somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: আঁধার

০৩ রা এপ্রিল, ২০১২ রাত ১২:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাথা থেকে ঘটনাটা তাড়াতে পারছিলাম না।
*
শহর থেকে যত দূরে যাচ্ছি ক্রমেই ভিড় কমে যাচ্ছে। জানালার পাশে বসে থাকা স্বর্ণকেশী মেয়েটা হন্ত দন্ত হয়ে নেমে গেল। খুব মনযোগ দিয়ে বই পড়ছিল। কি পড়ছিল, আমি ভাবছিলাম। বইটা সে ফেলে গিয়েছে দেখে তুলে নিলাম। প্রচ্ছদে একট হাতের ছবি। রেলের ঝাঁকুনিতে আলস্য আসে, স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে। আমার মনে পড়ে গেল সেই সময়টা, আড়াই যুগ আগে। তারপর ঘটে যাওয়া এক দু:খজনক ঘটনার পর আমি হাত দেখি নি।

ট্রেন জুরিখ থাকে ব্ল্যাক ফরেস্ট যাচ্ছে। পথে ছোট ছোট শহরে থামছে। উলসহোবার্স থেকে আর পঞ্চান্ন মাইল দুরে আমার গন্তব্য। বৈচিত্র্যময় এ অঞ্চল। গত শীতে যখন আসি তুষারাচ্ছন্ন হয়ে লক্ষীবাজারের বরফভাঙা কাঠি-আইসক্রিমের মত গাছগুলো ঢেকে ছিল। পতনশীল বৃক্ষ সবুজ হয়ে গেছে। আর ফাঁকে ফাঁকে মাঠ। জুনিপার ম্যাপলের অরন্য পার হলে শুরু হবে পাইনের বন। মাঝখানে নাম না জানা একটা জায়গায় ট্রেন দম নেয়। সিলেটের বিট অরণ্যের মত ফাঁকা ফাঁকা। নীল ফ্যাকাশে দিকচক্রবালে কিছু পাখি উড়ে যাচ্ছে। সুইস ভাষায় লেখা সতর্কবানী - হরিণের অভয়ারন্য। ট্রেন সাপের মত বেকে গেলে জানালা দিয়ে স্টীম ইঞ্জিন দেখা যায় । স্টিম হলে বাষ্পচালিত হবে। মনে হয় চেহারাটা খেলনা ট্রেনের মত। এ যুগে বাষ্প দিয়ে যন্ত্র চালানো কেউ বিশ্বাস করবে না।

**
আমি বোটানীর শিক্ষক । গাছের পাতা দেখে বৃক্ষের শ্রেণীবিন্যাস মনে হওয়া উচিত। ভাবা উচিত বৈজ্ঞানিক নাম কনিফেরাস জুনিপেরাসের কথা। আর আমি কিনা ভাবছি ট্রেনের ইঞ্জিনের কৌশল!

গতকাল আমার জন্মদিন ছিল। আমাকে ছুটি দিয়ে ভাবতেই অবাক লাগে পঞ্চান্ন পার হয়ে ছাপ্পান্নতে পড়লাম। আমি যখন প্রথম ভিক্টোরিয়া কলেজে ঢুকি, বয়স পঁচিশ । রহস্য ভাললাগার বয়স সেটা। ‌কিরো শিখে সবার হাত দেখেছি। আধুনিক বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা এসব মানে না। কিন্তু মানুষের ভাগ্য বলে কিছু থাকে। আমি যে হাত দেখতে পারি ঘটনাক্রমে কলেজের অধ্যক্ষের নজরে এসেছিল।

কলেজটা আমার বেশ পছন্দের ছিল। কিন্তু ঢাকার বাইরে পোস্টিং এ আব্বার দ্বিমত ছিল। একে আমি ছোট ছেলে। আব্বা অসুস্থ। তিনি সব সময়ই বলতেন, রাজধানীর বাইরে গেলে আর শহরে ফেরা যায় না। ঢাকা শহরে এসে তিনি কি করে সংগ্রাম করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন সে গল্পটা শুনে শুনে মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। তার যুক্তিটা ফেলে দেবার নয়, এত কষ্ট করে ছেলেপুলে নিয়ে ঢাকায় এসেছেন, তার ছেলে গ্রামের কলেজে চলে গেলে এটা মনে লাগবেই।

ভিক্টোরিয়া কলেজ এত সুনামধারী কলেজ এটা তাকে বোঝাবে কে?

একদিন কলেজের অধ্যক্ষ তার রুমে সালাম দিলেন।তিনি অবাক করে বললেন আমি যাতে তার এক আত্মীয়ার হাত দেখিয়ে দেই।

-স্যার আমি হাত দেখতে পারি না।
-আপনি যে পারেন তা জানি।

মহিলাটি অন্যপাশে মাথা নত করে বসেছিলেন। মলিন চেহারা । আমি প্রিন্সিপাল সাহেবের সামনে দ্রুত হাত দেখার ভান করি। তার স্বভাবসুলভ ভাবে বলেছিলাম তার হাতে একটা ফাড়া আছে। কি ফাড়া আছে আমার জ্ঞানে ছিল না। কারণ হাতের মধ্যবর্তী অংশে ভালুকের আঁচড়ানোর মত সমান্তরাল চিরল দাগ। আমি তারপরই তাকে বলেছিলাম সব ভাগ্যই পরিবর্তনশীল।

**
আমি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। এমন সময় ট্রেনের অন্য কম্পার্টমেন্ট থেকে চোরা দরজা দিয়ে টিকেট চেকার ঢুকলো।
আমি টিকেট দেখালে ঠোট চেপে সম্মতি দিলেন। বললেন, আজকে স্ট্রসবার্গে ট্রেন ডিলে হবে। ট্রেনে তখনো আরো কয়েকজন ছিল।

এখান থেকে বাস পাওয়া যায়।
অধিকাংশের তাড়া ছিল বলেই স্ট্রসবার্গের আগের স্টেশনে নেমে গেল।

আর কুড়ি মাইল বাকি। আমি কম্পার্টমেন্টে একা ।বাইরে প্রেইরী অঞ্চলের মত ঘাস দীর্ঘ, দেখছি আর বই পড়ছি।
*
আগে ভাগে বলে নেই, আমি সখ করে কবিতা লিখি। পড়িও। কবিতার বই খুলে বসেছিলাম মাত্র।
এই শোনেন?
একটা মিষ্টি কণ্ঠ বলে উঠল।
আমি তাকিয়ে দেখলাম একটা বার বছরের মেয়ে। যেখানে হাত দেখার পত্রিকা পড়েছিল সেই বেঞ্চে বসে।

মেয়েটি দেখতে ভারী মিষ্টি। ডালিমকে আধেক করে দিলে যেমন করে টসটসে ওর গায়ের রঙ। ফ্রীল দেয়া নীল রঙের ফ্রক। কিন্তু তার চোখের নিচে কাল ছোপ। মুখে কেমন অসুখের ছাপ। সে উঠে আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে । আমি রিডিং গ্লাস তুলে বললাম
তুমি কি একা, খুকি। কতদূর যাবে?
রিভার্সপোর্টে আমার বোনের বাড়িতে
তুমি গেছ আগে ওখানে ?
না
তাহলে?
না যেতে হবে একটা কথা বলা দরকার।

মেয়েটার চোখ উদ্বিগ্ন। সে কি ভয় পাচ্ছিল?

বলল, রিভার্টপোর্টে মনে হয় যেতে পারবো না? ভয় লাগছে কেন যেন। তাকে অভয় দেই, ট্রেন তো যাবেই। তুমিও যাবে।
ছোট মেয়েটা বলে, আপনাকে খুব আপন মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে অনেক দেখেছি। একটু হাত ধরে রাখবেন।
আমি বলেছিলাম জায়গাটা কাছেই নীলত্র মাউন্টেনের টানেল পার হলে মাইল দশেক পর রিভার্সপোর্ট।


রেলপথটা তখন উপর দিকে উঠছে। আমি টের পাচ্ছি সমতলের অঞ্চলটা পাহাড়ে উঠছে।
ইঞ্জিনের যেন কষ্টে হয় উঠতে । ফোস ফোস সাপের মত শব্দ করে।

আমি হঠাৎ যেন সেই কলেজের সময়ে ফিরে গেলাম।
আমার হাত দেখানোর জন্য এসেছিলেন তিনি আমার কাছে এসেছিলেন আবারও। তার হাতের রেখা পাল্টে গেছে। মনে হয় কেউ সিরিষ কাগজে প্রতিদিন ঘষে দেয়।
-আপনার হাত বড় অদ্ভুত। আপনার পরিচিত কেউ কি অসুস্থ।
-হুম, মিতু, ও আমার জান। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। কেউ বলতে পারে না সে কেন এমন হচ্ছে। রাতে ঘুমোতে পারে না। অন্ধকার ভয় পায় এমন মেয়ে দেখি নি।

আমি ঠিক , বললাম কোন ফাড়া? আমার সংসারে আমার ছোট বোনটাই সঙ্গী ।
ও অসুস্থ খুব।
বলেই তিনি বললেন,ওকে ঠিক করে দেন।

আমি পুরোটা বুঝে তাকে আশ্বস্ত করেছি যে ফাড়াটা কেটে যাবে।
এই মিথ্যেটুকু তাকে বলতেই হতো।
বিশ্বাস করলেন। আবার মনে হয় অবিশ্বাসও তার চোখে।
আপনি মুখে বললে ঠিক হবে?
কোন পড়া কিছু দেন। আপনি শুনেছি সৈয়দ বংশের মানুষ। তুলা রাশি।
আমার সম্পর্কে এত কিছু জানে দেখে অবাক হয়েছিলাম।
তাকে আমি বললাম এমনিতেই হবে।
আমি দোয়া করে দেই।
চলে গেলেন উনি।
তারপর আবার এলেন তিন দিন পর। মেয়েটির জ্বর বেড়েছে।

এরপর দিন আবার এলেন
সপ্তাহ খানেক পর যখন এসেছেন আমার সামনে একটাল পরীক্ষার খাতা। তাকে আমি বললাম, দেখুন
আমি এসব জানি না। ডাক্তারের উপর আস্থা রাখুন।
আমাকে খুব অনুরোধ করলেন তার বাড়িতে যেতে।
আমি পরদিন যাবো বলেছিলাম। তিনি খুব অনুরোধ করে পানি পড়া নিয়ে গেলেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য হল আমার আর সে সুযোগ আসেনি। বহুদিন পর ্তার সঙ্গে দেখা হয়, তখন জেনেছি
মেয়েটি মারা গেছে
...
ট্রেনটি যখন টানেলে ঢুকছিল কিশোরীটি আমাকে বলেছিল তার ভয় হয়। আমি তাকে বলেছিলাম কিসের ভয়?
বলল, অন্ধকারের। অন্ধকারে সে একা থাকতে পারে না।
তাহলে উঠেছ কেন?
আমি উঠিনি এই ট্রেনে
বলতে বলতে ট্রেন টানেলে ঢুকে পড়ল। আমি শো শো বাতাসের শব্দ শুনছি। এমন সময় ট্রেনের বাতিগুলোও নিভে গেল।

মেয়েটি আমাকে তার হাত ধরতে বলেছে কিন্তু অন্ধকারে তার হাত ধরার উপায় নেই।
ধীরগতিতে ট্রেনটা যখন বেরিয়ে এসেছে। আমি দেখতে পেলাম আমি একা বসে আছি।
মেয়েটি কি তবে ঝাঁপ দিয়েছে! উদ্ধিগ্নতা ভর করে মনে।

আমি হঠাৎ সিটের পাশে একটা গ্লাস দেখতে পেলাম। আমিই বোতল থেকে ঢেলে পানিটা খেয়ে রেখেছি নিশ্চিত।
...
আমার মনে হচ্ছিল পুরোটাই একটা কল্পনা। আমি নিশ্চিত সেই শিশুটিকে নিয়ে ভেবেছিলাম গত রাতে।
তাছাড়া গত কয়দিন হুমায়ুন আহমেদ পড়া হয়েছে খুব।
বিদেশে একাকীত্বে বাংলা পুরনো বইই সম্বল।
কিন্তু সবচেয়ে অবাক হলাম পরের স্টেশনে এক স্থুলাঙ্গিনী মহিলা উঠলেন।
আমি প্রথমে চিনিনি।
বাংলায় বললেন, স্যার, আপনি এখানে?
আমি ইউনিভার্সটিতে পড়াই
এক বছরের স্কলার শিপে। কিন্তু আপনি এখানে কি করে?
-আমি আমার বোনের মৃত্যুর পর এক সুইস এনজিওর সঙ্গে কাজ করতে এখানে আসি। আর ফিরে যাইনি।


--
ড্রাফট ১.০
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১২ রাত ১:২৩
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×