পুরান ঢাকায় এক সময়ে গরুর (গাভী) গাড়ির জনপ্রিয়তা ছিল। সোয়ারী ঘাট, ইসলামবাগ, লালবাগ, চকবাজারের ব্যবসায়ীরা মিরকাদিমের সুবিশাল সাদা রঙয়ের গাভীর গাড়িতে মালামাল বহনে অভ্যস্ত ছিলেন। এ জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে ৯১ পরবর্তী সময়ে গাভী মার্কায় কমিশনার পদে নির্বাচন করেন হাজী মোহাম্মদ সেলিম।
বিএনপি সমর্থিত হলেও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটে জয়ী হয়ে খ্যাতি পান জনতার কমিশনার। বিএনপির এমপি প্রয়াত লে. জে. মীর শওকত আলীর ঘনিষ্ঠজন ছিলেন তিনি। চকবাজার শাহী মসজিদের সামনে সমাবেশে আওয়ামী লীগকে গালমন্দও করেন হাজী সেলিম। ৯৬ সালে তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নও চান। কিন্তু দলীয় টিকিট না পেয়ে নৌকায় উঠে হয়ে যান পার্লামেন্ট মেম্বার।
একে একে গড়ে তোলেন মদিনা গ্রুপ, মদিনা ট্যাংক, টাইগার সিমেন্ট, মদিনা ডেলেলপার্স নামক প্রতিষ্ঠান। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিব্বত হল দখলের পর সেখানে স্ত্রী গুলশান আরা সিটি মার্কেট গড়ে বিক্রির অভিযোগও তার বিরুদ্ধে। এ নিয়ে জবি ছাত্ররা আন্দোলন করেন। তবে সুচতুর হাজী সেলিম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির তখনকার কমিটিকে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি এই তিন জেলা ট্যুরে পাঠিয়ে তাদের কলম বন্ধ করে দেন।
এটি হাজী সেলিমের একটি বড় গুণ, কোথায়ও জমি দখল করবেন তো সাংবাদিক সহ যত ধরণের মুখ বন্ধ করতে হয় সে ব্যাপারে তিনি স্বহস্ত। প্রতি রমজানের ঈদে ভূমি অফিস, সরকারি কতিপয় হর্তা-কর্তা, মিডিয়া পাড়ায় ছুটে যেত মদিনা গ্রুপের মিষ্টি কমলা, আপেল। তিনি আবার বাদামতলী ফল মার্কেট সমিতির নেতা। তাই যেখানে প্রতিবন্ধকতা সেখানেই সুমিষ্ট ফল আর টাকা ঢালতে দারুণ অভ্যস্ত হাজী সাহেব।
রাতের আধাঁরে বুড়িগঙ্গার জমি দখল করে মদিনা গ্রুপের কারখানা সম্প্রসারণের পর বিআইডব্লিউটিএ'র উচ্ছেদকারী সেই কর্মকর্তাও রাতের আধাঁরে বদলী হয়ে গেছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ, সাংবাদিক সবই তার পকেটে। বাবা এমপি, ছেলেকে বানিয়েছেন কাউন্সিলর। ঈদ, উৎসবে গাড়ির চড়ে পাড়া-মহল্লায় ফল ছিটান। হাত বাড়িয়ে দেন সাহায্যের। দু'চারটি পরিবার ঘরছাড়া হলেও এলাকার মানুষের কাছে হাজী সেলিম দানবীর।
যে যাই বলুক হাজী সাহেব ভাগ্যবানও বটে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় যখন রাঘব-বোয়াল ধরার নামে রাজনীতিবিদরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন তিনি তখন ডিপ ফ্রিজে। বুক ফুলিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে বলছিলেন আমি ঢাকায় আছি এবং ডিপ ফ্রিজে আছি।
ওয়ান-ইলেভেন গেল, হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে থাকা ১২০টি মামলার মধ্যে দুর্নীতি সহ ২১ টি মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে যা বিএনপির ভাষায় দলীয় বিবেচনায়। ২০০৯ সালের ২৫ মে যুবদল নেতা আবদুল হান্নান হত্যা মামলায় বিদেশ ট্রাইব্যুনালে গেলেও তাকে জেল খাটতে হয়নি। এরপর ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে তার বিরুদ্ধে থাকা আরও ১০৫টি মামলা প্রত্যাহার করা হয়। পরের বছর পুলিশের ওপর হামলা মামলা থেকেও অব্যাহতি।
ছেলে ইরফান সেলিমের বাসায় র্যাপিড এ্যাকশান ব্যাটালিয়ান (র্যাব) অস্ত্র পেলেও পুলিশের তদন্তে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় ১০ বছরের কারাদণ্ড হয় এই নেতার বিরুদ্ধে। আদালত তাকে ৩০ দিনের মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেন। এতোদিনে তার থাকার কথা ছিল কারাগারে, এমপি পদ হারানোর কথা ছিল। কিন্তু পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশে ছেড়ে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক গেছেন।
স্যালুট মিস্টার হাজী সেলিম, টাকার কাছে সবকিছু ধইঞ্চা! টাকা ছিটিয়ে আপনিই সব পারবেন!
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০২২ রাত ১২:৪০