চট্টগ্রাম থেকে ৯২ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে পাহাড়ী শহর বান্দরবান। প্রাকৃতিক সৌর্ন্দয্যের অবারিত সবুজের সমারোহ এবং মেঘে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে যার আছে সে বাংলাদেশের পাহাড়ী কন্যা বান্দরবান ঘুরে আসতে পারেন। চলুন জেনে নেই বিস্তারিত।
যাত্রা পথ (বান্দারবান, রুমা, বান্দরবান, থাঞ্চি,তিন্দু- রেমাক্রি, নাফাখুম, জিনাপারা, আমিয়াখুম, পদ্ম ঝিরি
জীবনের এক অবিশ্বাস্য ভ্রমণ , যা ইতিহাস হয়ে থাকবে সারা জীবন । সন্ধা ৬ টায় পাহাড়ে মেঘের বর্ষণ দেখতে দেখতে আমরা ২জন নারী সহ মোট ১২ জন বান্দরবন পৌছাই , গাইডের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম রুমা জাবার পথে বারমাইল ব্রিজ বাঙ্গা। লাইনের গাড়ি ও বন্ধ , অনেক কষ্ট করে রুমা বাজার পৌঁছলাম । থাকা হল একটি রাত , ইচ্ছা ছিল বগা লেক দেখে কেউকারাডং হয়ে জাদিপাই দেখা। হলনা, ফেরত আসতে হল বান্দরবন
রুমা:
এবার আবারও লাইনের গাড়ি না পেয়ে ট্রাক ভাড়া করে ৩৫ জন মিলে ৪.৫ ঘন্টায় থাঞ্চি, এর মধ্যে মিলেগেল আরও ৫ ভ্রমণ সঙ্গি, আমরা এখন ১৭। সে এক অসাধারন ভ্রমণ ।
এক এক করে উচু উচু পাহাড় অতিক্রম আর প্রকৃতির অসাধারন দৃশ্য । থাঞ্চি পৌঁছলাম বিকেল ৪ টার দিকে , ৩ টা থেকেই রেমাক্রি যাওয়া বন্ধ। কি আর করার থেকে গেলাম থাঞ্ছি । রাতটি তেমন একটা খারাপ কাটেনি ।রাতে সাঙ্গু নদীর ঠাণ্ডা পানিতে গোসল , ফানুস দেখা , হইহুল্লা করে কেটেগেল আরেকটি রাত ।
খুব সকালে ফজর পরে নদীর পাড়ে ফটো সেশন সেরে বোটে করে রেমাক্রির পথে যাত্রা । সাঙ্গু নদীর এমন রুপ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। দুই পাড়ে খারা পাহাড় , নদীর মাঝে মাঝে বিশাল আকারের শৈল্পিক পাথর , উত্তাল ঢেউ , পাখি, বোটের সাথে সাথে মাছের লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটেচলা , জিরি পথ বেয়ে পানি নদীতে বয়ে চলা , এ যেন এক সুন্দরের সাথে যুদ্ধ ।
বেলা ১০ টার দিকে রেমাক্রি পৌঁছলাম । সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে শুরু হল পায়ে চলার পথ । দুর্গম পাহাড়ি পথে চলতে চলতে দেখা হয়েগেল প্রকৃতির এক ভিন্ন রুপের সাথে, যে রুপ আগে কখনো চোখে পরেনি শহুরে বাবুদের ।কখনো খাড়া পাহাড়ের কোল ঘেঁসে কখনো বড় বড় পাথর ডিঙ্গিয়ে আবার কিছুটা ঝিরি পথে, আর হে জোকের ভয় তো আছেই । ৩.৫ ঘণ্টা হাটার পর ক্লান্ত হয়ে পরলাম আমরা সবাই কিন্তু যখনই নাফাকুম ঝর্নার দেখা মিল্ল চাঙ্গা হয়েগেল সবার মন ।কেও কেও জাপিয়ে পরল ঝর্নার পানিতে আর কেও পাশের ঝিরির ঠাণ্ডা পানিতে শীতল করল দেহ মন। এক নিমিষে দূর হয়েগেল সকল ক্লান্তি । ঘড়িতে সময় তখন ২টা ২০ মিনিট, সবাই ক্ষূদার্থ ,কিন্তু খাবার জন্য আছে শুধু কিছু খেজুর আর ঝিরির ঠাণ্ডা পানি । হালকা খাওয়া দাওয়া সেরে আবার শুরু পথ চলা ।এই পথটি আরও বেশী ভয়ংকর আরও বেশী মনমুগ্ধকর । ভয়ংকর এই জন্য এইখানে দেখা হয়ে যেতে পারে চিতা অথবা ভাল্লুকের সাথে তাই কষ্ট হলেও দ্রুত পা চালাতে হচ্ছে ।
সন্ধ্যা ৬ টার দিকে একটি লোকালয়ের সন্ধান মিলল ,জিনাপারা । আগেথেকেই আমাদের ঠিক করাছিল রাতটি জিনাপারায় কাটাব । নড়েন দাদাকে আমাদের আসাদ ভাই আগে থেকেই চিনত, আসাদ আগেও জিনাপারাতে রাত কাটিয়েছেন।আমাদের অবস্থা দেখে নড়েন দাদা চা(green tea, no sugar) করে আনলেন, অসাধারণ লাগলো চা চক্র টি। শরীরের অনেকটা ক্লান্তি দুর হয়ে গেল। কেও কেও পারার নিচে ঝিরিতে গোসল সেরে নিল আর কেও রান্না নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে গেল। ১৭ জন লোকের খাবারেরতো বেবস্তা করতে হবে।
জিনাপারা পাহাড়ের উপরের একটি পারা ১৫-১৬ টি পরিবার থাকে এখানে। মাচার উপরের ঘরগুলা কোটি টাকার রিসোর্ট কেও হার মানাবে । সেদিন ছিল ভরা পূর্ণিমা যাকে ইংরেজিতে বলে full moon night । সে কি অপূর্ব রাতের দৃশ্য, জোছনার আলোয় আলোকিত হয়ে গেল পুরো পাহাড়ি অঞ্চল। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে দেখা গেল সাদা মেঘের খণ্ড খণ্ড টুকরো । নামাজ, খাওয়া শেষে জমলো আড্ডা সাথে গানের আসর ।পরের দিন খুব সকালে আবারও পাহাড়ি পথে যাত্রা শুরু করতে হবে তাই একটু আগে ভাগেই সকলে ঘুমিয়ে পড়লো ।
জিনাপারা
পরিকল্পনা মত কাজ , সকাল ৭ টায় নাস্তা সেড়ে আবার যাত্রা শুরু । এইবার যাত্রা অমিয়াখুম, সাতভাইখুম দেখব বলে, ইন্টারনেটে এই জায়গা গুলোর ছবি দেখে মন আগে থেকেই বেকুল হয়েছিল। এইবার মাত্র ৩ টা পাহাড় পারি দিতে হবে যেগুলো তজিংডং এর পাশ দিয়ে অনেকটা সম উচ্ছতায় নাইখাং হয়ে চলে গেছে অমিয়খুমে । প্রথমে প্রবল উদ্দিপনায় হাটতে তেমন একটা খারাপ লাগছিলনা, ২০০০-২৫০০ ফিট উচ্ছাতার ২ টি পাহাড় পারি দেবার পর শরীর আর চলছিলনা। ৩য় পাহাড়ে উঠার মত কারই শক্তি ছিলনা , তাই খানিকটা বিরতি নিতে হল। পাহাড়ের ঢালুতে চমৎকার একটি ঝিরি ছিল সবাই ঝিরির পানি খেল ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করল, চলতে লাগলো ছবি তোলার কাজ ও । সারা পথে সব মিলিয়ে ১২০০০ এর মত ছবি তোলা হলো , বাড়তি ব্যাটারি ও মেমোরি সবার সাথেই ছিল। যাইহোক বিরতি শেষে অনেক কষ্ট করে ৩য় পাহাড় এর ঢালুতে নামতে নামতে শুনতে পাচ্ছিলাম অমিওখুম ঝর্নার গর্জন ।এইবার পা আর থামতে চায় না। কেও কেও দৌড়াতে শুরু করল। বলে রাখা ভাল পাহাড়ি পথ চলতে তাড়াহুড়া করা বিপদজনক। অবশেষে দুপুর ২টায় দেখামিল্ল অমিয়খুম ঝর্ণার। অমিয়খুম এর সৌন্দর্য আর শরীরের ক্লান্তি মিলে চোখে জল চলে আসলো ।
অমিয়খুম বাংলাদেশের দুরগমতম ঝর্ণার মধ্যে একটি। দুই খাড়া পাহাড়ের মাঝে দিয়ে বয়ে আসা পানি প্রচণ্ড বেগে ঝরে এই জল প্রপাতে, সৃষ্টি করে স্বর্গীয় সৌন্দর্য। অমিয়খুম এর পানি যেমন ঠাণ্ডা তেমন ভয়ংকর , পাথরগুলা খুবই পিচ্ছিল এবং পানির বেগ অনেক বেশি । পাশের পাথরে রশি বেধে আমরা পানিতে নামলাম । উপভোগ করলাম অমিয়খুম এর শীতলতা । ঝর্না থেকে খানিকটা দূরে ছিল অনেক গভির জলাধর , ঝর্না থেকেই এই জলাধর এর জন্ম । সেই জলাধরে লাফিয়ে সাতার কেটে পের হয়ে গেলো অনেকটা সময় । সন্ধ্যার আগে জীণাপাড়া ণা ফিড়ীলে রাতের বেলা পাহাড়ি পথ চলা অসম্ভব। তাই আর সাতভাইখুম যাওয়া হলনা। কিছু খেজুর কলার মোচা আর পাহাড়ি পেয়ারা খেয়ে যাত্রা শুরু জিনাপারার দিকে।
এইবার রাস্তা ভিন্ন , একটি পাহাড় কিন্তু, পাহাড়টি পুরোপুরি খাড়া, তাছাড়া আমাদের সাথে ছিল ২জন মেয়ে।হাতে সময় কম তাই এটাই একমাত্র দ্রুত তম পথ।পাহাড়ে গাছের শীকর ধরে ধরে কয়েকজন উপরে উঠলো আর উপরথেকে রশি আর বাশের সাহায্যে অন্যদের টেনে উপরে তুললো। আমাদের ভাগ্য ভাল কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। অমিয়খুম দেখতে এসে অনেকেই দুর্ঘটনায় পরে, আমাদের সাথেও এমন কয়েকজনের দেখা হয়েছিল। পাহাড়ে চুড়ায় উঠার পর দেখতেপেলাম অমিয়খুমের অন্য এক রুপ। পানি,পাথর,পাহারি গাছ এ জেনো অন্যরকম এক ভালোলাগা । হাতে সময় কম তাই বেশিক্ষণ না দাড়িয়ে হাটা শুরু করলাম। যেতে যেতে পাহাড়ি ফল আর পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। ৭টায় জিনাপারা এসে পৌঁছলাম। লাল চালের ভাত আর সেদ্দ ডিম ভুনা করে কোনরকম ক্ষিদা নিবারন করলাম । আর নড়েন দাদা রাতের জন্য পাহাড়ি মোরগ এর বেবস্থা করলেন। পাহাড়ি মোরগ জবাই হল রান্না হল সবাই মজা করে রাতের খাবার খেলো। জিনাপারায় কেটেগেল আরেকটি রাত। পরদিন সকালে রেমাক্রি হয়ে থাঞ্চি যাবার কথা থাকলেও পদ্ম ঝিরির দেখার লোভ সামলানো গেলনা। তাই ঝিরি পথ ধরে পাহাড়ি অন্য আরেক রুপ দেখতে দেখতে পদ্ম ঝিরি হয়ে বোটে করে চলে আসলাম থাঞ্ছি। থাঞ্ছি এসে আবারও বাস মিস। আমাদের মত আরও অনেকে বাস মিস করেছে। আমরা আরো কয়েকজন মিলে বাস রিজার্ব করে বান্দারবান আসলাম।রাতের বাসে ঢাকার টিকেট আগেই করাছিল । চলে আসলাম ঢাকা সাথে নিয়ে আসলাম কিছু মধুর সৃতি ।
আমিয়াখুম
বান্দরবানে দেখার মত আরও কিছু জায়গাঃ
নীলগিরি: নীলগিরি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যটন কেন্দ্র। এ পর্যটন কেন্দ্রের উচ্চতা প্রায় ৩ হাজার ফুট। এটি বান্দরবান জেলার থানছি উপজেলায় অবস্থিত। বান্দরবান জেলা সদর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত এই পর্যটন কেন্দ্রের অবস্থান। এ পর্বতের পাশেই রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে অবহেলিত উপজাতী সম্প্রদায় ম্রো পল্লী। যাদের বিচিত্র সংস্কৃতি দেখার মত। বর্ষা মৌসুমে নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্রথেকে মেঘ ছোয়ার দূর্লভ সুযোগ রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে নীলগিরি থেকে সূর্যদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। বান্দরবানের সবচেয়ে সুন্দর ও আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র এটি। এটি সেনা তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। এর পাশেই রয়েছে একটি সেনা ক্যাম্প। নিরিবিলিতে স্বপরিবারে কয়েক দিন কাটাতে এটি একটি আর্দশ জায়গা।
শৈল প্রপাতঃ
বান্দরবান রুমা সড়কের ৮ কিলোমিটার দূরে শৈলপ্রপাত অবস্থিত। এটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব সৃষ্টি। ঝর্ণার হিমশীতল পানি এখানে সর্বদা বহমান। এই ঝর্ণার পানিগুলো খুবই স্বচ্ছ এবং হীম শীতল। বর্ষাকালে এ ঝর্ণার দৃশ্য দেখা গেলেও ঝর্ণাতে নামা দুস্কর, বছরের বেশীর ভাগ সময় দেশী বিদেশী পর্যটকে ভরপুর থাকে। রাস্তার পাশে শৈল প্রপাতের অবস্থান হওয়ায় এখানে পর্যটকদের ভিড় বেশী দেখা যায়। এখানে দুর্গম পাহাড়ের কোল ঘেশা আদিবাসী বম সম্প্রদায়ের সংগ্রামী জীবন প্রত্যক্ষ করা।
স্বর্ণমন্দির , মেঘলা , নীলাচল, মিলনছড়ি, চিম্বুক , সাঙ্গু নদী , তাজিলডং , কেওক্রাডং , জাদিপাই ঝরণা , বগালেক ,মিরিঞ্জা পর্যটন কমপ্লেক্স , প্রান্তিক লেক , ঋজুক জলপ্রপাত , নাফাখুম জলপ্রপাত,এছাড়া বান্দরবানে কয়েকটি ঝিরি রয়েছে। যেমনঃ পদ্ম ঝিরি, চিংড়ি ঝিরি, পাতাং ঝিরি, রুমানাপাড়া ঝিরি। আরও দেখতে পারেন রুমা খাল।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৩:৩১