কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়িতে জাপানের অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। যে কারনে ঠিক পাশেই সোনাদিয়া দ্বীপে আরেকটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে দারুণ উদ্যোগী ছিল অর্থনৈতিক শক্তিধর চীন।
২০১২ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশ সফরে এসে কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ বিনিয়োগের প্রস্তাব দেন। দুই বছর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরে এ নিয়ে সমঝোতা স্মারক চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছিল। যদিও ভারতের অনিচ্ছায় শেষ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী ওই প্রকল্প হতে হঠাৎ করে সরে আসেন।
যৌক্তিকতা ছিল- চীনকে বঙ্গোপসাগরে সহজ প্রবেশাধিকার দিলে এটি ভারতের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে।
এরপরও চীনারা হাল ছাড়েনি। তবে সোনাদিয়ায় চীনা অর্থায়নে বা গভীর সমুদ্রবন্দর যে হচ্ছেনা এটা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার চীনাদের আগ্রহের প্রকল্পে মূল বাঁধার কারন শুধু ভারত, তা কিন্তু নয়। স্পষ্ট করে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-জাপান-অস্ট্রেলিয়া বা ইন্দো-প্যাসিফিক নীতির কাছে প্রাথমিকভাবে ধরা খেয়েছে শি জিনপিংয়ের দেশ।
ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি অনুযায়ী, ভারত বা বঙ্গোপসাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-জাপান-অস্ট্রেলিয়া একচ্ছত্রভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। বিশেষ করে লাদাখে ভারত-চীন মুখোমুখি হওয়াতে নতুন এই জোট নিয়ে দারুণ আগ্রহ ভারতের।
আর এ চারটি রাষ্ট্রই যেহেতু চীনের ঘোরতর শত্রু (অর্থনৈতিক, সামরিক বা সীমান্তঘেঁষা হওয়ার কারনে), তাই তারা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী এলাকায় যে চীনকে ঘাঁটি ঘেরে বসতে দেবেনা এটাই বাস্তবতা।
ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আড়ালে থেকে ইতোমধ্যে জাপানি বিনিয়োগের মাধ্যমে মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর প্রতিষ্ঠা করেছে। এতে ধরেই নেয়া যায় ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নেতৃত্বে তারা একধাপ এগিয়ে আছে।
অন্যদিকে স্থলপথে চীনাদের 'রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশেয়েটিভ (বিআরআই)' প্রকল্পে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়া নিয়েও মার্কিন জোটের ভেটো আছে। এতে স্পষ্ট বাংলাদেশ নিয়ে দুই শক্তিধর জোট বা দেশের টানাটানি চলছে।
২০০৭ সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবের নেতৃত্বে 'The Quadrilateral Security Dialogue বা কোয়াড একটি জােট গঠনও করা হয়। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের 'আগ্রাসী' পররাষ্ট্র নীতি মোকাবিলা করার জন্য অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত জোট ‘কোয়াড’ সম্প্রতি হয়ে উঠেছে। কোয়াডভুক্ত দেশগুলোর প্রতিনিধিরা বৈঠক করেছ এ অঞ্চলের নিরাপত্তা বিধানে বহুপক্ষীয় সুরক্ষাবলয় গঠনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন।
নিরাপত্তা বিষয়ক জোটে 'কোয়াড' এ বাংলাদেশকে টানার চেষ্টা হচ্ছে। এ নিয়ে উদ্বেগে চীন। গতকাল সোমবার ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের বলেছেন, ''বাংলাদেশ কোয়াডে ঢুকে পড়লে যে এ অঞ্চলে চীনের অংশগ্রহণ চীন ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে যথেষ্ট খারাপ করবে''।
কোয়াডে অংশগ্রহণের বিষয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক করে চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, "এ ধরনের ছোট গোষ্ঠী বা ক্লাবে যুক্ত হওয়াটা ভালো না।''
ন্যাটোর আদলে এশিয়ায় একটি সামরিক জোট হিসেবে কাজ করতে চায় ভারত-যুক্তরাষ্ট্র জোট। যার মূল উদ্দেশ্যে জোটভুক্ত দেশের সার্বভৌমত্ব, নৌচলাচলের স্বাধীনতা, সীমানাসংক্রান্ত স্বাধীনতা, অবাধ বাণিজ্য ইত্যাদি নিশ্চিত করা তথা চীন থেকে অর্থনৈতিক বা সামরিক যে কোন যুদ্ধে ভারত বা জাপানকে রক্ষা করা।
প্রশ্ন হল- চীন আমাদের উন্নয়ন সহযোগী দেশ। পদ্মা সেতু থেকে শুরু করে দেশে সবকটি বড় প্রকল্পে চীনাদের অর্থায়ন রয়েছে। তাদের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত বিরোধও নেই। একই উদাহরন জাপানিদেরও। অন্যদিকে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। তাহলে বাংলাদেশ কী কোন একক বলয়ে অংশ নেবে বা অংশ নেয়া ঠিক হবে? বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে গিয়ে আগামী বিশ্ব অর্থনীতির মূল হাতিয়ার চীনের শত্রু হবে?
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০২১ রাত ১২:০৩