আহলান-সাহলান-মাহে রামাদান, প্রিয় ব্লগারবৃন্দ আসসালামুআলাইকুম। রমাদানুল মুবারাক। সবাই ভাবছেন রমজান শুরু না হতেই এত ঘটা করে শুভেচ্ছা কেন জানাচ্ছি? হ্যাঁ, আপনাদেরকে আজ কিছু বিষয়ে অবগত করার জন্যেই এই লিখা।
গত দু’তিন যাবত সমগ্র বাংলাদেশে একটি প্রশ্ন সবার মূখে “রোজ়া কবে থেকে শুরু?” নিদৃষ্ট সদুত্তর কারো জানা নাই ।তাই কেউ বলছে ১২ তারিখ, কেউ বলছে ১৩। কিন্তু আসলেই কি কোন উত্তর নাই?রমজান মাসের কি কোন নিদৃষ্টতা নাই? বিধান কি বলে? এ প্রশ্নগুলির জবাব খুজেছি আমি এবং খুঁজতে গিয়ে বিস্ময়ের সাথে কিছু তথ্য-যুক্তি-উপাত্ত আবিষ্কার করলাম,যা আপনাদের সাথে শেয়ার না করে পারলাম না।
মিডিয়ার কল্যাণে আপনারা সবাই জানেন যে, বাংলাদেশের এক শ্রেণীর লোক জাতীয় ঈদ-রোযার এক-দু দিন আগ থেকে রোযা রাখে ও সে অনুযায়ী ঈদ পালন করে।মূলত তাদের এই ভিন্নধর্মী পালনের খোঁজ করতে গিয়েই বিষাল এক সত্যের মুখোমুখি হই।
ঈদ-চাঁদ-রোযা এ শব্দগুলো আমাদের সামনে আসলেই একটি সহীহ হাদীসের কথা সবার-ই মনে পড়ে,আর সেটি হল “তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোযা ভাঙ্গো”। একেবারে সহীহ হাদিস এবং এর উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ সকল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়,কিন্তু হাদিসটি একটু গভীর মনযোগ দিয়ে লক্ষ্য করুন, প্রথম শব্দটি “তোমরা”,এই “তোমরা” দ্বারা রাসূলে করীম (সাঃ) এর সকল উম্মতকে বুঝানো হয়েছে।এখানে কোন জাতিগত বা স্থানগত পার্থক্যের উল্লেখ নেই এবং আমরা সবাই জানি রাসুলে করীম (সাঃ) এর সকল কথা সমগ্র মুস্লিম উম্মাহের জন্যে একিভাবে প্রযোজ্য।তারপরেও অনেকে বলবেন,চাঁদ তো একেক এলাকায় একেক দিনে উদিত হয়।তাহলে জেনে রাখুন আল্লাহ-পাক পবিত্র কোরান শরীফের সূরাহ আল-বক্বারাহ এর ১৮৯ নঃ আয়াতে ঘোষনা দিয়েছেন “তাহার আপনাকে(নবী করীম সঃ) জিজ্ঞাসা করে চন্দ্রের(প্রাকৃতিক) অবস্থা সম্পর্কে,আপনি বলিয়া দিন এই চন্দ্র সময় নির্ধারক যন্ত্র বিশেষ,মানুষের(বিভিন্ন বিষয়ের)জন্য এবং হজ্বের জন্য”। লক্ষ্য করুন এখানে আল্লাহ-পাক সমগ্র মানিব জাতির জন্য এক ও একক দিন পনজির কথা বলেছেন। এটিই লুনার ক্যালেন্ডার। আল্লাহ-পাক যেটিকে সার্বজনীন করেছেন সেটাই আমরা এত দিন আঞ্চলিকভাবে ব্যবহার করছি।এখন কথা হচ্ছে আঞ্চলিকভাবে ব্যবহার করলে ক্ষতি কি?কেউ কি জানেন ঈদ-রোযার মূল উদ্দেশ্য কি? এগুলোর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মুস্লিম বিশ্বে ঐক্য সৃষ্টি করা এবং ভাতৃত্ববোধ আরো প্রগাঢ় করা।লুনার ক্যালেন্ডারকে আঞ্চলিকভাবে তথা নিজের মঙ্গড়াভাবে ব্যবহার করলে এর উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়।
এবার আসুন দেখি বাংলাদেশে কিভাবে এই দিন-তারিখ নির্ধারিত হয়? বাংলাদেশে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি “জাতীয় চাঁদ দেখা কমটি” রয়েছে।এরা প্রতিটি ধর্মীয় দিবসের কয়েকদিন আগে নিদৃষ্ট দিনের ঘোষনা দেয়।কিভাবে তারা দিন ঠিক করে-জানেন?ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একটি এয়ার-কন্ডিশন্ড রুমে সবাই বিকেলে বসেন যেখান থেকে রাতের আকাশের চাঁদ তো থাক দূরের কথা আবহাওয়া ভবনের উপরের গ্লোবটিই দেখা যায় না।সবাই এ রুমেই বসে টিভি-রেডিওতে একটি ঘোষণা দেন “বাংলাদেশের আকাশে কোথাও চাঁদ দেখা গেলে ………… ……… নাম্বারে জানাতে অনুরোধ করা হল” তারপর কোন কোন বছর চট্টগ্রাম,নোয়াখালি প্রভৃতি জায়গা থেকে খবর আসে নতুবা খবর না আসলে মাস/দিন ঘোষনা করা হয় কোন প্রকার পর্যালোচনাই ছাড়াই। বেশিরভাগ বছরগুলোতেই আকাশ মেঘ ঢাকা থাকে বলে উনারা চাঁদ দেখতে পান না। যেবার দেখা যায় সেবার খবর আসে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে,এখন কথা হচ্ছে ঢাকায় বসে আপনি যিদি চট্টগ্রামে দেখা চাঁদের খবর শুনে রোযা রাখতে পারেন তাহলে সৌদি-আরবে(*) দেখা চাঁদের খবর শুনে রোযা রাখতে সমস্যা কোথায়? এবার নিশয়ই চিতকার দিয়ে বলে উঠলেন “আরে সোউদি-আরবের সাথে বাংলাদেশের সময়ের পার্থক্য অনেক”। আমি বলি কত? জানেন? মাত্র তিন ঘন্টা পৃথিবীতে দেশভেদে সর্বোচ্চ সময়ের পার্থক্য মাত্র সাড়ে বার ঘন্টা যার ফলে একদিনের বা বারের পার্থক্য হওয়ার কোথাও সম্ভাবনা নেই এবং এ কারনেই অন্যান্য ধর্মালম্বীরা তাদের সকল ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান একই দিন যেমন- ঈস্টার সান্ডে,বড়দিন ইত্যাদি বিশ্বব্যাপী পালন করতে পারে।আর এক্তু জ্ঞানী হয়ে লক্ষ্য করুন, চাঁদ পৃথিবীর একটি উপগ্রহ এবং পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সৃষ্টির পর থেকে আদ্যবধি নিদ্রিষ্ট অক্ষ রেখায় ঘুরে।ফলে ঘুরতে ঘুরতে নতুন চাঁদ যদি সৌদি-আরবে প্রথম দেখা যায় তাহলে তার অল্প কিছুদূর ঘুরলেই বাংলাদেশে দেখা জাওয়ার কথা।এবার পাতাল থেকে চিন্তা করুন, কোন দুজন মানুষ একই গোলীয় সমতলে ভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে-ধরুন একজন বাংলাদেশে এবং আর একজন সৌদি-আরবে। এখন সৌদি আরবে দাঁড়ানো লোকটি চাঁদ দেখল নিদৃষ্ট কৌণিক দূরত্বে,সে একই চাঁদটি আর এক বা দুই ডিগ্রী বাড়ালেই তো বাংলাদেশের মানুষটিএ চাঁদ দেখতে পাওয়ার কথা।তাহলে কথা হচ্ছে আমরা কেন দেখি না,কারন বেশিরভাগ সময়ই আমাদের দেশে ঐ চাঁদটি ঐ দিনই হাল্কাভাবে অতি অল্প সময়ের জন্য গোধূলিলগ্নে দেখা যায়।কিন্তু মেঘ-ঘনত্বের কারনে এবং সময়-স্বল্পতা এবং দিবালোকের কারনে ঐ চাঁদটি খুব বেশি সুস্পষ্টভাবে দেখা যায় না যা এক-দুই দিন পর সুস্পষ্ট হয় এবং এটি দেখেই হেলাল কমিটি ঘোষনা দেয়(লক্ষ্য করবেন প্রতিবার ঈদের চাঁদটিকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মোটা দেখা যায়)।খুব সহজেই বলি যে পদ্ধতিতে হেলাল কমিটি দিন ঘোষনা করে সে পদ্ধতিটী খুবই ঠিক কিন্তু নিয়মে ভুল।এই একই পদ্ধতিতে বিশ্বব্যাপী খোঁজ নিয়ে(বিজ্ঞানের কল্যানে এটা এখন এক সেকেন্ডের বিষয়) চাঁদের ঘোষনা দেয়া বেশি যুক্তি-যুক্ত। এবং এভাবে ঘোষণা দিলে বিশ্বের সাথে ভাতৃত্ববোধ গড়ে উঠা সম্ভব এবং তাতেই এই ধর্মীয় চর্চাগুলোর প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধন হবে।লক্ষ্য করুন বিষয়টি একই সময়ে পালনের জন্যে না বরং একই দিনে পালনের জন্যে। অনেকে গোঁড়া এবং মুর্খের মত এত কিছুর পরেও সময়ের পার্থক্য,দেশ-সীমা ইত্যাদি খোঁড়া যুক্তি নিয়ে বাড়াবাড়ি করবেন,তাদের জন্য কিছু প্রশ্ন- “সারা বিশ্বে জুম্মার নামায কবে হয়? কখন?” “পাকিস্থান একসাথে থাকার সময় তো একই দিনে সব হত, দেশ ভাগ হওয়াতে চাঁদ এবং আকাশ-সীমাও কি ভাগ হয়ে গেল নাকি?” “সৌদি আরবে কেউ ঈদ করে এসে বাংলাদেশে দেখল এখনও দুই রোযা বাকি,উনি তখন কি করবেন?” এসব প্রশ্নের উত্তর আপনারাই দেন। আরো গভীরভাবে এবার তত্ত্ব দেখি। ঈদুল-আধা সম্পর্কে সবাই জানেন যে হজ্ব তথা আরাফার পরের দিন মীনায় হাজীদের সাথে একাত্ম হয়ে সারা বিশ্বের মানুসষ পশু কুরবানি দেয়,কিন্তু এই পরের দিনটা কোন দিন? বাংলাদেশে তো পরের দিন নয় মাঝে মাঝে পরের তিন দিন পরেও ঈদ হওয়ার রেকর্ড আছে। প্রকৃত পক্ষে এটি ঐ হজ্বের পরের দিনই হবে।এখন কথা হচ্ছে এই বিষয়টা কেন এত গুরুত্বপূর্ন? এই বিষয়টা মুসলঅমানদের জন্য খুব খুব বেশি গুরুত্বপূর্ন, কারন যদি ভুল নিয়মে রোযা শুরু হয় তাহলে-
১।গোটা চন্দ্র মাস গননাতেই ভুল হয়
২।শবে-বরাত।শবে-ক্বদর,শবে-মিরাজ ইত্যাদি মহিমান্বিত রজনির ভুল নিদৃষ্টতা হয়
৩।ঈদের দিন রোযা রাখতে হয়,যা সম্পুর্ন হারাম
৪।কুরবানির ঈদে তাকবিরে-তাশরিক দেরিতে পড়া শুরু হয়
আর এসবের গুরুত্ব সম্পর্কে নিশ্চয়ই নতুন কিছু বলার নেই।এত যুক্তিপ্রমানের পরেও অনেক মুসলমান এক কথায় বলবে “এসবের কোন ভিত্তি নেই”।তাদের জন্য বলি, হানাফি মাযহাবে স্পষ্ট বলা আছে “ চাঁদ উদয়ের খবর দুজন বিশ্বস্ত লোক দ্বারা যতদূর প্রচারিত হবে ততদূর পর্যন্ত পরের দিন ঈদ-রোযা ফরয”।এটির পরেও যদি কেউ না মানেন তার জন্য এবার আসল কথা বলি-১৯৯১ সালে ও।আই।সি তে বিশ্বের বেশিরভাগ মুস্লিম দেশের ধর্মীয় আলেমদের উপস্থিতিতে “সারা বিশ্বে একই দিনে ঈদ-রোযা” পালনের জন্য ইজমাহ(*) হয়।আর তো কোন সন্দেহ থাকার কথা না।এ বিষয়টা নিয়ে আমেরিকান মুসলমান্দের মধ্যেও বিতর্ক এবং দু-ভাগ ছিল চার বছর আগ পর্যন্ত কিন্তু এখন তারাও একই দিনে(সারা বিশ্বের সাথে) ঈদ-রোযা পালন করে।তাছাড়া বিশ্বের ৯৬%(উল্লেখযোগ্য দেশগুলোর মধ্যে ইরাক,ইরান,পাকিস্থান,ভারত মাঝে মাঝে এই ৯৬% থেকে বাদ যায়) মুস্লিম দেশ একই দিনে সকল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে।আপ্নার জ্ঞান এবং মেধা কম হলে বুঝে নিন যে নিশয়ই ইসলামের ঐতিহাসিক প্রসিদ্ধ এবং নবী-রাসূলদের দেশে বাংলাদেশের আলেমদের (যাদের বেশিরভাগই ওহাবী *) চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী-মুমিন-সুন্নী আলেম আছেন।বাংলাদেশেও কিছু সুন্নী প্রখ্যাত আলেম তথা ড. আব্দুল্লাহ-আল-মা’রুফ,মোঃ হারুন-অর-রশিদ, ড.এনামুল হক,ড. শমশের আলি এবং আরো বহু আলেম এর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন এবং এর বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন। তারা সবাই এক সাথে নিশ্চয়ই এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভুল করছেন না।
যে কথাটি বলার জন্য এত কিছু বললাম তা হল আজ দিবাগত রাত হতে মাহে-রমজান শুরু হচ্ছে।গোটা পৃথিবীর বেশিরভাগ মুসলিম আজ রাতে সাহরি খাবেন।রহমতের একদিন কাল হতে গননা করা হবে।আপ্নার বিচার বুদ্ধি দিয়ে এখনি সঠিক সিদ্ধান্তটি নিয়ে নিন।
ধন্যবাদ।
আসসালামু-আলাইকুম।
[
**সৌদি-আরবঃ
বার বার সৌদি আরবের কথা বলেছি কারন, পৃথিবীর নাভি বা কেন্দ্র হচ্ছে সৌদি-আরব। বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমানিত বেশিরভাগ সময়েই প্রথম চাঁদ ওখানেই দেখা যাওয়ার কথা তবে ভিন্ন দেশেও দেখা যেতে পারে।
**ইজমাহঃ
ইসলামের আহকাম সংক্রান্ত চারটি ধাপ বিদ্যমান।যথাঃ ১।কুরাআন ২.হাদীস ৩.ইজমাহ ৪.কিয়াস।কুরআন-হাদীস দ্বারা কোন বিষয়ে সংশুয়ের সৃষ্টি হলে তা ইজমাহ দ্বারা নিষ্পত্তি করা হয় এবং ইজমাহ এর সিদ্ধান্ত সকল মুসল্মানের জন্য পালন করা ফরয।
**ওহাবী:
আরবের নজদ প্রদেশের আব্দুল ওহাব নজদী নামক এক ব্যক্তি নতুন করে ইসলাম তৈরি করেন এবং ইসলাম থেকে শবে-বরাত,শবে-মিরাজ,মিলাদ প্রভৃতি চর্চাসহ নবী করীম (সঃ) এর মর্জাদা হানি করার চেস্টা করে।বাংলাদেশে জামাত এই দলের ইসলাম প্রচার করে এবং এরা ওহাবীদের মদদপুষ্ট।
[সাংবাদিক ভাইদের জন্য বলছি, যদি কেউ এই প্রবন্ধটি পত্রিকায় ছাপাতে চান তাহলে [email protected] এই ঠিকানায় যোগাযোগ করুন]
সবাইকে ঈদের আগাম শুভেচ্ছা।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১১ রাত ১১:৩৬