আমার জীবনে পড়া সবচেয়ে জীবনের সাথে মিলে যায় এমন কিছু কথা আর এমন কিছু বক্তব্য ।।
‘শত্রুর জন্য ভালোবাসা’—এই বিষয়ে আজ আমি তোমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই।
প্রথমে খুবই বাস্তবিক একটা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ানো যাক। কীভাবে তুমি তোমার শত্রুকে ভালোবাসবে? আমি মনে করি, শত্রুকে ভালোবাসতে হলে আগে নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। আমি জানি, এটা তোমাদের অবাক করবে যে, আজ সকালে হুট করে আমি কেন শত্রুকে ভালোবাসার কথা বলতে শুরু করলাম। আর বললাম, শুরুতেই নিজের দিকে তাকাও। কিন্তু আমার মনে হয়, শত্রুকে ভালোবাসার প্রক্রিয়ায় এটাই প্রথম এবং সর্বোত্তম উপায়।
আমি জানি, কিছু মানুষ তোমাকে পছন্দ করে না। ব্যাপারটা এমন নয় যে তুমি তাঁর কোনো ক্ষতি করেছ। তবু, তুমি তাঁর কাছে স্রেফ অপছন্দের মানুষ। তোমার হাঁটা-চলা, কথাবার্তা অনেকের কাছেই ভালো লাগবে না। কেউ হয়তো তোমাকে অপছন্দ করে, কারণ তুমি তাঁর চেয়ে ভালো কাজ জানো। তুমি জনপ্রিয়, তোমাকে লোকে পছন্দ করে, সেটাও অপছন্দনীয় হওয়ার কারণ হতে পারে। তোমার চুল তাঁর চেয়ে সামান্য বড় বা ছোট, তোমার গায়ের রং তাঁর চেয়ে খানিকটা উজ্জ্বল কিংবা অনুজ্জ্বল—হয়তো কারণটা এমন! কেবল কারও কোনো ক্ষতি করলেই তুমি তাঁর অপছন্দের পাত্র হবে, তা নয়। অপছন্দ-ব্যাপারটা আসে ঈর্ষাকাতরতা থেকে। মানুষের সহজাত চরিত্রেই এই অনুভূতির প্রভাব আছে।
বহুদিন আগে তোমার আচরণে হয়তো এমন একটা কিছু প্রকাশ পেয়েছিল, যার কারণে কেউ তোমাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে। তোমার হয়তো সেই আচরণের কথা মনেও নেই। তাই বলছি, আগে নিজেকে দিয়ে শুরু করো। হয়তো তোমার মধ্যে এমন কিছু আছে, যা অপরদিকের মানুষটার মধ্যে এই দুর্ভাগ্যজনক ঘৃণার জন্ম দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, তোমার যা করা উচিত তা হলো, শত্রুর ভালো দিক খুঁজে বের করা। যখনই মানুষটার প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা তৈরি হবে, তাঁর ভালো দিকগুলো দেখো, যা তাঁর খারাপ দিকগুলোকেও ছাপিয়ে যাবে।
আমি বহুবার বলেছি, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই একধরনের সিজোফ্রেনিক চরিত্র আছে। আমরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে আছি। আমাদের সবার মধ্যেই এমন কিছু আছে, যার কারণে আমরা লাতিন কবি ওভিদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি, ‘আমি দেখি এবং সমর্থন করি ভালো কাজ, কিন্তু করি খারাপ কাজ।’ আমাদের সবার মধ্যেই এমন কিছু আছে, যার কারণে আমরা প্লেটোর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি, ‘মানুষের চরিত্র হলো একটা রথের মতো। রথটা টেনে নেয় দুটো শক্তিশালী ঘোড়া। দুটোই একে অপরের বিপরীত দিকে যেতে চায়।’ আমরা গ্যেটের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি, ‘আমার মধ্যে ভদ্র এবং অভদ্র—দুটো হওয়ার মতোই যথেষ্ট রসদ আছে।’
শত্রুকে ভালোবাসার আরও একটা উপায় হচ্ছে, যখন তাকে পরাজিত করার মোক্ষম সুযোগ আসবে, তুমি সেটা কোরো না। হ্যাঁ, সে তোমার কাছে হারবে, কিন্তু একটু ভিন্নভাবে। যে মানুষটা তোমাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে, যে মানুষটা তোমার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি দুর্ব্যবহার করে, যে পেছনে তোমার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি খারাপ কথা বলে, যে তোমার নামে মিথ্যে গুজব ছড়ায়; একদিন সে-ই হয়তো কোনো প্রয়োজনে তোমার সামনে দাঁড়াবে।হতে পারে চাকরির জন্য তাঁর কোনো সুপারিশ প্রয়োজন, হতে পারে তোমার কাছে তাঁর এমন একটা সাহায্য দরকার, যেটা তাঁর জীবন বদলে দেবে। এটাই হলো তোমার জয়লাভ করার মোক্ষম সময়! তুমি অবশ্যই তাঁকে সাহায্য করো। ভালোবাসার অর্থ এটাই। দিন শেষে ভালোবাসা কিন্তু কোনো ভাবপ্রবণ বিষয় নয়, যেটা নিয়ে আমরা কথা বলতে পারি। ভালোবাসা হলো কারও মঙ্গল কামনা করার একটা সৃজনশীল উপায়।
চলো, এখন ‘কীভাবে’ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শেষে আমরা বরং ‘কেন’ প্রশ্নের উত্তরটা জানতে চেষ্টা করি। শত্রুকে কীভাবে ভালোবাসব, সেটা জানাই যথেষ্ট নয়। বরং কেন ভালোবাসব, সেটাও জানা জরুরি। আমার মনে হয়, প্রধান কারণটা যিশুখ্রিষ্টই বলে গেছেন। ঘৃণার বিনিময়ে ঘৃণা কেবল ঘৃণাই বাড়াবে। পৃথিবীতে মন্দের পাল্লা ভারী হবে। সে-ই শক্তিশালী, যে ঘৃণার শিকল ছিঁড়ে ফেলতে পারে।
একবার আমি আর আমার ভাই গাড়িতে করে আটলান্টা যাচ্ছিলাম। কোনো এক অজানা কারণে, সব অবিনয়ী গাড়িচালকই সেই রাতে ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। তারা কিছুতেই তাদের গাড়ির হেডলাইটের আলো কমাতে রাজি হচ্ছিল না। আমার ভাই খেপে গিয়ে বলেছিল, ‘আমি জানি আমি কী করতে যাচ্ছি। এরপর যে গাড়িটা আলো কমাবে না, আমিও তার সামনে আমার গাড়ির সর্বোচ্চ আলো ছুড়ে দেব।’ আমি তৎক্ষণাৎ বলেছিলাম, ‘না না! এমনটা কোরো না। তাহলে এই হাইওয়েতে আলোর পরিমাণ এত বেশি হবে যে সবাই দুর্ঘটনায় পড়বে। কোনো একজনকে তো বুদ্ধি-বিবেচনার পরিচয় দিতে হবে!’ পৃথিবীর সব জাতিই ইতিহাসের হাইওয়ে ধরে ছুটছে আর একে অন্যের দিকে তাকিয়ে নিজের গাড়ির আলো কমাতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।
কেন শত্রুকে ভালোবাসব? আরও একটা কারণ হলো, তুমি যখন কাউকে ঘৃণা করো, তখন তোমার চরিত্রটাও বিকৃত হয়ে যায়। তুমি অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করো। ঘৃণা তোমার চোখে লেগে থাকলে তুমি সোজা তাকাতে পারো না। সোজা হাঁটতে পারো না। একজন মানুষের হৃদয় ভরা ঘৃণা, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছুই হতে পারে না! (সংক্ষেপিত)
‘আই হ্যাভ আ ড্রিম।’ ১৯৬৩ সালে আড়াই লাখেরও বেশি শ্রোতার সামনে দাঁড়িয়ে জোরালো গলায় বলেছিলেন মার্টিন লুথার কিং। তাঁর সেই বক্তৃতা কাঁপিয়ে দিয়েছিল পুরো বিশ্বকে। আজ অবধি পৃথিবীর সেরা বক্তাদের তালিকা করলে অবধারিতভাবেই জায়গা করে নেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের এই অবিসংবাদিত নেতা। সে সময় মনটোগমেরির ডেক্সটার অ্যাভিনিউ ব্যাপটিস্ট চার্চ ছিল তাঁর সব আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল। এই উপাসনালয়ে ১৯৫৭ সালের ১৭ নভেম্বর ‘শত্রুর জন্য ভালোবাসা’ শিরোনামে বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি। আজও ফুরায়নি সেই বক্তৃতার আবেদন।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:৪৩