বর্তমান মিশরের পিরামিড কেন্দ্রিক যে অঞ্চল, তার পুরোটাই মরুভূমি। একটা সময়, প্রাচীন মিশরে এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে একটি বৃহৎ সভ্যতা। এই অঞ্চলের লোকদের স্থাপত্যশিল্প, রন্ধনশিল্প, জ্যোতিষশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে পারদর্শিতার জন্য জগৎজোড়া খ্যাতি ছিলো।
এটি আজকের কথা নয়। আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগেকার কথা। প্রাচীন মিশরে তখন 'ফারাও' (ফেরাঊন) গোষ্ঠীর রাজত্ব।
ইতিহাসবিদরা সকলে একমত যে- বর্তমানে আমরা যে পিরামিড দেখি, তা প্রাচীন মিশরের প্রাচীন সভ্যতার প্রাচীন শাসক ফারাওদের হাতেই নির্মিত....
শুধু পিরামিডই নয়, প্রাচীন এই সভ্যতার জনগোষ্ঠীর হাতে নির্মিত হয়েছে আরো বহু স্থাপত্যশিল্প যার অনেককিছু সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে।
আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে নির্মিত পিরামিডের স্থাপত্যশৈলী দেখলে বর্তমান দুনিয়ার সু-উন্নত টেকনোলোজিকে আপনার নেহাৎ 'শিশু' মনে হবে। তাহলে চিন্তা করুন ৫০০০ বছর আগে তারা আমাদের চেয়ে কতোটা এগিয়ে ছিলো।
প্রত্নতত্ত্ববিদরা (Archaeologist) বিশ্বাস করতেন, এই যে, পিরামিডের মতো এসব চোখ ধাঁধানো স্থাপত্যশিল্প, এসব মরুভূমির বালুর বুকেই নির্মিত হওয়া। অর্থাৎ, তাদের ধারণা ছিলো, বর্তমান মিশরের পিরামিড অঞ্চলকে আমরা যেরকম দেখছি (মরূভূমির উপরে), আজ থেকে ৫০০০ বছর আগে নির্মিত হওয়ার সময়টাতেও (অর্থাৎ, ফেরাঊনদের সময়টাতে) এই পরিবেশ ঠিক এরকমই ছিলো। অর্থাৎ, এখন যেমন আমরা মরুভূমি দেখছি, তখনও এরকম মরুভূমিই ছিলো এই অঞ্চল।
কিন্তু প্রত্নতত্ত্ববিদদের খুব সাম্প্রতিক গবেষণা তাদের সুদীর্ঘকালের বিশ্বাসে জল ঢেলে দিলো।
সাম্প্রতিক গবেষণা মতে, আজকের মিশরের পিরামিড অঞ্চলকে আমরা যেরকম মরুভূমিময় দেখছি, প্রাচীনকালে এই অঞ্চল এমন ছিলো না।
অর্থাৎ, আজ থেকে ৫০০০ বছর আগে যখন পিরামিডের মতো এসব স্থাপত্যশিল্প নির্মিত হচ্ছিলো, তখন সে অঞ্চল মরুভূমি, বালুময় ছিলো না।
তাহলে কেমন ছিলো তখন এসব অঞ্চল?
ব্রিটিশ পত্রিকা 'ডেইলি মেইল' ২০১২ সালে 'Climate change wiped out one of the world's first, great civilisations more than 4,000 years ago' নামে একটি সংবাদ কাভার করে। সেখানে প্রত্নতত্ত্ববিদরা তাদের গবেষণার ফসল হিসেবে জানিয়েছেন- আজ থেকে ৪৫০০-৫০০০ বছর আগে মিশরের এই অঞ্চলগুলো ছিলো সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা। এখানে নদী ছিলো, ঝর্ণা ছিলো, পাহাড় ছিলো। এই নদী,পাহাড়, ঝর্ণার পাশেই গড়ে উঠেছে তখনকার সেই সভ্যতা।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রত্নতত্ত্ববিদ, প্রফেসর Michael Petragliaof বলেছেন,- ''that beneath these sands, there’s an enormous network of rivers which once fed the Egyptian civilization and which enabled the pharaohs to establish a great kingdom almost five thousand years ago''
অর্থাৎ, তারা এই মরুভূমির বালুকণা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, স্যাটেলাইট ডাটার মাধ্যমে দেখেছেন যে, এইসব অঞ্চলে একসময় নদীর অস্তিত্ব ছিলো, এবং এই নদীগুলো ফারাওদের তাদের রাজত্ব নির্মাণে সহায়তা করেছে।
তাহলে এইসব নদী, পাহাড়, ঝর্ণা সহ এরকম সবুজাভ প্রকৃতি কোথায় মিলিয়ে গেলো? কেনোই বা সেখানে এখন দৃষ্টির দূরতম সীমানা পর্যন্ত শুধু মরুভূমির বালুকণা?
প্রত্নতত্ত্ববিদরা বলেছেন- এর কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন।
অর্থাৎ, জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের সাথে সাথে একসময়কার এরকম সবুজাভ প্রকৃতি মিলিয়ে গিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে।
ফারাও, তাদের রাজত্ব এবং তাদের সভ্যতা নিয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ তাদের ধারণা পাল্টেছেন।
তারা উপসংহারে এসেছেন যে- এখন যে মরুভূমিময় অঞ্চল আমরা দেখছি, একটা সময় এটি এরকম ছিলো না। ৫০০০ বছর আগে এটি একটি সবুজাভ সভ্যতা ছিলো।সেখানে ছিলো প্রাণের উৎস। ছিলো পাখ-পাখালির কোলাহল।
ফারাওদের(ফেরাঊনদের) ঘটনা আমরা পবিত্র আল কোরআনেও দেখতে পাই।
আল্লাহ তা'লা ফেরাঊনের ঘটনা বর্ণনা করেছেন কোরআনের বেশকিছু জায়গায়।
কয়েকটি জায়গায় আছে-
“And Pharaoh proclaimed among his people, saying: "O my people! does not the dominion of Egypt belong to me, (witness) these streams flowing underneath my (palace)? What! See ye not then?”
[ “ফেরাউন তার সম্প্রদায়ের মাঝে ঘোষণা দিল। বলল- হে আমার সম্প্রদায়! মিসরের রাজত্ব কী আমার নয়? আর এ সব নদনদী (যা আমার প্রাসাদের) নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে, তোমরা কি তা দেখ না? ” - সূরা যুখরুফ, ৫১]
এই আয়াতে প্রাচীন মিশরের ফারাওদের রাজত্বকালে তাদের অঞ্চলের আশপাশে নদ-নদীর যে অস্তিত্ব ছিলো, তার একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।
এতোদিন ধরে মনে করা হতো, ৫০০০ বছর আগ থেকেই তাদের অঞ্চল আজকের মতো মরুভূমিময় ছিলো। কিন্তু কোরআন সেই সময়কার ঘটনা উল্লেখ করতে গিয়ে তাদের অঞ্চলে নদ-নদীর অস্তিত্বের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ফেরাঊনের ঘটনা বলতে গিয়ে আরেকটি জায়গায় বলা হচ্ছে-
“And we removed them from gardens & springs” - Ash-Shuara 57
অর্থাৎ- [ “এবং আমি তাদেরকে বিতাড়িত করলাম উদ্যানরাজি এবং ঝর্ণাসমূহ থেকে ”]
এখানেও ফেরাঊনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তার সময়কার উদ্যান (যা মরুভূমিতে অসম্ভব) এবং ঝর্ণারাজির কথা বলছে।
আরো একটি আয়াতে বলা হচ্ছে-
“How many were the gardens and springs they left behind, And corn-fields and noble buildings,”- Dukhan 25-26
“ [ তারা পশ্চাতে রেখে গিয়েছিলো কতো উদ্যান এবং ঝর্ণাধারা। কতো শস্যক্ষেত এবং অভিজাত অট্টালিকা ”]
এই আয়াতেও, ফেরাঊন (ফারাওদের) এবং তাদের শেষ পরিণতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে এমন কিছু (উদ্যান, ঝর্ণাধারা, শস্যক্ষেত এবং অভিজাত অট্টালিকা) ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা প্রত্নতত্ত্ববিদরা আমাদের নিশ্চিত করেছেন কেবল সেদিন।
প্রত্নতত্ত্ববিদরা এতোদিন ভাবতেন যে- প্রাচীন ফারাওদের রাজত্ব ছিলো মরুভূমিতেই। এই সভ্যতা টিকেই ছিলো মরুভূমির উপরে।কিন্তু মাত্র সেদিন তারা জানালেন যে- তারা এতোদিন যা ধারণা করেছে, তা ভুল। প্রাচীন ফারাওরা কখনোই মরুভূমির লোক ছিলো না। তারা শস্য-শ্যামল, সবুজাভ প্রকৃতির মধ্যে বাস করতো। তাদের অভিজাত অট্টালিকা (পিরামিড, ইত্যাদি....) মরুভূমিতে নির্মিত হয়নি। তা হয়েছে নদীর পাড়ে, নদীর অববাহিকায়....
ঠিক একই তথ্যগুলো, একই চিত্রপট আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দ শ বছর আগে আল কোরআন আমাদের জানাচ্ছে, আলহামদুলিল্লাহ্।
এই যে এই ব্যাপারগুলো, এই নিদর্শনগুলো অবিশ্বাসীদের দেখানোর জন্য লিখি না।
এগুলো লিখি নিজেদের জন্য। কোরআন নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে। কারণ, আল্লাহ কোরআন নিয়ে ভাবতে বলেছেন।
'নিদর্শনের সন্ধানে'/ আরিফ আজাদ
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ২:০৬