গল্পঃ গুপ্তধন
(Akram H Rafee)
পশ্চিম দিগন্তে সূর্য প্রায় ডুবু ডুবু করছে। প্রফেসর হাল্ক ও তার দুই
সহযোগী এন্ডারসন ও জোশা পৌচালেন
সম্রাট অশোকের দরবার হলের
ঠিক সামনে। নাহ এখন এটা আর
ঠিক আগের মতো নেই। থাকবে
কি করে সম্রাট অশোকের মৃত্যু
হয়েছে চারশো বছরেরও আগে।
এই দরবার হলটা মূল প্রাসাদ থেকে
একটু দূরে হওয়ায় কারোরই নজরে
পড়েনি। কিন্তু হঠ্যাৎ চারশো বছর
পর প্রফেসর হাল্ক কেন এই দরবার
হলের খোঁজ করেছেন তা আসলেই
অতি রোমাঞ্চকর ব্যাপার।
.
প্রফেসর হাল্ক সাউথ আমেরিকান
বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের
প্রধান অধ্যাপক। পুরোনো বই সংগ্রহ
তার একটা প্রিয় শখ। গত বছর এক
লাইব্রেরীতে পুরোনো বই খুঁজতে
গিয়ে এক অদ্ভুত রহস্যের সন্ধান
পান তিনি।
১৬০৯ সালে সম্রাট অশোকের সাথে
লঙ্কান রাজা শ্রী জয়ের সাথে এক
বিশাল যুদ্ধ সংগঠিত হয়। যুদ্ধে সম্রাট
অশোকের বাহিনীরা খুব করুন ভাবেই
পরাজীত হয় এবং সেই যুদ্ধেই
সম্রাট নিহত হন। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার
হলো সম্রাটের মৃত্যুর পর থেকে অন্তত
এক দশক পর্যন্ত অনেক খোঁজাখুঁজি
করেও রাজা শ্রী জয় কোনো ধন-সম্পদের সন্ধানই পাননি। তবে
সম্রাট মৃত্যুর আগে তার ধন সম্পদ
গুলি কি করেছিলেন?
এই বিষয়ে দীর্ঘ ছয় মাস গবেষণা
করে প্রফেসর হাল্ক এক নতুন
তথ্যের সন্ধান পান। সম্রাট যে সালে
নিহত হয়েছিলেন ঠিক সেই বছর
তিনি তার মূল প্রাসাদ থেকে কিছুটা
দুরে নতুন একটি দরবার হল
স্থাপন করেন। এটি তৈরি করতে
সম্রাট প্রায় ১০ কোটি স্বর্ণ মুদ্রা
ব্যয় করেছিলেন। কিন্তু সামান্য
একটা দরবার হলের জন্য কেন তিনি
এতো স্বর্ণ মুদ্রা ব্যয় করেছিলেন?
আর নতুন দরবার হলটি দেখতেও
তেমন আহামরি ছিলনা। তবে কেন
এতো বেশি স্বর্ণ মুদ্রা ব্যয় করলেন
সম্রাট? কিসের জন্য ব্যয় করলেন?
তবেকি এই দরবার হলে এমন কোনো
রহস্য লুকিয়ে আছে যার জন্য সম্রাট
এতো বেশি স্বর্ণ মুদ্রা খরচ করতেও
কৃপণতা করলেন না!
এই রহস্যভেদ করতেই আমেরিকা
থেকে বাংলার মাটিতে দুই সহযোগীকে
নিয়ে ছুটে এলেন প্রফেসর হাল্ক।
.
সূর্য ডুবে গেছে। রাতের আঁধার
চারপাশটা গ্রাস করে ফেলেছে।
প্রফেসর হাল্ক একটা লন্ঠন জ্বালিয়ে
তার দুই সহযোগীকে নিয়ে সম্রাট
অশোকের দরবার হলে প্রবেশ
করলেন। কালের পরিবর্তনে
দরবার হলটি প্রায় ধ্বংসস্তূপে
পরিণত হয়েছে। লন্ঠনের মৃদু আলোয়
চারপাশটা কেমন যেন রহস্যময়
রহস্যময় মনে হচ্ছে!
প্রফেসর প্রায় সবগুলি দেয়াল ভালো
ভাবে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলেন
দেয়ালের মাঝে কিছুই নেই।
তাই তিনি তার দুই সহযোগীকে
মেঝে খোঁড়ার নির্দেশ দিলেন।
প্রফেসর হাল্কের দুই সহযোগী
এন্ডারসন ও জোশা প্রফেসরের
নির্দেশ মতো মেঝের মাটি খোঁড়া
আরম্ব করলো। প্রফেসর একটি
সিগারেট ধরিয়ে তার দুই সহযোগীর
উপর নজর রেখে চলেছেন।
খুঁড়তে খুঁড়তে প্রায় দু-তিন হাত
মাটি খোঁড়া হলো তবুও কোনো
কিছুরই সন্ধান পাওয়া গেলনা। প্রফেসরের চেহারায় কিছুটা চিন্তার
আভাস লক্ষ্য করা গেল।
তবেকি তার এতো আশাভরসা
সবই বিফলে যাবে? তাই ভেবেই
প্রফেসর বেশ চিন্তিত।
এইদিকে এন্ডারসন ও জোশা একমনে
মাটি খুঁড়েই চলেছিলেন কিন্তু
হঠ্যাৎ কোদালের সাথে কোনো
ধাতব বস্তু আঘাত লাগলো যার
ফলে একধরনের শব্দ সৃষ্টি হলো।
উত্তেজনায় প্রফেসরের চোখ দুটি
চকচক করে উঠলো।
ধাতব বস্তুটির উপরের মাটি সরিয়ে
দেখা গেল এটি একটি লোহার
পাটাতন যার ডান পাশে ছোট হাতল
লাগানো। হাতল ধরে জোরে টান
দিতেই পাটাতনটি সরে গেল। আর
বেরিয়ে আসলো গোপন কক্ষে
যাওয়ার একটি সুরঙ্গ।
প্রফেসর তার দুই সহযোগীকে নিয়ে
সুরঙ্গ পথে যাত্রা শুরু করলেন।
অনেক্ষন হাঁটার পর তারা এমন
এক জায়গায় পৌচালেন যেখান
থেকে আর কোনো দিকে যাওয়ার
রাস্তা নেই। ঠিক তখনি প্রফেসরের
চোখে পড়লো দেয়ালের ডান পাশে
একটি লোহার দরজা।
প্রফেসর দরজাটির সামনে গিয়ে
দাঁড়ালেন। দরজাটির মধ্যখানে
দশটি চুইস। প্রতিটা চুইসে একটা
করে ইংরেজি সংখ্যা।
ঠিক এইরকম,
1 2 3 4 5 6 7 8 9 0
আর দরজার উপরে লেখা,
"চার অক্ষরের পাসওয়ার্ডটি প্রবেশ করুন।"
.
প্রফেসর বেশ ঘাবড়ে গেলেন। তিনি
ভাবতে লাগনেন কোন চারটি চুইস
আসল। আর এতে যদি তার একবার
ভুল হয় তবে হয়তো কোনো বিপদও
নেমে আসতে পারে।
অনেক্ষন চিন্তা করার পর তার মুখে
হাঁসি ফুটে উঠলো। আর সাথে সাথেই এক এক করে চেপে দিলেন
1, 6, 0, 9 এই চারটি চুইস।
আর সজ্ঞে সজ্ঞে চারশো বছরের
মরিচা পড়া দরজা বিকট শব্দ করে
খুলে গেল। আর চারদিক আলোকিত
করে জ্বলে উঠলো শতশত বাতি।
প্রফেসর হাল্ক তার সহযোগীদের
দিকে তাকিয়ে মৃদু হেঁসে বললেন,
"এই দরবার হলটি নির্মাণ করা
হয়েছিল 1609 সালে।"
তার দুই সহযোগী কিছুনা বলে
চুপ করে রইলো। কিন্তু তাদের মুখেও
দেখা গেল তৃপ্তির হাঁসি।
.
প্রফেসর তার দুই সহযোগীকে
নিয়ে খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে
প্রবেশ করলেন। আর ভিতরে
ঢুকেই তার চোখ কপালে উঠে গেল।
একি দেখছেন তিনি! এখানে আরো
তিনটি দরজা। তবে কোন দরজা
আসল? কোন দরজার আড়ালে
লুকিয়ে আছে গুপ্তধন?
ভাবতে ভাবতেই প্রথম দরজার
সামনে দাঁড়ালেন তিনি। দরজাটির
মাঝখানে সবুজ রঙের একটি
চুইস আর চুইসের উপর লেখা,
"রনেগুআ রয়াদু"
এরপর তিনি দ্বিতীয় দরজার সামনে
গেলেন। এই দরজাটির মাঝখানেও
সবুজ রঙের একটি চুইস কিন্ত
চুইসের উপররের লেখা ভিন্ন।
চুইসের উপর লেখা,
"রকেরন রয়াদু"
সবশেষে গেলেন তৃতীয় দরজার
সামনে। এই দরজাটির মাঝখানেও
একটি সবুজ রঙের চুইস। আর
চুইসের উপর লেখা,
"রকেশোঅ রয়াদু"
.
অনেক্ষন চিন্তা করেও প্রফেসর
হাল্কের মাথায় কিছু আসলো না।
তাছাড়া চুইসের উপর লেখা ভাষাটাও
তার অজানা আর বেশ রহস্যজনক!
অনেক চিন্তা ভাবনার পর তিনি
এন্ডারসনকে নির্দেশ দিলেন দ্বিতীয়
দরজার চুইসে চাপ দিতে।
এন্ডারসন এর জন্যে একদমই
প্রস্তুত ছিলনা। তবুও প্রফেসরের
নির্দেশে দ্বিতীয় দরজার সামনে
গিয়ে দাঁড়ালেন আর কাঁপা কাঁপা
হাতে দরজার চুইসে চাপ দিলেন।
আর সাথে সাথেই এন্ডারসনের
পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল।
ঠিক যেমনটা ফাঁসির মঞ্চে আসামিদের
সাথে ঘটে থাকে। এন্ডারসন
পড়ে গেলেন এক গভীর গর্তে
যেখান থেকে কখনোই ফিরে আসা
সম্ভব নয়।
এই ঘটনায় প্রফেসর হাল্ক বেশ
ঘাবড়ে গেলেন কিন্ত এটা নিশ্চত
হলেন যে, বাকি দুটি দরজার মধ্যে
একটির পিছনেই লুকিয়ে রাখা
আছে গুপ্তধন। কিন্ত কোন দরজার পিছনে রাখা আছে? এটাই ভাবছেন তিনি। হয়তো জোশাকে দিয়ে আরেকটি একটি
দরজা পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।
কিন্ত জোশার যদি কিছু হয়ে যায়
তবে তার একার পক্ষে বেঁচে ফেরাটাই
অনেক কঠিন হয়ে পড়বে।
প্রফেসর হাল্ক গভীর চিন্তায় পড়লেন।
হঠ্যাৎ তার মাথায় একটা রহস্য
ধরা পড়লো। প্রতিটি দরজায় লেখা
ভাষা গুলোতে দুটি করে শব্দ আছে।
দেখা যাচ্ছে তিনটি দরজারই শেষ
শব্দটা হচ্ছে "রয়াদু"। কিন্তু কি
হতে পারে এই শব্দের রহস্য।
ভাবতে ভাবতে হঠ্যাৎ তার মাথায়
নতুন একটি বুদ্ধি এলো। তিনি "রয়াদু" শব্দের বর্ণ গুলোকে
বিপরীত ভাবে সাজালেন। শেষের
বর্ণটিকে প্রথমে, মাঝের টি মাঝেই
রইলো আর প্রথম বর্ণটি শেষে।
দেখা গেল "রয়াদু" শব্দটিকে বিপরীত
ভাবে সাজালে হয় "দুয়ার" আর
দুয়ার মানে দরজা।
একই পদ্মতীতে তিনি প্রথম
দরজার ভাষাটি বিশ্লেষণ করে
দেখলেন। প্রথম দরজার চুইসের
উপর লেখা, "রনেগুআ রয়াদু"
এখানে "রনেগুআ" শব্দটির বর্ণ গুলি
বিপরীত ভাবে সাজালে অর্থাৎ
শেষের বর্ণ গুলি আগে লিখলে
"রনেগুআ" থেকে পাওয়া যায়
"আগুনের"। তার মানে "রনেগুআ
রয়াদু" এর অর্থ "আগুনের দুয়ার"।
আর আগুনের দুয়ার নিশ্চয়
ভালো হতে পারেনা।
এবার প্রফেসর দ্বিতীয় দুয়ারের
শব্দ দুটি বিশ্লেষণ করে ফেলেন,
"রকেরন রয়াদু" মানে "নরকের
দুয়ার"।
সবশেষে তিনি তৃতীয় দরজার শব্দ
দুটি বিশ্লেষণ করে ফেলেন,
"রকেশোঅ রয়াদু" যার অর্থ দাঁড়ায়
"অশোকের দুয়ার"।
প্রফেসর হাল্কের আর বুঝতে
অসুবিধা হলোনা যে কোন দরজাটি
আসল। আর এক মূহুর্ত দেরি না
করে তিনি তৃতীয় দরজার চুইসে
চাপ দিলেন আর কট কট শব্দ
করতে করতে খুলে গেল দরজা।
চরম কৌতুহল নিয়ে দরজা দিয়ে
ভেতরের রুমে প্রবেশ করলেন
প্রফেসর হাল্ক।
আর রুমটিতে ঢুকেই তার আনন্দ
সীমা ছাড়িয়ে গেল। হ্যাঁ এই সেই
রুম। সেই গুপ্তধনের গোপন কক্ষ।
ঐতো দেখা যাচ্ছে বস্তা বস্তা মোহর,
সোনাদানা, মানিক, মুক্তা আরো
কতো কিছু। আনন্দে প্রফেসরের চোখমুখ জ্বলজ্বল করে উঠলো।
তিনি চিৎকার করে বলতে লাগলেন,
"হ্যাঁ আমি পেরেছি। আমি সফল
হয়েছি, সার্থক হয়েছি। আজ থেকে
এই সব ধন-সম্পদ আমার। শুধুই
আমার। শুধুই আমার।"
তার চিৎকার কেবলই গুপ্তধনের গোপন কক্ষে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো।
:
___সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০১৬ সকাল ১০:৩০