হঠাৎ ভ্যাপসা গরম আর ঘামের বিকট গন্ধে ঘুম ভেঙে গেল...একটু ধাতস্থ হয়ে দেখি বাসে তুমুল অবস্থা। আমাদের গ্রীন লাইন কুখ্যাত ৬নম্বর এ convert হয়ে গেছে। একজন ঠিক আমার মুখ বরাবর দাড়িয়ে গরম প্রশ্বাস ছাড়ছে। মেজাজ কেমনে ঠান্ডা রাখা যায়??
লোকাল বাসের সাথে আমার সখ্যতা বেশ পুড়ানো। তুরাগ আমার নিত্যদিনের বাহন। লোকাল নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা থাকত না যদি আমাদের হাতে অফুরন্ত সময় থাকত। মাত্র ১ দিনের ছুটি। পরদিন মে দিবস। এখন পর্যন্ত পৌছাতেই পারলাম না।
ধৈর্যের চুড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়ে ১২ টা বেজে ১৫ মিনিটে আমারা নেত্রকোনা-বিরিশিরির মোড়ে নেমে গেলাম। নেমে তো গেলাম...অপেক্ষা করতে আছি তো করতেই আছি, বিরিশিরি যাওয়ার বাস আর আসে না। এদিকে দুপুর শেষ হয়ে বিকাল হয়ে যাচ্ছে। বাসের দেখা শেষ পর্যন্ত আর পেলাম না। একটা ট্রাক যাচ্ছিল সেটার পিছনেই উঠে পড়লাম। শুরু হইল নতুন অত্যাচার। রাস্তা কোন পর্যায়ের খারাপ হলে আপনার নাড়ি-ভূড়ি বের হয়ে আসবে এখন চিন্তা করে নিন। ট্রাক টা যে তথাকথিত রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল সেটা আসলে কোন রাস্তাই না, ক্ষেতের আইল দিয়ে ট্রাক যাচ্ছিল। মাঝে মাঝেই ১-২হাত সমান গর্ত। আইলের পাশ দিয়েই একটি অসমাপ্ত ব্রীজ দেখা যায়, যেটা বিগত ১০ বছর ধরে শুধু তৈরী ই হচ্ছে।
বিরিশিরি যাবার পথে পড়বে কংস নদী
শেষ পর্যন্ত আর ট্রাকের উপর বসে থাকতে পারলাম না, নেমে হাঁটা ধরলাম। যখন বিরিশিরি পৌছাই তখন ঘড়িতে বাজে সাড়ে ৩টা। বাজারেই মুরগীর ঝোল দিয়ে কোন মতে ভাত খেয়েই দৌড় দিলাম সোমেশ্যরী দেখতে।
বিরিশিরির পথ এমনই মনোরম
দূরের মেঘালয়ের পাহাড় গুলো হাতছানি দিয়ে ডাকছিলো। হেঁটে হেঁটে মাঝ নদীতে পৌছে গেলাম। চারিদিকে অসম্ভব সুন্দর বালু রাশি। রাতের বেলা এই বীচে বার.বি.কিউ করেছিলাম।
নদী পার হয়ে রিকশা ঠিক করলাম। আমাদের গন্তব্য বিজয়পুর আর রানিক্ষং। এখানে ভালোভাবে দামাদামি করে নিবেন। আমারা প্রতি রিকশা ২০০টাকা করে দিয়ে ছিলাম। বিজয়পুর চিনামাটির লেকে যাওয়ার পথ টাই অনেক সুন্দর। রাস্তার দু’পাশে সবুজ ধান ক্ষেত, মাঝে মাঝেই চোখে পড়বে ছোট্ট গীর্জা ঘর। আর দূরের পাহাড় শ্রেনী তো আছেই।
বিজয়পুর যাবার রাস্তা
এমন অনেক গীর্জা চোখে পড়বে বিরিশিরি তে
বিজয়পুর টিলার উপর থেকে
বিরিশিরি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। এখনো থাকার যায়গা ঠিক করা হয় নি। YMCH এর রেস্ট হাউস সেদিন একদ্ম ফুল ছিল, তাই বাধ্য হয়ে আমরা বাজারেই একটা রেস্ট হাউসে উঠলাম। বেশ ভালো রেস্ট হাউস, মালিক ও বেশ আলাপী। সারারাত কাটিয়ে ছিলাম সোমেশ্যরীর উপর তৈরী ব্রীজের উপর। নিচে বহমান সোমেশ্যরী আর আকাশে ছিল সেদিন চমৎকার এক চাঁদ। সবাই ভাবুক হয়ে গেলাম। রেস্ট হাউসে যখন ফিরে যাচ্ছিলাম তখন ফযরের আযান দিচ্ছিলো, আকাশের রঙ ফিকে হয়ে যাচ্ছিলো।
রাতের বার বি কিউ
পরদিন সকালে উঠেই গেলাম সুসং রাজ বাড়ী দেখতে। তার আগে দূর্গাপুর বাজারে নাস্তা করে নিলাম। তখন ই হোটেলে খবর পেলাম বিএসএফ বাংলাদেশের ২ জন গ্রামবাসীকে মেরে লাশ নিয়ে গেছে। বাংলাদেশ-ইন্ডিয়ার বর্ডার টা দেখতে ইচ্ছা করছিল।রিকশা নিয়ে চলে গেলাম দেখতে। গারো পাহাড়ের ঠিক তলদেশেই বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া বর্ডার। এখানে একটা পাহাড়ী ঝর্না আছে, যেটা ইন্ডিয়ার ভিতরে পড়েছে। অনেক সাহস নিয়ে চলে গেলাম সেই ঝর্না দেখতে। ঝর্না তো দেখা হয়ে উঠে নি, কিন্তু যা দেখলাম সেটা খুব অবাক করা আর শকিং।
বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া বর্ডার
দুপুরে দূর্গাপুরে এসে দেখি উৎসব শুরু হয়ে গেছে। সকালে ও এমন কিছু চোখে পড়ে নাই। লাল পতাকায় ছেয়ে গেছে ছোট এই জনপদ। আজকে মহান মে দিবস। লঙরখানা খোলা হয়েছে একটা। আজকে সবাই এক সাথে খাবে।
এত ছোট জায়গায় কমিউনিজম এর আধিক্য চোখে পড়ার মত। আর হবে নাই বা কেন, সুসং-দূর্গাপুরের ইতিহাস টাই তো কমিউনিজমের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জরিত।
আমাদের ও ভাগ্য খুলে গেল, বসে গেলাম কাঙালি ভোজে। যেই ভি আই পি ট্রিটমেন্ট টা পেয়েছিলাম, সেটা ভুলার মত না। শ্রমিকদের ভালোবাসা আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল।
এখন আবার ঐ রাস্তা দিয়ে ফিরতে হবে চিন্তা করেই কোমড় ব্যথা শুরু হয়ে গেল।
দূর্গম দূর্গাপুর [পর্ব এক]- Click This Link