ফ্রানৎজ ব্রেনতানোর (১৮১৩ – ১৯১৭) ‘প্রত্যক্ষ বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মনোবিদ্যা (Psychology from an Empirical Standpoint) বইটি নানান কারনে চিন্তার ইতিহাসে -- বিশেষত মনোবিদ্যা ও দর্শনে -- ধ্রুপদী কাজ হিসাবে স্বীকৃত। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারনের মধ্যে একটি হচ্ছে বইটি একজন গণিতের ছাত্রকে দর্শনে আগ্রহী করে তুলেছিল। এই তরুণের নাম এডমুন্ড হুসার্ল। এই আগ্রহ ঘটেছিল বলেই এডমুন্ড হুসার্ল বিষয়বিদ্যার গোড়ার কাজগুলো করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি দর্শনের জগতে বিষয়বিদ্যার প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে খ্যাত।
ব্রেনতানোর পড়াবার ধরণ তরুণদের দারুন অনুপ্রাণিত করতে পারত। বিশেষত তিনি নতুন নতুন প্রশ্ন তুলতে পারতেন, আর সেই প্রশ্নগুলো ছাত্রদের ভাবতে বাধ্য করত। চিন্তা চর্চার জন্য সওইয়াল-জবাবের কায়দা সাধারণত খুব ফলপ্রসূ হয়। এডমুন্ড হুসার্লও ব্রেনতানোর বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়েই দর্শন আগ্রহী হয়েছিলেন। মার্টিন হেইডেগার জানিয়েছেন গণিত ছাড়া এডমুন্ড দর্শনের কিছুই এর আগে পড়েন নি। হয়তো রাস্তায় দর্শন সম্পর্কে ছুটকা কিছু বই বা দর্শনের অধ্যাপকদের লেকাহ কিছ্য পাঠ্য রচনা হাতে নেড়েচেড়ে দেখেছেন। কিন্তু দর্শন পাঠ বলতে যা বোঝায় ব্রেনতানোর বক্তৃতা শুনবার আগে এডমুন্ড হুসার্ল তার ধারেকাছেও ছিলেন না।
এডমুন্ডের জন্ম হয়েছিল ইহুদি পরিবারে, কিন্তু ১৮৮৬ সালের দিকে তিনি মার্টিন লুথারের প্রবর্তিত লুথেরীয় খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। বিখ্যাত গণিতবিদ কার্ল ভিয়েরস্ত্রাস (১৮১৫ – ১৮৯৭) আর লিও কনিগস্বার্গারের ( ১৮৩৭ – ১৯২১) কাছে তিনি গণিত পড়েন। এডমুন্ড স্কুলের পাঠ সাঙ্গ করে লেইপজিগ, বার্লিন আর ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে ডিগ্রি নেন ১৮৮২ সালে। এর পরের বছরেই ১৮৮৩ সালে ভক্ত হয়ে পড়েন ব্রেনতানোর।
সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। এর আগেও আমরা আলোচনা করেছি যে এটা এমন একটা সময় যখন প্রকৃতি বিজ্ঞানের দাপট বিপুল, আর দর্শন বিজ্ঞানের দাপটের মুখে ম্রিয়মান হয়ে পড়ছে। দর্শনের ম্লান মুখটা আমরা কিছুটা আন্দাজ করতে পারব যদি অনুমান করি সেই সময়ে নিশ্চয়ই প্রশ্ন উঠেছিল বিজ্ঞান যদি জগতের সত্য নির্ণয়ের একমাত্র পথ হয়ে ওঠে তাহলে দর্শনের আর কী দরকার? কথাটা অন্য ভাবেও বলা যায়: প্রত্যক্ষ জ্ঞানই যদি সত্য নির্ণয়ের একমাত্র পথ হয় তাহলে শুধু দর্শন কেন, ধর্মেরও বা আর প্রয়োজন কি ? বিজ্ঞানই তো আমাদের জীবনের সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম। এই প্রশ্ন আমরা একালেও শুনি। দর্শনের জন্য এ ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। একই ভাবে ধর্মের জন্যও। আমরা এখন দর্শনের নতুন রমরমার যুগে ব্যাপারটা সহজে উপলব্ধি করতে পারব না। এটাও অনেকে বুঝতে পারেন না বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের যেখানে জয়জয়কার সেখানে ধর্ম ফিরে আসছে কেন? গলদটা কোথায়? একে কি শুধু আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? বলা হয়ে থাকে, মানুষ গরিব আর নিপীড়িত বলে ধর্মে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সমাজ দিয়ে ধর্মকে ব্যাখ্যা আংশিক সত্য হতে পারে, কিন্তু ‘বিষয়’ হিসাবে ধর্মকে চিন্তার জায়গা থেকে ব্যাখ্যা করার তাগিদ এতে ফুরিয়ে যায় না। ধর্মের আর্থ-সামাজিক ব্যাখ্যা বা অর্থনীতিবাদী উত্তর চিন্তার দিক থেকে আর্থ-সামাজিক ব্যখ্যা হিসাবে গ্রহণযোগ্য, কিন্তু দার্শনিক ব্যাখ্যা হিসাবে নয় । ধর্ম চিন্তারই একটি ধরণ, চিন্তার মধ্যে চিন্তারই একটি বিষয় হয়ে হাজির হয়। চিন্তার মধ্যেই ধর্মের প্রত্যাবর্তনের উত্তর খোঁজা দরকার আছে। খোঁজার দরকার আছে এখন ধর্মের যে উত্থান সেটা কি আদৌ প্রত্যাবর্তন, নাকি আমরা নতুন কোন বিষয়ের মোকাবিলা করছি। এক সময় প্রকৃতি বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে ধর্মের নিরর্থকতা প্রমাণে কাজ হয়েছে, এখন হচ্ছে না। হবেও না। কারণ প্রকৃতি বিজ্ঞান তার নিজের ভিত্তি কিম্বা তার সংকট নিয়ে যখন পর্যালোচনা করতে চাইছে তখন তাকে দর্শনেরই দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও দর্শন উভয়ের চর্চাই দুর্বল বলে দর্শনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্নের গুরুত্ব আমরা তাড়াতাড়ি ধরতে পারবো না। প্রকৃতিবিজ্ঞান মানুষের চিন্তা থেকে উদ্ভূত সকল প্রশ্নের সমাধান দিতে সক্ষম নয়। এমনকি তার নিজের ভিত্তি সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারণা লাভ করতে হলে নিজের পরিমণ্ডল থেকে বাইরে এসে চিন্তা কিভাবে চিন্তা করে বা চিন্তার মধ্যে কিভাবে বিভিন্ন বিষয়ের উদয় ঘটে সেই প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হয়। করতে হয় প্রকৃতি বিজ্ঞানের অভিজ্ঞতা থেকে চিন্তার যে নতুন শৃংখলার উন্মেষ ঘটছে সেই বৈজ্ঞানিকতাকে আত্মস্থ করে। অর্থাৎ চিন্তার নিজেকে নিজে মোকাবিলার, নিজেকে নিজে বিচারের ক্ষমতা অর্জনের ডাক পড়ে। সেই ডাক বিজ্ঞানের বিজ্ঞান হবার ডাক। একালের দর্শন অর্থাৎ বিষয়বিদ্যারই ডাক।
ব্রেনতানোর প্রভাবে হুসার্ল উপলব্ধি করতে থাকেন গণিত তাঁর আগ্রহের বিষয় নয়, তাঁর আকুতি দর্শন। গুরু-শিষ্য হিসাবে দুই জনের সম্পর্ক ভাল ছিল বলা যাবে না। গণিতে হুসার্ল ছিলেন সিদ্ধ, কিন্তু হুসার্লের প্রভাবে তাঁর দর্শন ভাবনায় যে আলোড়ন তুলছিল তাতে তিনি অনেক নতুন নতুন চিন্তা বা অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে গুরুর কাছে এলেও গুরু তাকে খুব একটা পাত্তা দিতেন না। হুসার্লের জীবনীকাররা জানিয়েছেন, তরুণ হুসার্ল খুব সংবেদনশীল ছিলেন। ফলে গুরুর অবজ্ঞা তাঁকে প্রায়ই হতাশ করে তুলতো।
যেসব ছাত্ররা ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের উচ্চতর পড়াশুনা শেষ করে আরও পেশাদারি শিক্ষা চালিয়ে যেতে চাইতো তাদের জন্য একটি নিয়ম ছিল যে যাঁর কাছে পড়ছে তিনি ছাড়াও অন্য কারো কাছে গিয়ে কোন বিশেষ বিষয়ে গবেষণাপত্র তৈরী করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শৃংখলার মধ্যে থেকেই সেটা করতে হোত। ব্রেনতানো হুসার্লকে পড়তে পাঠালেন কার্ল স্তাম্ফের (১৮৪৮ – ১৯৩৬) কাছে। স্তাম্ফের সঙ্গে হুসার্লের বনিবনা হোল ভালো। গণিতের সংখ্যা নিয়ে হুসার্ল কাজ করলেন। কাজের ফল হিসাবে হুসার্লের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক বই ‘পার্টিগণিতের দর্শন’ (Philosophy of Arithmetic) প্রকাশিত হোল ১৮৯১ সালে। এই তরুণ বয়সেও হুসার্ল স্বপ্ন দেখতেন তিনি দর্শন নিয়ে যে কাজ করবেন তাতে দর্শনের আদলই বদলে যাবে। তার আগের সব দর্শনই পুরানা চিন্তার নমুনা হয়ে উঠবে। আর, আসলে, ঘটেছিলও তাই।
১৮৮৭ থেকে ১৯০১ সাল অবধি এডমুন্ড হাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করলেন। শিক্ষকতার এই কালটা তার নিজের সঙ্গে লড়াইয়ে কাটল। কারণ প্রায়ই হতাশ হয়ে দর্শন চর্চা ছেড়ে দেবার কথা ভাবতেন। কিন্তু ভাগ্য ভালো, ছাড়েন নি। এই ভাবাভাবির মধ্যেই ১৯০০ – ১৯০১-এর দিকে তিনি বোমা ফাটিয়ে দিলেন। দুই খণ্ডে প্রকাশিত হোল তাঁর বিখ্যাত বই ‘চিন্তাশীল অধ্যয়ন’ (Logical Investigation)। দ্বিতীয় সংস্করণ বেরুলো ১৯১৩ আরে ১৯২১ সালে। সম্প্রতিকালের ইতিহাসে এই বইটি দর্শনের মাথা থেকে পা অবধি বড়সড় ঝাঁকুনি দিয়েছে, সেই দিক থেকে এই বইয়ের প্রকাশ যুগান্তকারী। হুসার্ল বিষয়বিদ্যার দিক থেকে দর্শনের ঠিক কোথায় নজর নিক্ষেপ করতে হবে সেই দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করতে পেরেছিলেন। তাঁর এই গোড়ার কাজের কারনেই মার্টিন হেইডেগারের আবির্ভাব অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। তরুণ হেইডেগারের চিন্তা গড়ে উঠবার ক্ষেত্রে এই বইটির প্রভাব অনস্বীকার্য। আর এই বইয়ের পর থেকেই দর্শন ফেনমেনলজি বা বিষয়বিদ্যা হিসাবে নিজের স্বরূপ দাবি করে আত্মপ্রকাশ ঘটাতে শুরু করল। এর আগে আমরা বলেছি হেগেলও দর্শনের পরিভাষা হিসাবে ‘ফেনমেনলজি’ কথাটা ব্যবহার করেছেন, কিন্তু তাঁর ব্যবহার হুসার্ল ও পরবর্তীকালে গড়ে ওঠা ‘বিষয়বিদ্যা’র ধারণা থেকে আলাদা।
বিখ্যাত গণিতবিদ গত্তলিয়েব ফ্রেগে (১৮৪৮ – ১৯২৫) হুসার্লের ‘পার্টিগণিতের দর্শন’ (১৮৯১) বইটির সমালোচনা করেছিলেন। অনেকের দাবি, ‘চিন্তার অন্বেষণ’ ফ্রেগের সমালোচনার দ্বারা তোড়ে লিখিত এবং সেই দিক থেকে প্রভাবিত। ফ্রেগের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে তোলা আপত্তিরই জবাব হিসাবে ‘চিন্তাশীল অধ্যয়ন’ বইটি হুসার্ল লিখেছেন।
‘চিন্তাশীল অধ্যয়ন’-এর প্রথম খণ্ড মানুষের চিন্তাকে মনস্তত্ত্ব মার্কা ধারণা দিয়ে বিশ্লেষণ ও বোঝার সমালোচনা। ইংরেজিতে একে বলা হয় ‘সাইকোলজিজম’ (pasychologism)। এই পদ্ধতির অনুমান হচ্ছে আমাদের যুক্তি তর্ক বিচার বা যা কিছুকেই আমরা চিন্তা বলি তাকে মনস্তত্ত্ব বা হুসার্লের সময়ের মনোবিদ্যার ধ্যানধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। মনস্তত্ত্ব দিয়ে চিন্তাকে ব্যাখ্যা করবার রেওয়াজ সেই সময় বেশ জনপ্রিয় ছিল। বইয়ের বাকি অংশের মধ্যে রয়েছে প্রথমে ভাষা বা মানুষের ভাষা ছাড়াও অন্যান্য চিহ্নব্যবস্থা সম্পর্কে হুসার্লের গবেষণা। হুসার্ল ভাষা ও ভাষা ছাড়া চিহ্নব্যবস্থার যে বিশ্লেষণ হাজির করেছিলেন তার পর্যালোচনার মধ্য দিয়েই জাক দেরিদার আবির্ভাব ঘটে। দেরিদার চিন্তাশীলতার চর্চা ‘অবিনির্মাণ’ (Deconstruction) নামে খ্যাত। গোড়ায় যখন সেটা হাজির হয় তখন তার প্রথম শক্তিশালী প্রদর্শন ঘটে হুসার্লের ‘চিন্তার অধ্যয়ন’ বইয়ের পর্যালোচনা করে। দেরিদার রচনাটির নাম, ‘বলা ও বিষয়: এবং হুসার্লের চিহ্নতত্ত্ব সম্বন্ধে অপরাপর রচনা’ (১৯৬৭)।
এরপর হুসার্লের বইতে রয়েছে সমগ্র ও অংশ বলতে আমাদের সাধারণ বোঝাবুঝির বিচার। তবে বিষয়বিদ্যার দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে হুসার্লের মনোবৃত্তি (intentionality) নিয়ে গবেষণা। আমরা এর আগে বলেছিলাম ইনটেনশানকে আমরা বাংলায় আক্ষরিক অর্থে ইচ্ছা বা অভিপ্রায় বুঝে থাকলেও হুসার্ল সেই অর্থে ব্যবহার করেন নি। আসলে চিন্তা কিভাবে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তা করে সেই বৃত্তির কথাই বলা হচ্ছে। এর অনুবাদ হতে পারে চিন্তাবৃত্তি। কিন্তু ব্রেনতানোর মনোবিদ্যা সংক্রান্ত চিন্তাভাবনার পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে যেহেতু ধারণাটির উদ্ভব সেই ইতিহাসের চিহ্ন ধরে রাখার জন্য আমরা ইনটেনশানালিটির অনুবাদ করেছি মনোবৃত্তি।
সংক্ষেপে দুজন কিভাবে মনোবৃত্তিকে দুভাবে ব্যাখ্যা করেছেন সেটা খানিক ধরিয়ে দেওয়া যাক। ব্রেনতানোর কাছে মনোবৃত্তি হচ্ছে সবসময়ই মনের সামনে কিছু না কিছুকে রেপ্রেজেন্ট বা হাজির করা। মনের সামনে যে কোন বিষয়ের উপস্থিতিই ব্রেনতানোর কাছে মনোবৃত্তি। হুসার্ল ধারণাটিকে আরও মজবুত করারা জন্য বললেন, বিষয়কে মন নিজের কাছে শুধু যে হাজির করে তা না, একই সঙ্গে বিষয়কে একপ্রকার নৈর্ব্যক্তিকতাও দান করে। অর্থাৎ মনোবৃত্তি নৈর্ব্যক্তিকতা দানকারী ক্রিয়া (objectifying act)।
নৈর্ব্যক্তিকতা দান করবার কাজটা কেমন? কোন কিছু মন বা চিন্তার মধ্যে বিরাজ করলেও তারা যে ‘আছে’ সেই নিশ্চয়তাটুকুও মন বা চিন্তা দান করে। আমরা যখন কোন কিছু ভাবি তখন ভাবনার বিষয় সম্পর্কে নানান ধারণা ও প্রত্যয় গড়ে তুলি। বিষয় তখন তত্ত্বগত রূপ অর্জন করে। গাছের ভাবনা গাছের ধারণা বা গাছের তত্ত্ব, বইয়ের ভাবনা বইয়ের তত্ত্ব, পাহাড়, নদি সমুদ্র ইত্যাদের ধারণা তাদের তত্ত্ব – ইত্যাদি। হুসার্ল এখানে থামেন নি। তিনি বলছেন, বিষয় সম্পর্কে তত্ত্বগত সচেতনতাই কেবল নৈর্ব্যক্তিকতা দানের কাজ নয়। এমন অনেক কিছুই আমরা ভাবি যাদের তত্ত্বগত রূপ দাঁড় করা্তে হবে এমন কোন কথা নাই। যেমন আমাদের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, কামনা বাসনা রাগ অভিমান ভয় ভীতি ইত্যাদি। সেইসব কখনো স্পষ্ট আবার কখনও অস্পষ্টও হতে পারে। বিষয় হিসাবে মনে যখন এইসবের উদয় ঘটে তখনও তাকে আমরা নৈর্ব্যক্তিকতা দান করি। সব কিছুকেই হুসার্ল মনের সচেতন নৈর্ব্যক্তিকতা দানকারী ক্রিয়া বা মনের সচেতন তত্ত্বগত নিরীক্ষণের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করেছেন। আর, একই সঙ্গে দেখিয়েছেন মনের মধ্যে বা চিন্তায় কোন বিষয়ের উপস্থিতি কখনই পুরাপুরি বা সমগ্র নয়। আমরা গাছ নিয়ে যখন ভাবি তখন গাছের বিশেষ কিছু দিক নিয়ে ভাবি, গাছের অন্য আরও অনেক দিক এই ভাবাভাবির অন্তর্ভুক্ত নাও থাকতে পারে। সেইদিকগুলো সংগুপ্ত বা লুকানো থেকে যাতে পারে, কিন্তু গাছকে আমাদের নানানভাবে উপলব্ধি, গাছের অভিজ্ঞত ও গাছ নিয়ে ভাবনা, দূরে কাছে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন দিক থেকে গাছকে দেখা ইত্যাদি সবই বিষয় হিসাবে ‘গাছ’ বা বিষয়ের একটা চিহ্ন বা দাগ হয়েই মনে বা চিন্তায় হাজির থাকে। সেই দাগ ধরে আমরা অনুপস্থিত অন্য দিকগুলোকেও যেমন হাজির করতে পারি, নতুন উপলব্ধি, অভিজ্ঞতা বা ভাবনাও তার সঙ্গে যোগ করতে পারি। চিহ্নের সবটাই আমাদের মনে ধরা পড়ে তা নয়। ধরা পড়লেও মনে যখন সেই চিহ্ন বিষয় হয়ে উদয় হয়, তখন সবটা নিয়ে আমরা ভাবি না। ভাবি ততোটুকুই যতোটুকু চিন্তা সেইসময় বিষয় হিসাবে নিজের সামনে হাজির করে।
বিষয় কিভাবে মনে উদয় হয় বা কিভাবে চিন্তা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তা করে সেই দিকে ব্রেনতানো আর হুসার্লের দর্শনকে ধাবিত করবার পথ ধরে হেইডেগার এই চিন্তাগুলোকেই আরও পরিচ্ছন্ন করে তোলেন। মনোবৃত্তির ধারণাকে আরও সাফ করে হেইডেগার তাকে নানান অবস্থার ব্যাখ্যা করবার কাজে সহজে এগিয়ে যেতে পেরেছেন। এই পথ ধরে হেইডেগার যে মৌলিক কাজটা করেছেন সেটা হোল সম্ভবত হাতিয়ারের ধারণা। চিন্তার ‘বিষয়’ -- যাকে চিন্তা নৈর্ব্যক্তিকতা দান করে -- তাকে চিন্তা নিজে আবার চিন্তার হাতিয়ার হিসাবেও ব্যবহার করে। কথাটা যতো সরল ভাবে বললাম অতো সরল নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু এতোটুকু যদি আমরা অনুমান বা আন্দাজ করতে পারি তাহলে পাশ্চাতের দর্শনের জগতে মৌলিক বাঁকগুলো কোথায় ঘটেছে তা কিছুটা হদিস করতে পারা যাবে। আশা করি।
‘চিন্তার অধ্যয়ন’ বইটি বেরুবার পরপরই স্বীকৃতি পেয়েছিল সেটা দাবি করা যাবে না। যে কোন মৌলিক রচনার মতোই মানুষের বুঝতে সময় লেগেছিল। তবে গণিতজ্ঞ ডেভিড হিলবার্ট (১৮৬২ – ১৯৪৩) বইটি বেরুবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হুসার্লের কাজের তাৎপর্য বুঝেছিলেন। হিলবার্ট তখন গটিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত পড়াচ্ছেন। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে হুসার্লকে সহকারী অধ্যাপকের দায়িত্ব দেবার সুপারিশ করলেন তিনি, হুসার্ল রাজি হয়ে এই দায়িত্বটি নিলেন। সেটা ১৯০১ সালের ঘটনা। গটিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টাই হুসার্লের জীবনে আনন্দদায়ক পর্ব। পাশ্চাত্যে দর্শনের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এলেন তিনি এবং এবং এমন একটি জার্নাল সম্পাদনা শুরু করলেন যার বিষয় তাঁর নিজেরই চিন্তা ও গবেষণা।
হুসার্ল তরুণদের কথা শুনতেন, এটা তাঁর বড় গুণ। এমনকি তাঁর সমালোচনাও করতে দিতেন তিনি। অন্যের কথা শোনার আন্তরিকতাও ছিল তাঁর। তাঁর নিজের লেখার বিপুল পরিমার্জনাও করেছেন তিনি শেষের দিকে। এই পরিমার্জনার ফল হিসাবে ১৯১৩ সালের দিকে বেরোয় ‘বিশুদ্ধ বিষয়বিদ্যার ধারণা এবং বিষয়বিদ্যাজাত দর্শন’ (Ideas for a Pure Phenomenology and a Phenomenological Philosophy)। এই বইটি সাধারণত ‘আইডিয়াস ১’ নামে খ্যাত। এরপর হুসার্লের মৃত্যুর পর আরও দুটো খণ্ড বেরিয়েছিল। তবে এই পর্যায়ে, অনেকে দাবি করেন, প্রকৃতিবিজ্ঞানের যে স্পিরিট নিয়ে বিষয়বিদ্যা গড়ে উঠেছিল হুসার্লের চিন্তা সেখান থেকে দূরে সরে এসেছে। জীবনের শেষের দিকে হসার্লের দর্শন নিন্দার্থে ‘ভাববাদী’ চরিত্র গ্রহণ করেছে বলেও অনেকে অভিযোগ করেন। ।
ফ্রেইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরাপুরি প্রফেসর হিসাবে হুসার্ল যোগদান করেন ১৯১৬ সালের দিকে। এই শহরেই তিনি অধ্যাপনা জীবন থেকে অবসর নেবার পর বসবাস করতে থাকেন। এই সময়েই তাঁর জার্নালে তিনি মার্টিন হেইডেগারের বিখ্যাত ‘আছে হওয়ার মানে ও সময়’ (Being and Time) সংক্রান্ত সন্দর্ভ ছাপান। ছেপেছিলেন আনন্দের সঙ্গেই, তাঁর স্বভাব মাফিক ঔদার্যে। তবে ছাত্র মার্টিন হেইডেগারের এই কাজে খুব সন্তুষ্ট হন নি হুসার্ল। হেইডেগারের বইটির মার্জিনে তিনি অনেক মন্তব্য করেছিলেন, সেই মন্তব্য থেকেই তাঁর অখুশির কথা বোঝা যায়। এটা ঠিক যে মার্টিন হেইডেগারের হাতে ব্রেনতানো ও হুসার্ল সম্পূর্ণ নতুন ভাবে হাজির হয়েছেন। দর্শনের দরবারে বিষয়বিদ্যা হিসাবে যা গড়ে উঠছিল – অর্থাৎ যখন বিষয়বিদ্যা নিজের স্বরূপ নিয়ে দাঁড়ালো -- তখন চিন্তা নিজের সার্বভৌম জগত নিয়েই হাজির হোল। প্রকৃতি বিজ্ঞান বা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিজ্ঞান চর্চার পদ্ধতি ও প্রকরণের যে শৃংখলা বিষয়বিদ্যা অর্জন করেছিল সেই গুণটুকু রইলো ঠিকই, কিন্তু বিষয়বিদ্যা আর মনোবিদ্যার পরিমণ্ডলের ভেতর অন্তর্ভুক্ত রইলো না। নিজের পায়ের ওপরই দাঁড়াতে শিখলো। বিষয়বিদ্যা একালের দর্শনের রূপ হয়ে কিভাবে দাঁড়ালো সেটা বোঝার জন্য ব্রেনতানো-হুসার্ল-হেইডেগার হয়ে চিন্তার পরিক্রমণ পথটুকু বোঝা দরকার। এই পরিক্রমণটা চিন্তার ইতিহাসের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর ওপর নজর রাখা দরকার।
জর্মনিতে ১৯৩৩ সালের দিকে নাৎসিদের ক্ষমতারোহনের ফলে ফ্রেইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমুন্ড হুসার্ল আর দার্শনিক হিসাবে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় থাকেন না। এরপরও তিনি বক্তৃতা, আলোচনা ও দেশবিদেশের গুণগ্রাহীদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে তাঁর ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন যথাসাধ্য। এই সময় তাঁর মেধাবি শিষ্য ইউগেন ফিঙ্ক (১৯০৫ – ১৯৭৫) তাঁকে আন্তরিক ভাবে সহায়তা করেন। অস্ট্রিয়া ১৯৩৫-এর দিকে নাৎসিদের অধিকারে ছিল না। এই সময় ভিয়েনায় বক্তৃতা দেবার আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন হুসার্ল। এই শহরেই তিনি প্রায় আধা শতাব্দি আগে ব্রেনতানোর ছাত্র ছিলেন। একই বছরের শেষের দিকে ভিয়েনা থেকে আরেকটি শহর প্রাগেও বেশ কটি বক্তৃতা দেন এডমুন্ড। ঐ বক্তৃতাগুলোতেও তাঁর সুনামআরও ছড়ায়। এই সময়টাতেই চিন্তার ক্ষেত্রে তিনি আরেকটি বড় কাজ করতে সক্ষম হন। ইউরোপে নানান বিজ্ঞানশাস্ত্রের তুমুল বিকাশে ঘটলেও দার্শনিক দিক থেকে বিস্তর সংকট তৈরী হয়েছিল। সেইসব নিয়ে প্রকাশ করেন তাঁর আরেকটি বিখ্যাত বই ‘ইউরোপীয় বিজ্ঞানকলার সংকট ও ও নির্লৌকিক বিষয়বিদ্যা’ (The Crisis of European Sciences and Transcendental Phenomenology) । বড় কাজের মধ্যে এটাই তাঁর শেষ কাজ। এ বইয়ের লেখাগুলি ১৯৩৬ সালের দিকে প্রকাশিত হতে শুরু করে। এডমুন্ড হুসার্ল শেষ জীবনে বেশ অসুখে ভুগে ছিলেন এবং মারা যান ১৯৩৮ সালের ২৭ এপ্রিলে।
এডমুণ্ড হুসার্ল সম্পর্কে এই হোল সংক্ষিপ্ত একটি পরিচিতি। এরপরের কিস্তিতে আমরা বাংলা ভাষায় দার্শনিক পরিভাষা নিয়ে কিছু কথা বলব। মূলত ব্রেনতানো ও হুসার্লকে নিয়েই। ওপরে Logical Investigation বইটির অনুবাদ করেছি চিন্তাশীল অধ্যয়ন। যাঁরা আক্ষরিক ভাবে দর্শন পাঠ করেন তাঁদের জন্য এটা প্রশ্ন তৈরী করতে পারে। হুসার্ল এই বইতে লজিক নিয়ে আলোচনা করেছেন, কিন্তু ঠিক লজিক বা যুক্তিবিদ্যা তাঁর বিষয় ছিল না, তাঁর বিষয় ছিল চিন্তা। আর লজিকাল বলতে ব্যাপকার্থে তিনি চিন্তাশীলতাই বুঝিয়েছেন, যৌক্তিক বোঝান নি। ফলে এর অনুবাদ যৌক্তিক অন্বেষণ নয়।
বাংলায় অনুবাদ করবার মধ্য দিয়েও আমাদের সাধনা হবে বাংলা ভাষার স্বভাবের মধ্যে থেকে সেই ভাষার বাইরের ধ্যানধারণা কিভাবে আত্মস্থ করা যায়। আর আত্মস্থ করা না গেলে অন্যভাষায় প্রণীত চিন্তা মোকাবিলাও নিজের ভাষায় মোকাবিলাও অসম্ভব কাজ। আমরা কিভাবে মোকাবেলা করি সেই পারাটাই বলে দেবে বাংলা ভাষায় দর্শন চর্চার ক্ষমতা আমরা আদৌ অর্জন করেছি কিনা।
নাকি বৃথা ভ্রমণ ভূমণ্ডলে ! !
ফরহাদ মজহার।