এই পড়ন্ত দুপুরে নানু উঠোনে নেড়ে দেয়া কাপড় তুলছিলেন। আমাদেরকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে আনন্দে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন। সারপ্রাইজ দেব বলে আগে থেকে আমাদের আসার খবর জানাইনি। জল চোখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন আম্মু আর আমাকে। সে জল একইসাথে আনন্দ এবং বেদনার।
প্রায় দু’বছর পরে এলাম এবার। আসলে আসার ইচ্ছে থাকে ঠিকই, সময় হয় না। আমার ইউনিভার্সিটি অফ থাকলে দেখা যায় ছোট ভাইয়ের তখন এক্সাম থাকে। ওর ছুটি তো আমার এক্সাম। আবার দুজনেরই ছুটি থাকে তো এতোদিন ঘাপটি মেরে বসে থাকা অন্য কোন ঝামেলা হামলে পরে! তাই এবার আর সবার ছুটির অপেক্ষা না করে টার্ম ফাইনাল শেষ করেই মা-মেয়ে দুজনে মিলেই চলে এলাম। ছোট ভাইটাকে নিয়েই আসতে চেয়েছিলাম। চার-পাঁচ দিন পড়া মিস গেলে এমন কিছুই হবে না, কিন্তু সে আসবে না। তার নাকি গ্রামে ভালো লাগে না! আসলে ব্যাপার অন্য। ফাঁকা বাসায় বন্ধুদের নিয়ে ধুমধাম পার্টি দেবে, ইচ্ছেমত মাস্তি করবে, এই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চায়নি!
অনেকদিন ধরেই নানু বারবার করে আসতে বলছিলেন। এই বয়সে ছেলে মেয়ে কাউকে পাশে পাচ্ছেন না, নিশ্চয়ই অনেক খারাপ লাগে। আম্মু আর খালামনি তো ঢাকায় যার যার নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত আর একমাত্র মামা ফ্যামিলি নিয়ে দেশের বাইরে প্রায় পাঁচ বছর ধরে। এবারের ঈদে দেশে আসবেন বলে আশা করা হচ্ছে, তাও শেষ পর্যন্ত আসতে পারবেন কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ গত ঈদেও মামার আসার কথা ছিল কিন্তু কি যেন ঝামেলায় আর আসতে পারেননি।
গোসল করে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলাম। পেটে ততক্ষণে ছুঁচো দৌড়াদৌড়ি করে করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে। কারণ আর কিছুই না, পথে লাঞ্চ করা হয়নি। আমাদের আসার খবর পেয়ে নানাভাইও উপজেলা থেকে চলে এসেছেন। আমরা খাচ্ছি আর নানাভাই রাজ্যের গল্প জুড়ে দিলেন। যেন এতদিনের সবকথা এই এক বিকেলেই বলে ফেলবেন! ননস্টপ কথা বলছেন। এতদিন পর মেয়ে আর নাতনীকে কে কাছে পেয়ে উৎফুল্ল। নানুও খাবার বেড়ে দিতে দিতে হাসিমুখে চোখের জল আড়াল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন!
সময় গড়িয়ে তখন বিকেলের শেষ প্রান্তে। সূর্যটা তখন পশ্চিমের সুপারি গাছের মাথায়। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম নানু বাড়ির বাঁধানো পুকুর ঘাটের সামনে। গোধূলিবেলার সেই অদ্ভুত আলোয় মনে হলো যেন নিঃশব্দ ইশারায় হাত বাড়িয়ে আমাকে কাছে ডাকছে দীঘির গভীর রহস্যময় সবুজাভ জল! সিঁড়িতে বসলাম জলে পা দুটো ডুবিয়ে। হঠাৎ করেই একটা অদ্ভুত ভাবনা মনে খেলে গেলো! মনে হল কিছুদিন পরেই হয়তো আজকের দিনের এই একই ঘটনা আবার ঘটবে এবং বারবার ঘটতেই থাকবে! শুধু স্থান কাল পাত্রের পরিবর্তন হবে। অনুভূতিগুলোও সেই একইরকম থাকবে। সেদিনের জীবনমঞ্চের সেই নাটকে নানুদের জায়গায় থাকবেন আমার বাবা-মা আর মায়ের জায়গায় আমি! এভাবেই হয়তো ছয়মাস কিংবা এক বছর-দু'বছর পরপর তাদের সাথে দেখা হবে আমার! সময়ের ব্যাবধানটা আসতে আসতে বাড়তে থাকবে। যাদের ছাড়া এখন একটা মুহূর্তও চলে না, সেই তাদের সাথেই তখন বছরে একবার দেখা করার সময়ও হবেনা আমার! ভাবনার সাথে মুহূর্তের জন্য যেন থমকে গেলো সময়, তার সাথে থমকে গেলাম আমি।
পুকুরে একটা ঢিল ছুঁড়তেই জলের মধ্যে আলোড়ন উঠলো। আবার আস্তে আস্তে মিলিয়েও গেলো। বুকের মধ্যেও তখন এক সমুদ্র আলোড়ন কিন্তু সেটা পুকুরের ঢেউয়ের মতো মিলিয়ে গেলো না, ধীরে ধীরে জমা হতে শুরু করলো চোখের কোণে...