বাংলা কথাসাহিত্যে ‘অপরাজেয় কথাশিল্পী’ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। শরৎচন্দ্র পাঠ করেন নি এমন শিক্ষিত বা মোটামুটি লেখাপড়া জানা বাঙালি পাওয়া দুষ্কর।
প্রথমেই বলে নেই, আমার মত কোমল হৃদয়ের যারা এই উপন্যাস পড়বেন, তাদের চোখের জল গড়াবেই কেষ্টর কষ্টের কাহিনী অনুভব করে ।
মুলত ১৪ বছরের কেষ্ট উপন্যাসের মূল চরিত্র, যার মা মারা যাবার পর থেকে সৎ বোনের বাড়িতে থাকা নিয়ে উপন্যাস সামনের দিকে আগাতে থাকে । এবং সৎ বোনের বাসায় তার যে অমানসিক নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে তারই এক বর্ণনা আছে উপন্যাস টিতে ।
এটা আসলে গল্প না উপন্যাস আমি সঠিক ভাবে বলতে পারবনা তবে এক অমর সৃষ্টি এব্যাপারে নিশ্চিত ।
কেষ্টর পাশাপাশি উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্র গুলো হল ,
কেষ্টর সৎ বোন কাদম্বিনী, কাদম্বিনীর স্বামী নবীন , নবীনের ভাই বিপিন আর বিপিন স্ত্রী হেমাঙ্গিনী ।
আরো ছিল কাদম্বিনীর সন্তান পাচুঁগোপাল , আর হেমাঙ্গিনীর সন্তান উমা আর ললিত ।
কেষ্ট তার সৎ বোনের জা কে, মানে হেমাঙ্গিনীকে তার মেজদিদি বলে ডাকতে শুরু করে এবং তার মা মারা যাবার পর মেজদিদির কাছেই সে অনেকটুকু ভালবাসা পায় , আর পায় পেট পুরে খেতে। যেটা কখনোই পেত না কাদম্বিনীর কাছে তাই বার বার চলে আসত হেমাঙ্গিনীর কাছে ।
হেমাঙ্গিনীর কেষ্ট প্রতি অতিরিক্ত ভালবাসা বিপিনের পছন্দ হত না, তারপর আবার দুই ভাইয়ের সংসারে এ নিয়ে বিবাদ ও লেগেছিল । তাই হেমাঙ্গিনীকে বিষয়টা বিভিন্ন ভাবে জানিয়ে দেয়।
এদিকে হেমাঙ্গিনীর কোমল হৃদয়ও কেষ্টর ওপর এই সব অমানবিক নির্যাতন সহ্য করতেও পারে না আবার সব সময় স্বামীর কারণে কাছেও টানতে পারেনা ।
একটা পর্যায় সে কেষ্টকে বলে,
“হেমাঙ্গিনীর চোখ ফাটিয়া জল আসিতে লাগিল; তথাপি তিনি মুখ ফিরাইয়া রুক্ষস্বরে বলিলেন, বিরক্ত করিস নে কেষ্ট, যা এখান থেকে। ডেকে পাঠালে আসিস, নইলে যখন তখন এসে আমাকে বিরক্ত করিস নে।
না বিরক্ত করিনি ত, বলিয়া ভীত লজ্জিত মুখখানি হেঁট করিয়া তাড়াতাড়ি কেষ্ট উঠিয়া গেল।
এইবার হেমাঙ্গিনীর দুই চোখ বাহিয়া প্রস্রবণের মত জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। তিনি সুস্পষ্ট দেখিতে লাগিলেন, এই নিরুপায় অনাথ ছেলেটা মা হারাইয়া তাঁকেই মা বলিয়া আশ্রয় করিতেছে। তাঁহারই আঁচলের অল্প একটুখানি মাথায় টানিয়া লইবার জন্য কাঙালের মত কি করিয়াই না বেড়াইতেছে।
হেমাঙ্গিনী চোখ মুছিয়া মনেমনে বলিলেন, কেষ্ট, মুখখানি অমন করে গেলি ভাই, কিন্তু তোর এই মেজদি যে তোর চেয়েও নিরুপায়! তোকে জোর করে বুকে টেনে আনবে সে ক্ষমতা যে তার নেই ভাই” ।
এভাবেই মেয়েদের মায়ের মত ভালবাসা আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার যে সীমাবদ্ধতা তা লেখক খুব স্পষ্ট ভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন ।
এরপর একসময় যখন হেমাঙ্গিনীর অতিরিক্ত জ্বর আর সর্দি হয় তখন কেষ্ট তার সৎ বোনের বাসা থেকে ৩ টাকা চুরি করে প্রসাদ আনতে গিয়ে ধরা পড়ার পর কাদম্বিনী আর তার স্বামী নবীন কেষ্ট কে প্রচন্ড পরিমাণে মারধোর করে মেজ জা কে যখন বিচার দিতে যায় আর বলে যে সেই নাকি কেষ্ট কে চুরি করতে শিখিয়েছে এবং উচ্চবাচ্য করতে শুরু করে তখন হেমাঙ্গিনী/ মেজদিদি সর্ম্পকে লেখক বলেন,
“মুহূর্তকালের জন্য হেমাঙ্গিনী হতজ্ঞানের মত স্তম্ভিত হইয়া রহিল। এমন নিষ্ঠুর আঘাত, এত বড় নির্লজ্জ অপমান, মানুষ মানুষকে যে করিতে পারে, ইহা যেন তাহার মাথায় প্রবেশ করিল না। কিন্তু ঐ মুহূর্তকালের জন্য। পরক্ষনেই সে মর্মান্তিক আহত সিংহীর মত দুই চোখে আগুন জ্বালিয়া বাহির হইয়া আসিল। ভাশুরকে সুমুখে দেখিয়া মাথায় কাপড় আর একটু টানিয়া দিল, কিন্তু রাগ সামলাইতে পারিল না। বড়-জাকে সম্বোধন করিয়া মৃদু অথচ কঠোরস্বরে বলিল, তুমি এতবড় চামার যে, তোমার সঙ্গে কথা কইতেও আমার ঘৃণা বোধ হয়। তুমি এতবড় বেহায়া মেয়েমানুষ যে, ঐ ছোঁড়াটাকে ভাই বলেও পরিচয় দিচ্চ। মানুষ জানোয়ার পুষলে তাকেও পেট ভরে খেতে দেয়, কিন্তু ঐ হতভাগাটাকে দিয়ে যত-রকমের ছোট কাজ করিয়ে নিয়েও তোমরা আজ পর্যন্ত একদিন পেট ভরে খেতে দাও না। আমি না থাকলে এতদিন ও না খেতে পেয়েই মরে যেত। ও পেটের জ্বালায় শুধু ছুটে আসে আমার কাছে, সোহাগ-আহ্লাদ করতে আসে না।
বড়-জা বলিলেন, আমরা খেতে দিইনে, শুধু খাটিয়ে নিই, আর তুমি ওকে খেতে দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেচ?”
এভাবেই আগাতে থাকে গল্প ।
একটা পর্যায় লেখক মেজদি/হেমাঙ্গিনী আর কেষ্ট সর্ম্পকে লিখেন,
“সত্যকার স্নেহ যে কি, তাহা দুঃখী মায়ের কাছে কেষ্ট শিখিয়াছিল, এই মেজদির মধ্যে তাহাঁই আস্বাদন করিয়া কেষ্টর রুদ্ধ মাতৃশোক আজ গালিয়া করিয়া গেল। উঠিবার সময় মেজদির পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া যেন বাতাসে ভাসিতে ভাসিতে বাহির হইয়া আসিল । কিন্তু, তাহার দিদির আক্রোশ তাহার প্রতি প্ৰতিদিনই বাড়িয়াই চলিতে লাগিল। কারণ সে সৎমার ছেলে, সে নিরুপায় । অখ্যাতির ভয়ে তাহাকে তাড়াইয়া দেওয়াও যায় না, বিলাইয়া দেওয়াও যায় না। সুতরাং যখন রাখিতে হইবে তখন যতদিন তাহার দেহ বহে, ততদিন কষিয়া খাটাইয়া লওয়াই ঠিক”।
“আঘাত যতই গুরুতর হোক, প্ৰতিহত হইতে না পাইলে লাগে। না। পর্বতশিখর হইতে নিক্ষেপ করিলেই হাত-পা ভাঙে না, ভাঙে শুধু তখনই- যখন পদতলস্যপৃষ্ঠ কঠিনভূমি সেই বেগ প্রতিরোধ করে। ঠিক তাহাই হইয়াছিল কেষ্টর। মায়ের মরণ যখন পায়ের নীচের নির্ভরস্থলটুকু তাহার একেবারে বিলুপ্ত করিয়া দিল, তখন হইতে বাহিরের কোন আঘাতই তাঁহাকে আঘাত করিয়া ধূলিসাৎ করিয়া দিতে পারিত না । সে দুঃখীর ছেলে, কিন্তু কখনও দুঃখ পায় নাই। লাঞ্ছনা-গঞ্জনার সহিত তাহার পূর্বপরিচয় ছিল না, তথাপি এখানে আসা অবধি কাদম্বিনীর দেওয়া কঠোর দুঃখকষ্ট সে যে অনায়াসে সহ্যু করে”।
শেষে হেমাঙ্গিনীল স্বামী বিপিনের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করছি,
“ বিপিন নিঃশব্দে চাহিয়া রহিলেন, তাহার পর সহসা সুমুখে ঝুঁকিয়া পড়িয়া কেষ্টর ডান-হাতটা ধরিয়া ফেলিয়া বলিলেন, কেষ্ট, তোর মেজদিকে তুই বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আয় ভাই; শপথ করচি, আমি বেঁচে থাকতে তোদের দুই ভাই-বোনকে আজ থেকে কেউ পৃথক করতে পারবে না। আয় ভাই, তোর মেজদিকে নিয়ে আয়”।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ১২:২০