এতোদিন পরে যা লিখছি তার বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে কোন অতিরণ্জন নাই। তবে এর সময়কাল এবং খুঁটিনাটি যিষয়ে স্মৃতি বিভ্রম থাকা অসম্ভব নয়। তার পরেও স্মৃতিশক্তর উপরে নির্ভর করে লিখছি কারণ এই যৎসামান্য ঘটনা বাংলাদেশের সামরিক ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ যার গুরুত্ব অপরিসীম একটি সদ্য স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনীর জন্য।
১৯৭৫ সাল। বংগবন্ধু নিহত হবার পরে জানব কাদের সিদ্দিকী বংগবন্ধুর হত্যার প্রতিশোধ নিতে ভারতে চলে যান। ভারতের সহায়তায় তিনি কাদেরিয়া বাহিনীকে পুনর্গঠিত করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। এতে সেনাবাহিনীর অনেকেই হতাহত হন।
১৯৭৫ সালের সম্ভবতঃ নভেম্বর মাসের শেষের দিকের ঘটনা। তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনা সদর দফতরে ডাইরেক্টর মিলিটারী অপারেশন ছিলেন কর্ণেল এম এ মালেক। কর্ণেল এম এ মালেক সিরাজগঞ্জের চরাঞ্চলে কাদেরিয়া বাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য সম্ভবতঃ ৪৩ লংকোর্সের ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে ইনফ্যান্ট্রি ও আর্টিলারি সমন্বয়ে গঠিত একটি কম্পোজিট ফোর্স প্রেরন করেন।
আমি তখন পাবনার রেসিডেন্সিয়াল মডেলে স্কুল যা বর্তমানে পাবনা ক্যাডেট কলেজ ক্যাম্প করে আমার কোম্পানি নিয়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে নিয়োজিত ছিলাম। এর পুর্বে বংগবন্ধু নিহত হবার সময় আমি রুপপুর ডাকবাংলোতে ক্যাম্প করে নর্থবেঙ্গলের দুর্ভিক্ষ মাকাবেলা করতে পাকশিতে ফুড মুভমেন্টের কাজ করছিলাম। আমাদের ১০ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তখন বগুড়াতে অস্হায়ী সদর দপ্তর স্হাপন করে অবস্হান করছিল। ১০ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন লেঃ কর্ণেল নওয়াজেশ আলী( চট্টগ্রামে জিয়া হত্যায় ফাঁসিতে নিহত )।
সময়টা ১৯৭৫ সালের সম্ভবতঃ নভেম্বর মাসের শেষদিক হবে। আমি ব্যাটালিয়ন সদর থেকে আদেশ পেলাম আমাকে সিরাজগঞ্জের চরাঞ্চলে ফোর্স নিয়ে যেতে হবে কাদেরিয়া বাহিনীর দ্বারা ঘেরাও হয়ে থাকা ক্যাপ্টেন মাহবুবের কম্পোজিট ফোর্সকে একটি সার্চ এন্ড রেস্ক্যু অপারেশনের মাধ্যমে উদ্ধার করার জন্য।
আমাকে আরো জানানো হলো ক্যাপ্টেন মাহবুব সম্ভবতঃ কাদেরিয়া বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন এবং তার ফোর্সের সবাই যে যার মতো ইউনিফর্ম খুলে চরের গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে।
এ্যায়ার ফোর্সের সম্ভবতঃ একটি এম আই - ৮ হেলিকপ্টার আসছে আমাকে এবং আমার ফোর্সকে গোলাবারুদসহ সিরাজগঞ্জে নিয়ে যাবার জন্য। নির্দেশ দেওয়া হলো আমি হেলিকপ্টারে করে সিরাজগঞ্জের সম্ভবতঃ সার্কিটহাউজ মাঠের হেলিপেডে নেমে ব্রহ্মপুত্র নদী পার হয়ে সিরাজগঞ্জের চরে গিয়ে এই অপারেশন করবো।
আমি তৈরী হলাম ফোর্স নিয়ে। অপারেশন এরিয়ার সামরিক ম্যাপের কোওর্ডিনেট আমাকে দেওয়া হলো যাতে আমার অপারেশন এলাকা চিহ্নিত করতে এবং যেতে কোনো অশুবিধা না হয়। আমি হেভি ওয়েপনের মধ্যে জিএফ ( গ্রেনেড ফায়ারিং ) রাইফেল, লাইট মেশিনগান এবং সম্ভবতঃ ৪০ এম এম রকেট লঞ্চার নিলাম। প্রত্যেক সৈনিকে এক্সট্রা এ্যামুনিশন ও এক্সট্রা গ্রেনেড দিলাম যাতে দীর্ঘ সময় অপারেশন পরিচালনা করতে পারি। সাথে যোগাযোগের জন্য ওয়ার্লেসসেট।
বেলা ১0/১১ টার দিকে হেলিকপ্টার এলে আমার নেতৃত্বে এক প্লাটুন ফোর্স নিয়ে যাত্রা করলাম। হেলিকপ্টার আকাশে উড়লো । আমাকে একটি চিন্তা আচ্ছন্ন করলো যেখানে একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে একটি কম্পোজিট ফোর্স ছিন্নভিন্ন শুধু হয়নাই ফোর্স কমান্ডর নিজে নিহত সেখানে আমার এই এক প্লাটুন ফোর্স কিভাবে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে আমি কাদেরিয়া বাহিনীকে যুদ্ধে পরাজিত করে হতভাগ্য সৈনিকদের উদ্ধার করবো!
আমি কেবলই ভাবছি আমাকে এমন কিছু করতে হবে যাতে আমি আমার এই সামান্য ফোর্স দিয়েই যেন শত্রু বাহিনীকে চরম ভাবে পরাজিত করতে পারি। তানাহলে আমাকেও ক্যাপ্টেন মাহবুবের ভাগ্য বরন করতে হবে এবং আমার ফোর্সের কেউ জীবন নিয়ে ফিরতে পারবেনা। কারণ কাদেরিয়া বাহিনী ঐ এলাকায় শুবিধাজনক অবস্হানে আছে।
সিরাজগঞ্জ শহর নজরে এলো। পাইলট হেলিকপ্টার নিয়ে নীচে হেলিপেডে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন । এমন সময় আমি এক চরম দুঃসাহসিক অভিনব সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলাম। আমি হেডফোনে পাইলটকে অপারেশন এলাকার ম্যাপ কোওর্ডিনেট দিয়ে বললাম আপনি সোজা অপারেশন এলাকায় চলে যান। ওখানে পরিস্থিতি দেখে আপনাকে আমি পরবর্তী নির্দেশ দিবো।
এটা শুনে পাইলট আমাকে বলল এটা সম্ভব নয়। কারণ অপারেশন এলাকায় কাদেরিয়া বাহিনী হেলিকপ্টারে গুলিকরে হেলিকপ্টার ভূপাতিত করলে তখন কিহবে? আমি বললাম তখন আপনি চেষ্টা করবেন গুলিবিদ্ধ হেলিকপ্টারকে কোনমতে সিরাজগঞ্জে নিয়ে আসতে। মরলে সবাই একসাথে মরবো। কিন্তু কেউ বলবেনা আমরা যুদ্ধে পরাজিত হয়েছি। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মরার চেয়ে হেলিকপ্টার ক্র্যাশকরে মরা অনেক ভালো।
যাইহোক অনেক বাকবিতন্ডার পরে হেলিকপ্টার সামনে এগুতে থাকলো। আমি অপারেশন এলাকা দেখতে পাচ্ছি। জনমানব শুন্য। হেলিকপ্টার একটি গ্রামের উপরে যখন হোভার করছে হঠাৎ দেখি কিছু লোক দৌড়ে উত্তর দাকে পালিয়ে যাচ্ছে। দেখলাম এরা কাদেরিয়া বাহিনীর লোক।
হঠাৎই হেলিকপ্টার তাদের মাথার উপরে দেখে হতচকিত হয়ে দিকবিদিক ছুটে পালাচ্ছে। কাদেরিয়া বাহিনীর লোকেরা চিন্তাও করতে পারেনি যে আমরা হেলিকপ্টারে করে তাদের মাথার উপরে যাবো। এমন দুঃসাহসিক পদক্ষেপ আমরা নেবো তারা ভাবেনাই । আমি সৈনিকদের প্রস্তুত হতে বললাম। পাইলটকে বললাম কাদেরিয়া বাহিনীর লোকদের চেজ করার জন্য যাতে আমরা তাদের হেলিকপ্টার থেকে গুলিকরে মারতে পারি।
কিন্তু পাইলট জানালো হেলিকপ্টারের ফুয়েল কমে গেছে এখনই ল্যান্ড না করলে আমরা হেলিকপ্টার নিয়ে সিরাজগঞ্জে ফিরতে পারবোনা রিফুয়েলিং এর জন্য । আমার আফসোস হচ্ছিল হেলিকপ্টারে জ্বালানি থাকলে আমরা কাদেরিয়া বাহিনীর সবকটাকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারতাম।
হেলিকপ্টার ল্যান্ড করলে আমরা হেলিকপ্টার থেকে ডিসমাউন্ট করে দ্রুত ফায়ার এন্ড মুভ করে সামনে এগুতে থাকলাম। যতদূর পারলাম আমরা কাদেরিয়া বাহিনীর পিছু ধাওয়া করে ঐ এলাকা কাদেরিয়া বাহিনী শুন্য করে ফেললাম। বিকেল ৪ টার মধ্যে আমরা এদিক ওদিকে আত্ম গোপনে থাকা জেসিও এবং সৈনিকদের গ্রামের জনগনের সাহায্যে উদ্ধার করি। অনেক খো়ঁজাখুঁজি করেও আমরা ক্যাপ্টেন মাহবুবের লাশ উদ্ধার করতে পারেনি। গ্রামবাসীদেরও কেউ তার লাশের কোনো হদিস দিতে পারে নাই।
পরে হেলিকপ্টারে গাদাগাদি করে সিরাজগঞ্জে এসে হেলিকপ্টার থেকে নেমে রিফুয়েলিং করে আমার প্লাটুনের সৈনিকদের বাইরোডে পাবনা পাঠিয়ে দিয়ে উদ্ধারকৃত জিসিও এবং সৈনিকদের নিয়ে হেলিকপ্টারে সম্ভবতঃ রাজশাহী চলে আসি ব্যটালিয়নের স্হায়ী লোকেশনে। পরে আহত সৈনিকদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যাবস্হা করা হয়। এই অপারেশনে আমার প্লাটুনের কোনো ক্ষয় ক্ষতি হয়নি। কেবল কিছু গোলাবারুদ খরচ হয়েছিল মাত্র।
জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান
লাল গোল চিহ্নিত এলাকাটি সম্ভবত অপারেশন এরিয়া ছিল।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:২৫