মাস কয়েক আগেও তো আমি অন্য রকম ছিলাম। ভাল ছাত্র না হলেও পরীক্ষার আগের রাতে মন দিয়ে পড়তাম। প্রতিদিন ইউনি যেতাম, প্রতিদিন- সকাল ৯টা থেকে রাত ৯-১০-১১টা, কোন ঠিক ঠিকানা ছিল না। বন্ধুদের সাথে সময় বেশ ভালভাবেই কেটে যেত। আর দশ জনের মত আমিও গ্রেড নিয়ে চিন্তা করতাম, সায়েন্টিস্ট হয়ে ক্ল্যাসিফায়েড ল্যাবে কাজ করার স্বপ্ন দেখতে ভাল লাগত। কিন্তু মনের মধ্যে কোথাও কিছু একটা ঠিক ছিল না। কেন যেন মনে হত এই জীবন আমার না। আমি এমন একটি বিষয়ে পড়ছি যেটায় পড়ে আমাকে চাকুরী-ই করতে হবে। কিন্তু চাকুরী ব্যাপার টা আমার একদমই ভাল লাগে না। মন থেকে সায় দিতে পারি না। মনের ভিতরে নিজের অজান্তেই এক চাঁপা অস্থিরতা জন্ম নিচ্ছিল। মাঝে মাঝে শুধু তার প্রতিধ্বনি শুনতে পেতাম- “এই জীবন তোমার জন্য না”।
চিন্তা থেকেই হয়ত চেতনা আসে। বাসের সিটে দীর্ঘ জ্যামে বসে এক চিন্তা ছাড়া আর কিছুই করার থাকত না।
কেন আমি এই পৃথিবীতে আসছি? কি করব এই জীবন টা নিয়ে?
ভাল একটা গ্রেড নিয়ে পাংখা একটা ইউনি থেকে ডিগ্রি নিলাম। একটা মাল্টি-ন্যাশনালে ভাল বেতনে চাকরী ও পেয়ে গেলাম, কঠোর পরিশ্রম করে (মাঝে মাঝে পা চাটা চাটি ও করব) বছর না ঘুরতেই প্রমোশন। আই ফোন থেকে শুরু হবে কেনা কাটা, তারপর আই টাচ, আই প্যাড, স্বপ্নের গ্যাজেট গুলো দিয়ে ঘর ভরে ফেলব। বুদ্ধিমান মানুষের মত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ভাল একটা ব্যাংকে ডিপিএস খুলব। ওহো, আমার বাল্যকালের প্রেমিকার কথা তো বলতে ভুলেই গেলাম।
[চুটিয়ে কয়েক বছর প্রেম করার পর এখন আমি তার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারব। কারন আমি একজন চাকর হয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমান করতে পেরেছি। সবাই এমন একজন চাকর চায়, যে তার মেয়ের সামাজিক আর আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে।]
যাই হোক, বিয়ের পরেই একটা সাজানো গুছানো ছিমছাম ফ্ল্যাট, তারপর গাড়ী। ঢাকা থেকে মাত্র ১০মিনিটের রাস্তার পাশে এক টু্করো জমি-যেখানে শেষ বয়সে গড়ে উঠবে আমার স্বপ্নের আবাস। মাঝে মাঝে বোনাস পাব, ফ্যামিলি ট্রিপে ঘুড়ে আসব মালেয়সিয়া, সিঙাপুর, থাইল্যান্ড, ব্যাঙ্কক।
ধীরে ধীরে শরীরের শক্তি কমতে থাকবে। ছেলে-মেয়েরা বড় হবে। তাদের বেস্ট স্কুল-কলেজে ভর্তি করাব, যেন তারাও আমার মত হতে পারে। তাদের সাফল্য দেখে জীবন সার্থক মনে হবে। রিটায়ার করে বাসার লনে বসে চা খাব আর দেশের অস্থিরতার খবর বেশ মন দিয়ে পড়ব। বিকালের আড্ডায় এই নিয়ে তর্ক করব। এখন আমি মারা গেলেও কোন আফসোস থাকবে না।
শান্তিপূর্ণ- স্বস্থিময়-নিশ্চিত আর নিরাপদ জীবন!!!
হুমম…
শান্তিপূর্ণ- স্বস্থিময়-নিশ্চিত আর নিরাপদ জীবন!!! কেমন লাগবে এমন একটা জীবন পেলে? আসলেই কি নিজেকে সার্থক মনে হবে?
প্রশ্নটা নিজেকেই করেছিলাম। এর উত্তরটা ও আমাকেই দিতে হয়েছে। এমন একটা নিরাপদ জীবনের জন্য আমার মনের উওর ছিল এই রকম-
প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-প্রতিশোধ কমরেড
ভেঙে ফেল, ভেঙে ফেল ব্যারিকেড…।
এমন নিরাপদ জীবন কখনই পাথেয় হতে পারে না। আমাদের চারপাশে নিরাপদ বলতে কোন কিছুই নাই।
ভাল গ্রেড পাওয়ার পরেও আমি চাকরি নাও পেতে পারি, চাকুরি পেলেও ভাল বেতন নাও পেতে পারি, হয়ত এমন একটা বস পাব যে উঠতে বসতে আমাকে অপমান করবে,বউয়ের কারনে বাবা-মাকে ছাড়তে হতে পারে, ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শোয়ার পর কি বউয়ের ক্যাটক্যাট সুন্তে হবে না, যাকে বিয়ে করব সে পরকিয়ায় লিপ্ত হতে পারে, আমার ছেলে-মেয়েরা ইয়াবায় আসক্ত হতে পারে, একদিন সকালের পেপারে হয়ত পড়বেন ট্রাক চাপায় এক পথচারীর মৃত্যু। এরপরেও কি এই জীবন কে ভাল লাগবে???
এইসব কিছু কি কেউ নিশ্চিত করতে পারে? নাহ…পারে না। পারবেও না। আর যদি আমি এমন এক নিশ্চিত জীবনের গ্যারান্টি পেয়ে ও যাই, তবুও এমন জীবন আমার জন্য আরাধ্য হবে না।
এমন জীবন আমার কাছে রোবটিক, বৈচিত্রহীন, নির্মম – এটাকে বেঁচে থাকা বলা যায় না কিছুতেই। এটা তো মরে যাওয়া।
এই জীবন আমি চাই না। এমন রসহীন জীবন আমি চাই না
বিদায়…
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০১১ বিকাল ৪:১২