যালির কাস্টমার মানেই ১০/২০% ডিসকাউন্টে পন্য কিনার কাস্টমার না, ৭০/৮০% বা ১০০% ডিস্কাউন্টে পন্য কিনার কাস্টোমার। তাদেরকে রেগুলার প্রাইসে পন্য কিনতে বললে কয়জন কিনবে সেটা একটা বিশাল ইস্যু! আমার কাছে এই থিওরিটারও কোন স্ট্রং বেইজ আছে বলে মনে হয়না। কেন না? এটা বুঝতে হলে আপনাকে বড় বড় মার্জার/একুইজিশন হিস্ট্রি ঘাটতে হবে তাদের প্রডাক্ট লাইন, মার্কেটিং, ফিনান্স ডাটা সহ।
এখানের প্রত্যেকটা পয়েন্ট ধরে ৫/১০ হাজার শব্দের রচনা লিখা সম্ভব! এখানে পপুলার পাব্লিক মিথ গুলো নিয়ে লিখলাম কেনো এগুলার একটাও ফিজিবল কোন কিছু মনে হয়নি আমার কাছে।
আমার ব্যাক্তিগত ধারনা বলি।
পনজি স্কিমের(Ponzi scheme) নাম শুনেছেন? বা হালের মাল্টি লেভেল মার্কেটিং! আমি নিজে মার্কেটিং গ্রাজুয়েট হলেও চার বছরে ভার্সিটিতে এমএলএম নিয়ে আমাদের কিছু পড়ায়নি! আমি জানিনা বাইরের দেশে কি পড়ায়! আপনারা অনেকেই বলতে পারেন ধুর এত কিছু বলে কি হবে আমি তো কম দামে গাড়ি বাড়ি এসি ফ্রিজ সব কিনে ফেলছি! অবশ্যই আপনি সহ আপনার পরিচিত অনেকেই ইভ্যালি থেকে পন্য কিনে লাভ করেছেন, কম দামে কিনে যে দাম পন্যের উৎপাদক কোম্পানি নিজেও দিতে পারেনা তার চাইতেও কম দামে আপনারা পন্য কিনে সেটা অনেকে আবার বিক্রি করেও ব্যবসা করেছেন। তারমানে এইনা এই বিজনেস মডেল সাস্টেইনেবল, অনন্ত কাল ধরে চলতে থাকবে। একটা পয়েন্টে গিয়ে শেষে যারা এসব বিজনেসে ইনভেস্ট করে তারা আর রিটার্নটা তুলতে পারবে না। পনজি স্কিম বা এমএলএম যাই বলেন এটার বিজনেস মডেলে সবার শেষ দিকে আসা কাস্টমারদের টাকা ফেরত দেয়ার ইচ্ছা বা সক্ষমতা কোনটাই কোম্পানির থাকেনা। মনে রাখবেন ডেস্টিনি/যুবক ১২ বছরের ও বেশি সময় ব্যবসা করেছে এই দেশে। অনেকে প্রচুর টাকা কামালেও এরচাইতে বেশি সংখ্যক লোক তাদের টাকা ফেরত পায়নি।
*ইভ্যালির অনুমোদিত মুলধন মাত্র ৫ লাখ টাকা, আর পরিশোধিত মুলধন মাত্র ৫০ হাজার টাকা! আর এক বছরে বিক্রয় টার্নওভার? এক হাজার কোটি! কত কত টাকার মুলধন নিয়ে কত টাকা টার্নওভার জেনারেট করা যায় সেটা অন্য কোম্পানির ডাটা দেখলেই বুঝতে পারবেন এই এমাউন্ট কতটা বিস্ময়কর!
(লেখাটির মূল লেখক: এম এইচ রিয়াদ)
১. ২৮ শে আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৩:১৭ ০
আপনি লেকজন নন? পড়ে বুঝতে পেরেছেন তো?